দুদিন আগে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী বরিস জনসনের এক পূর্বসূরী তাকে (বরিস জনসন) ‘তৈলাক্ত শুকরের‘ সাথে তুলনা করেন। উক্ত পূর্বসূরী মনে করেন, ‘বরিস জনসন এমন এক ব্যক্তি যিনি যে কোন কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম।‘ কথাটা খুব সত্যি। সত্যি এই কারণে প্রধান মন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতায় বসার পর থেকে একের পর এক মিথ্যে বলা এবং সামপ্রতিক সময়ের ‘পার্টি–গেইট কেলেঙ্কারি‘ সহ বেশ কয়েকটি সমস্যায় তিনি পড়েন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে তার দলীয় প্রধানের পদ ও প্রধান মন্ত্রীত্ব দুটোই যায় যায় দশা। কিন্তু তিনি বেচেঁ যান। নিজের–করা আইন ভঙ্গ করে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে ‘মউজ‘ করতে গিয়ে গদি হারাতে বসেছিলেন বরিস জনসন। অল্পের জন্যে এ যাত্রায়ও বেঁচে গেলেন। রক্ষা পেলেন রাজনৈতিক মৃত্যুর হাত থেকে। অন্ততঃ সামনের আরো একটি বছর তার বিরুদ্ধে কেউ ‘অনাস্থা ভোট‘ আনতে পারবেন না এবং তিনি নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু আসলে কি তিনি ‘নির্বিঘ্নে’ তার দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবেন? গত ৬ জুন তার বিরুদ্ধে যে অনাস্থা–ভোটের আয়োজন করা হয়েছিল তাতে তিনি বেঁচে গেছেন বটে, তবে দলের মধ্যে যে মারাত্মক ‘ক্ষত‘ সৃষ্টি করেছেন তা তিনি সারাবেন কী করে। কোভিডের দুঃসময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মত বৃটেনে আইন করে যখন কোন জনসমাগম, পার্টি–জলসা করা যাবেনা বলা হলো, সেই সময় ‘আনকনভেনশনাল‘এই বৃটিশ রাজনীতিবিদ, টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নিজ সরকারি বাসভবন–কাম–কার্যালয়ে এক নয়, একাধিক ‘গোপন পার্টির‘ আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু গোপন–কথাটি তো আর গোপন রইলোনা। প্রথম দিকে তো তিনি সরাসরি, অনেকটা তার প্রিয়ভাজন, আর এক ‘আনকনভেনশনাল‘ রিয়েল–স্টেট ব্যবসায়ী থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত নিজ অপরাধ অস্বীকার করে বললেন, এমন কোন পার্টিতে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। যখন সাক্ষ্য–প্রমাণাদি সামনে এলো, তখন ঠিক ট্রাম্পের মত সুর বদলিয়ে বললেন, তিনি জানতেন না যে এই ধরনের পার্টি হবে এবং তাতে এতো লোক উপস্থিত থাকবেন। পরে বললেন, তিনি ভেবেছিলেন এটি একটি অফিশিয়াল গ্যাদারিং ইত্যাদি ইত্যাদি। একটি মিথ্যে ঢাকতে তিনি একের পর এক মিথ্যে বলে চললেন। এক সময় পুলিশি তদন্তে দেখা গেল বীয়ারের গ্লাস হাতে বরিস জনসন। বৃটিশ জনগণ বিষয়টি পছন্দ করলেন না। কেননা সেই সময় দেখা গেছে রাণী এলিজাবেথ তার স্বামীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে চার্চের এক বেঞ্চে নিকটজন পরিবেষ্টিত না হয়ে, অসহায়ের মত একা বসে আছেন। করুন ছিল সে দৃশ্য। রাণী নিয়ম ভেঙে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাননি। আর ঠিক সেই সময় জনসন নিজ অফিসে প্রায় শ‘ খানেক লোকজন ও ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের কর্মকর্তাদের নিয়ে পার্টি করছেন। বিরোধী দলে তো বটেই, নিন্দার ঝড় উঠলো নিজ দলের মধ্যেও, সাধারণ জনগণ তো আছেই। ‘পার্টি–গেইট কেলেঙ্কারি‘ হিসাবে পরিচিত এই ঘটনা বরিসের রাতের ঘুম হারাম করে দিল। পার্টিগেইট কেলেঙ্কারির পর কয়েক দফা পুলিশি তদন্ত হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী সহ আরো বেশ কয়েক দলীয় নেতা ও সরকারি কর্মকর্তা যারা ওই ধরনের পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন তাদের জরিমানা করা হয়। (গণতন্ত্রের কী অনুকরণীয় উদাহরণ, আমাদের মত দেশে ভাবনার অতীত)। বরিস জনসনের বিরুদ্ধে দলের অভ্যন্তরে অসন্তোষ ও বিরোধ প্রবল হয়ে উঠলো। তাদের অনেকে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের আগেই প্রধানমন্ত্রী জনসনের পদত্যাগ দাবি করেন। তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর এই দাবি জোরালো আকার ধারণ করে। তারা বললেন, এনাফ ইজ এনাফ, নেতৃত্ব বদলের প্রয়োজন, কেননা দলের আগামী দিনের জন্যে তার (জনসন) উপর কিছুতেই ভরসা করা যায় না। তারা জনসনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে চাইলেন। শুরু হলো বিদ্রোহীদের এক করা। দলে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে হলে দলটির ১৫% শতাংশ আইনপ্রণেতার সমর্থন প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় সংখ্যকের চাইতেও বেশি সদস্য তাদের পক্ষে ছিল। অতএব, গোপন ভোট। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, যতই অনাস্থা ভোট হোক না কেন, বরিস জনসন টিকে যাবেন। তবে অনাস্থা ভোটে তার বিরুদ্ধে এতো ভোট পড়বে তা কেউ ভাবতে পারেননি। বৃটিশ পার্লামেন্টে বর্তমান সরকারি টোরি দলে এম পি–র সংখ্যা ৩৫৯ জন। এদের মধ্যে বরিস জনসনের বিপক্ষে ভোট পড়েছে ১৪৮ এবং পক্ষে ২১১। ফলে এ যাত্রায় তিনি বেঁচে গেলেন। তবে বৃটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি হলেন প্রথম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা সরকার–প্রধান যিনি দেশের আইন ভঙ্গ করেছেন এবং তার জন্যে জরিমানা পেয়েছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, বর্তমানে বৃটিশ পার্লামেন্টে বিরোধী দল, লেবার পাটির্র আসন রয়েছে ১৯৯, লিবারেল ডেমোক্রেটের ১৩, স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি ৪৫, সিন্ ফেইন ৭, নিরপেক্ষ ৭, সোশ্যাল ডেমোক্রাট ও লেবার পার্টি ২, আলবা পার্টি ২, গ্রিন পার্টি ১, এলায়েন্স ১, এবং ২টি শূন্য।
রাণী এলিজাবেথের প্লাটিনাম জুবিলী (সিংহাসনে ৭০ বছর) উপলক্ষে গোটা বৃটেনে যখন প্রায় সপ্তাহব্যাপী উৎসব চলছে তখন গেল সোমবার অনুষ্ঠিত হলো এই অনাস্থা ভোট। ভোট গণনা শেষে টোরি দলের ‘১৯২২ কমিটি‘ চেয়ারম্যান, স্যার গ্রাহাম ব্রাডি এই বলে ঘোষণা দেন, ‘আমি ঘোষণা করছি যে, প্রধান মন্ত্রীর উপর পার্লামেন্টারি পার্টির আস্থা রয়েছে।‘ অনাস্থা ভোটে জয়ী হয়ে প্রধান মন্ত্রী বরিস জনসন এই জয়কে ‘নির্ধারক‘ বা ‘ডিসাইসিভ‘ উল্লেখ করে বলেন, ‘এটি একটি অত্যন্ত ভালো এবং কনভিন্সিং ফলাফল এবং মিডিয়া যে সমস্ত বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে, তা পিছু রেখে আমাদের সামনে এগিয়ে যাবার সুযোগ এখন।‘
এখানেও দেখা মেলে ট্রাম্পের সাথে তার দৃষ্টিভঙ্গির অদ্ভুদ মিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প মিডিয়াকে দেশের, জনগণের শত্রু বলে আখ্যায়িত করতে দ্বিধাবোধ করেননি, একবার নয় বহুবার। এই ফলাফল বরিস জনসনকে ক্ষমতা থেকে সরানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও দলের অভ্যন্তরে যে তার কতৃর্ত্ব দুর্বল হয়ে পড়েছে তা বলা বাহুল্য। ফলাফল তার পক্ষে গেলেও দলের অনেক আইনপ্রণেতা নতুন করে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন। তবে সে দাবিতে যে তিনি কর্ণপাত করবেন না সে নিশ্চিত। বরিস জনসনের চরিত্র বা ‘জিনে‘ তা নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা চাই। শৈশব থেকেই তিনি ক্ষমতার শীর্ষে উঠতে চেয়েছেন। তার ৮ বছর বয়সে তিনি ভবিষ্যতে কী হতে চান জানতে চাইলে উত্তরে বলেছিলেন, ‘ওয়ার্ল্ড লীডার‘ বা বিশ্ব নেতা। দশ বছর বয়সে একই প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে ‘বৃটেনের প্রধান মন্ত্রী হতে চান‘ বলে জানিয়েছিলেন। প্রধান মন্ত্রী হবার আগে ২০০৮–২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের মেয়র ছিলেন এবং বেশ সফল ও জনপ্রিয় ছিলেন। ২০১৬ সালের ১৩ জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ৯ জুলাই পর্যন্ত ছিলেন দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী। বরিস জনসন প্রধান মন্ত্রী হন ২০১৯ সালে। এর আগে বৃটেনে যিনি অনাস্থা ভোটের সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি হলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। তিনি সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে দলের ৩৭% এম পি ভোট দিয়েছিলেন। তারপরও তিনি ভোটের ছয় মাসের মাথায়, ব্রেক্সিট বিতর্ককে ঘিরে পদত্যাগ করেন। বরিস জনসনের বিরুদ্ধে ৪১% এম পি ভোট দিলেও তিনি যে পদত্যাগ করবেন না সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় এবং সে–কথা আগেই বলেছি। দলের নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের মধ্যে ৪১% তার উপর অনাস্থা জানা সত্ত্বেও তিনি বললেন, ‘অবাক করা জয় হয়েছে‘। এখন প্রশ্ন হলো, এর পরও তিনি কীভাবে টিকে যাবেন। তার কারণ একটিই –নেতৃত্ব দেবার মত দলে তার কোন জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তদুপুরি ইউক্রেনকে ঘিরে ইউরোপের বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে কেউ চাননা এই সময় দলে বাড়তি কোন সমস্যা দেখা দিক, তাতে দেশের সমস্যা হবে, ভোটব্যাংকও ভালো দৃষ্টিতে দেখবে না। গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন বিপদের মুখে, সে লক্ষ্যে সবাইকে এক হয়ে কাজ করে যেতে হবে।
তবে দলে একজন ছিলেন যার সম্ভাবনা ছিল বরিস জনসনের স্থান দখল করার। তিনি হলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাগরিক, অর্থ মন্ত্রী ঋষি সুনক। ‘পার্টিগেইট কেলেঙ্কারির‘ পর সে সম্ভাবনা আর নেই। এই পার্টিতে যোগ দেবার কারণে যে ৮৩ জন জরিমানা পেয়েছেন তাদের মধ্যে ঋষিও রয়েছেন। তদুপুরি তার স্ত্রীর ট্যাক্স–কেলেঙ্কারির কারণে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটের বাসিন্দা হবার স্বপ্ন একেবারে ভেঙে গেছে। এর বাইরে রয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী লিজ ট্রাস, তিনি একজন সম্ভাব্য প্রতিযোগী। সরকারের বাইরে থেকে রয়েছেন প্রাক্তন স্বাস্থ্য মন্ত্রী জেরিমি হান্ট, যিনি টোরি দলের নেতৃত্বের লড়াইয়ে বরিস জনসনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। সোমবারের অনাস্থা ভোটে জেরিমি হান্ট বরিস জনসনের বিরুদ্ধে ভোট দেবার জন্যে প্রচারণা চালিয়েছিলেন প্রকাশ্যে। আর এ কারণে তার বিরুদ্ধে জনৈক মন্ত্রী ‘ডুপ্লিসিটি‘ বা দ্বৈততার‘ অভিযোগ আনেন। উচ্চাভিলাষী যারাই দলীয় প্রধানের জন্যে লড়াই করার চিন্তা ভাবনা করছেন, তারা খুব ভালো করেই জানেন যে ২০১৯ সালের নির্বাচনে বরিস জনসন যেভাবে দলের জন্যে জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন, দলকে এক করেছিলেন, সে ক্ষমতা তাদের কারো নেই। জনসনের আর একটি দক্ষতা হলো, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচার ও থেরেসা মে‘র সাথে মতদ্বৈতার কারণে সে সময় বেশ কয়েক মন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। ফলে তারা বেকায়দায় পড়েছিলেন। কিন্তু বরিস জনসনের ‘ম্যাজিক‘ ক্ষমতার কারণে তার কোনো মন্ত্রী তাকে ছেড়ে যাননি। দলের ভেতরে তার বিরুদ্ধাচরণ হলেও, এমন কী দলীয় আইনপ্রণেতাদের প্রায় ৪১% ভাগ তার কাছ থেকে সরে গেলেও, মন্ত্রী পরিষদের কেউ তার বিপদের দিনে তাকে ছেড়ে যাননি। তাই সরকার পরিচালনায় তার কোন সমস্যা হয়নি।
তবে বরিস জনসন যে এখন নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারছেন তা ভাবার কোন কারণ নেই। সামনে তার জন্যে অপেক্ষা করছে কঠিন পরীক্ষা। বিদ্যুৎ বিল বাড়ছে, বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংকে সুদের হার বাড়ছে এবং সরকার ট্যাক্স বাড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে জনগণের সমর্থন হারাচ্ছেন এবং টোরি দলকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। গত মে মাসে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনে তার দল চরমভাবে হেরেছে। আগামী ২৩ জুন তার জন্যে অপেক্ষা করছে আর একটি চরম পরীক্ষা। সেদিন টোরি–দলের আয়ত্তে থাকা দুটি এলাকায় পার্লামেন্টারী উপ–নির্বাচন। এই দুটি উপ–নির্বাচনের ফলাফলের উপর অনেকটা নির্ভর করছে আগামীতে তিনি দলনেতা হিসাবে আদৌ থাকতে পারবেন কিনা তা দেখার। দেখা যাক কী ঘটে। আমরা সেদিনের অপেক্ষায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট