হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২১ মে, ২০২২ at ৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ

ফিনল্যান্ড ও সুইডেন পশ্চিমা সামরিক জোট ‘ন্যাটোয়’ যোগ দেবার জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের আবেদন জমা দিয়েছে। তাদের এই পদক্ষেপে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত। এই সংবাদ প্রকাশের সাথে সাথে তিনি বলেন, এর ফলাফল ভালো হবে না এবং তিনি ন্যাটোর বিরুদ্ধে পাল্টা-পদক্ষেপ নেবার হুমকি দিয়েছেন। এমনতর হুমকি তিনি এর আগেও দিয়েছেন, যখন অতি উন্নত এই দুটি ইউরোপীয় দেশ ন্যাটোয় যোগ দেবার কথা সিরিয়াসলি চিন্তা ভাবনা করছিল, বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর। রাশিয়ার ইউক্রেন-আগ্রাসনকে ঘিরে বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এক অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে চলেছে। যুদ্ধবাজ পুতিনকে কিছুতেই তার ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ’ খেলা থেকে থামানো যাচ্ছে না। এই অসম-যুদ্ধ যে কেবল ইউক্রেন কিংবা ইউরোপকে সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা নয়। এই যুদ্ধ আফ্রিকা সহ গোটা বিশ্বে খাদ্য সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে। ইউক্রেনের শস্যভাণ্ডারে পড়ে আছে হাজার হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। রুশ বাহিনী ৩০০টি খাদ্যশস্য পরিবহন জাহাজকে কৃষ্ণ সাগর থেকে রওনা হতে বাধা দিয়ে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য রুটগুলি কার্যতঃ অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এমন যখন পরিস্থিতি তখন ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোয় যোগ দেবার আবেদন বর্তমান পরিস্থিতিকে যে আরো ঘোলাটে ও উত্তেজনাকর করে তুলবে তাতে সন্দেহ নেই। প্রশ্ন- প্রায় দুই শত বছর নিরপেক্ষ থাকার পর সুইডেন কেন পশ্চিমা নিরাপত্তা বলয়ে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলো। কেন সুইডেনও ফিনল্যান্ডের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ন্যাটোয় ঢুকতে চাইছে। সে কারণ জানার জন্যে একটুখানি পেছন ফিরে তাকানো দরকার।
দুই. রাশিয়ার সাথে ফিনল্যান্ডের রয়েছে ১৩০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সীমান্ত। শতাধিক বছর মস্কোর শাসনাধীন থাকার পর ১৯১৭ সালে ফিনল্যান্ড স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত বাহিনীর সাথে দুইবার যুদ্ধ করে। তাতে দেশটি রাশিয়ার কাছে তার ১০% এলাকা হারায়। যদি ফিনল্যান্ড ন্যাটোয় যোগ দেয় তবে এটি রাশিয়ার সাথে এই আটলান্টিক জোটের (ন্যাটো) বর্তমান সীমান্তের দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ করবে এবং ন্যাটোর অবস্থান রাশিয়ার প্রায় দোর-গোড়ায় পৌঁছে যাবে। তখন রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী, সেইন্ট পিটার্সবুর্গ ও ফিনল্যান্ড বর্ডাররের দূরত্ব হবে মাত্র ১৭০ কিলোমিটার। সেখানেই রাশিয়া ও পুতিনের ভয়। তিনি ইতিমধ্যে ফিনিশ প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তোকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘ন্যাটোয় যোগ দেয়াটা হবে ভুল। এতে দু-দেশের সম্পর্ক নষ্ট হবে।’ যদি এমনটি হয় তাহলে রাশিয়া ফিনল্যান্ডের বিরুদ্ধে ‘সামরিক’ ও ‘প্রযুক্তিগত’ ব্যবস্থা বলে তিনি হুমকি দেন। অন্যদিকে ফিনিশ প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা ইচ্ছে করে ন্যাটোয় যোগ দিচ্ছি না। ইউক্রেন আক্রমনের মধ্যে দিয়ে তুমি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছ এবং আমাদের বাধ্য করেছ এই পদক্ষেপ নিতে, দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে এবং বিশ্ব শান্তির স্বার্থে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ফিনল্যান্ড কখনোই ন্যাটোয় যোগ দিতে চায়নি। গত জানুয়ারী (রাশিয়া আগ্রাসনের প্রাক্কালে) ফিনিশ প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন বলেন, ‘তার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ফিনল্যান্ডের ন্যাটোয় যোগ দেবার সম্ভাবনা খুব কম।’ এই ঘোষণার ঠিক এক মাসের মাথায় দেশটির প্রধান মন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট উভয়েই ঘোষণা দিলেন, তাদের পক্ষে ন্যাটোয় যোগ দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। পুতিন তাদের বাধ্য করেছেন তার আগ্রাসী কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে। পশ্চিমা সামরিক ঐক্যশক্তির বাইরে থাকলেও ফিনল্যান্ড ও সুইডেন- এই দুটি দেশ ন্যাটোর ঘনিষ্ট পার্টনার। ইউক্রেন আক্রমণের পর ন্যাটোর সাথে তারা তথ্য আদান-প্রদান বাড়িয়ে দেয় এবং যুদ্ধ বিষয়ে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর প্রতিটি মিটিংয়ে অংশ নেয়। ইতিমধ্যে ন্যাটোর গাইডলাইন অনুযারী ফিনল্যান্ড তার বাৎসরিক সামরিক ব্যয় দেশের জিডিপির ২% শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। লক্ষ্য সামরিক শক্তিকে আরো সুদৃঢ় করা এবং রুশ-আগ্রাসনকে ঠেকানো।
তিন. অন্যদিকে ফিনল্যান্ড ন্যাটোয় যোগ দেবার ঘোষণা দেবার পরপর প্রতিবেশী নর্ডিক রাষ্ট্র, সুইডেন ঘোষণা দেয়, তারাও ন্যাটোর সদস্যপদের জন্যে আবেদন করবে। তেমনটি যদি হয়, তাহলে তা হবে ২০০ বছরের পর এই দেশটির সামরিক নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ানো। সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী মাগডালেনা এন্ডারসন বলেন, সুইডেন চায় ফর্মাল নিরাপত্তার গ্যারান্টি, যা সম্ভব ন্যাটোয় যোগদানের মধ্যে দিয়ে। সুইস পার্লামেন্টে বিতর্ক শেষে তিনি এই ঘোষণা দেন। দেশের আটটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কেবল বাম-ঘেঁষা দুটি ক্ষুদ্র দল এর বিরোধিতা করে। উল্লেখ্য, রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের আগে এ দেশের জনগণ ন্যাটোয় যোগদানের বিপক্ষে ছিলেন, কিন্তু তাদের মতামতের পরিবর্তন ঘটে ইউক্রেন-আক্রমনের পর। একই দশা ফিনল্যান্ডেও। এক সময়কার সামরিক শক্তি, সুইডেন নেপোলিয়ান যুদ্ধের পর থেকে সামরিক ঐক্য এড়িয়ে গেছে। ফিনল্যান্ডের মত সুইডেনও ‘কোল্ড ওয়ার’ এর সময় নিরপেক্ষ থেকেছে, কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতন হলে, সুইডেন ন্যাটোর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলে, যদিও বা তাতে সদস্য হিসাবে যোগ দেয়নি। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর পরই সুইডেন ন্যাটোয় যোগ দেবার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলির সাথে জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা চালিয়ে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, জার্মানি সহ ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেয়। বরাবরের মত রুশ প্রেসিডেন্ট সুইডেনের এই ধরণের পদক্ষেপ ‘ইউরোপের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে’ বলে সতর্ক করে দেন। পুতিনের মতে রাশিয়াকে কোনঠাসা ও দুর্বল করার জন্যে এই সমস্ত আমেরিকার পদক্ষেপ।
চার. ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে ভৌগোলিক অবস্থানে থাকা মুসলিম রাষ্ট্র, তুরস্ক ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোয় যোগদানের বিরোধিতা করবে বলে দেশটির শাসক এরদোগান জানিয়েছেন। পুতিনের ‘কাছের লোক’ হিসাবে পরিচিত তুরুস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, এই দেশ দুটি তাদের দেশে সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিয়েছে এবং সে কারণে তুরস্ক তাদের সদস্যপদের বিরোধিতা করবে। ‘সন্ত্রাসী’ বলতে এরদোগান যাদের বুঝাতে চাইছেন তারা হলো তুরস্কের সংখ্যালঘু কুর্দি সমপ্রদায়। তুরস্ক থেকে পৃথক হওয়ার দাবিতে এবং স্বায়ত্বশাসন সহ অধিকতর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্যে কুর্দীরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের আন্দোলন চালিয়ে আসছে। কুর্দি আন্দোলনকে থামিয়ে দেবার জন্যে এই জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়ে আসছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান সরকার। ফলে লক্ষ লক্ষ তুর্কি দেশছাড়া হয়ে ইউরোপের নানা দেশে আশ্রয় নিয়েছে। ফিনল্যান্ড, সুইডেন, জার্মানি, হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড সহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং সেখানে তারা (কুর্দি) তাদের স্বাধিকার ও পৃথক ভূমির জন্যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলি তুরস্কের এই আচরণের সমালোচনা ও নিন্দা জানালেও এরদোগান তার নিপীড়নমূলক আচরণ থেকে বিরত হননি।
প্রশ্ন : তুরস্কের আপত্তি বা ‘ভিটো’ কি ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটো-সদস্যপদ পাওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে? উত্তরে বলা যায়, হ্যাঁ, সে সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা ৩০টি সদস্য দেশের কোন একটি দেশ যদি ‘ভিটো’ দেয়, তাহলে সেই দেশ ন্যাটো-সদস্যপদ লাভ করতে সক্ষম হবে না। তবে ইতিমধ্যে একমাত্র তুরস্ক ছাড়া ন্যাটোর বাকি দেশগুলি ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে স্বাগত জানিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তুরস্ক এই ক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধা করতে পারবেনা। তবে, এই সুযোগে সদস্যপ্রার্থী দুটি দেশের কাছ থেকে কিছু ‘ছাড়’ বাগিয়ে নিয়ে চাইবেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। কেননা দেশ দুটিরও প্রয়োজন তুর্কির ‘গ্রীন স্যিগনাল’। ইতিমধ্যে, তারা রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন বলে আজকের সংবাদে জানা যায়।
শেষকথা, যদি ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটো সদস্যপদ লাভ করে, তাহলে তা হবে রাশিয়া ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য ‘নাইটমেয়ার’ বা ‘দুঃস্বপ্ন’। তবে এটি ঠিক যে পুতিনের মত উচ্চাভিলাষী স্বৈরাচারেরা পরদেশ দখল করার আগে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখবেন। পুতিন ইতিমধ্যে বার কয়েক ‘হেন্‌ করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা’ বলে বেশ লম্ফ-ঝম্প করেছেন। এখন দেখার বিষয় তিনি আদৌ তা কার্যকর করার সাহস রাখেন কিনা। কেননা দিন কয়েকের মধ্যে ইউক্রেন-যুদ্ধ শেষ করার তার যে উচ্চাভিলাষ, তা ইউক্রেনবাসীর সাহসিকতা ও আমেরিকা সহ গোটা পশ্চিম বিশ্ব এককাট্টা হওয়াতে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। এই যুদ্ধ ইতিমধ্যে তিন মাসে গড়িয়েছে। যুদ্ধের আগে তিনি দাবি করেছিলেন, ইউক্রেনবাসী রুশ ট্যাংক ও রুশ সেনাবাহিনীকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানাবেন। তার হিসাবে ছিল ভুল, ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি। সে ভুল থেকে তিনি হয়তো শিক্ষা নেবেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূষণ গ্রামকেও গ্রাস করছে!
পরবর্তী নিবন্ধসিপিবি চট্টগ্রাম জেলা কমিটির বর্ধিত সভা