হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

প্রবাসীদের সাথে খোলামেলা আলাপচারিতায় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. মোমেন

উত্তর সাগর পাড়ের ছোট্ট একটি দেশ, হল্যান্ড। তারি মাঝে এক চিলতে বাংলাদেশ, সেখানে দাঁড়িয়ে যেন পরম অহংকারে ‘বাংলাদেশ হাউজ’। প্রথম দর্শনেই ভালো লাগা। চারিধার গাছ-গাছালিতে ঢাকা, শহরের কোলাহল নেই, নেই গাড়ির প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বাজানো হর্ন। লোকজনও খুব একটা চোখে পড়েনা। এই এক-চিলতে ‘বাংলাদেশ’ ঘুরে-ঘুরে দেখালেন দেশ থেকে আসা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. আবদুল মোমেনকে। ব্যাখ্যা দিয়ে চলেন রিয়াজ হামিদউল্লাহ, হল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। গেইট পেরিয়ে তার চমৎকার বাংলো-প্যাটার্নের বাড়ী। ঢুকতেই ডানদিকে গাড়ী রাখার শেড, বাঁদিকে গাড়ি-বারান্দা পেরিয়ে বড় আকারের দুটি ড্রয়িং রুম, তার লাগোয়া পৃথক স্পেস, তাতে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্যে সাজানো ডাইনিং টেবিল। ভেতরটার এদিক-ওদিক নানা শো-পিচ্‌, পেইন্টিং, ফটো, তাতে বাড়ির মালিকের নান্দনিক ও শৈল্পিক রুচির পরিচয় মেলে। ড্রয়িংরুম ফেলে পেছনের খোলামেলা স্থানটিতে এলে মন আপনাতেই জুড়ে যায়। একদিকে ছোট সুইমিং পুল জাতীয় জলাধার, চারধারে বড়-বড় নাম না-জানা গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, যেন বাইরের দৃষ্টি থেকে আড়ালে রেখে চলেছে বাড়িটিকে, বাড়ির বাসিন্দাদের। এই নিয়ে আমার বার দুয়েক যাওয়া। প্রথমবার গেল বছর। সেবার বেশ কিছু বাংলাদেশী আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলেন। এবার হাতেগোনা, জনা বার, হল্যান্ডে এনার্জী, সোশ্যাল ফিল্ড, বিজনেস ইত্যাদি বিভিন্ন সেক্টরে যারা রাষ্ট্রদূতের ভাষায় ‘ভালো’ করছেন তারা। পেছনের খোলা মাঠে এর-ওর সাথে চলে ‘খেজুরে’ আলাপ। তখনও পররাষ্ট্র মন্ত্রী এসে পৌঁছাননি। রাষ্ট্রদূত সবার সাথে আলাপে মেতে, এমন সময় এলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী। সাথে ঢাকা থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং হল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। তাদের মধ্যে একজন, দেখতে সুদর্শন, স্মার্ট একটা সময় কাছে এসে বলেন, ‘চিনতে পেরেছেন? আমি আন্দালিব। আপনার সাথে বার-কয়েক দেখা হয়েছে আমাদের দূতাবাসে। রাষ্ট্রদূত ইসমত জাহানের সময় এবং তার আগেও।’ দেখে মনে হলো চেনা-মুখ। বিজনেস কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘বেলজিয়াম বাংলাদেশ এম্বেসীতে ছিলাম।’ তখন মনে পড়লো তার সাথে বার কয়েক দেখা হয়েছে। এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডিরেক্টর জেনারেল হিসাবে কাজ করছেন। পরিচয়ের পালা। পররাষ্ট্র মন্ত্রী এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। রাষ্ট্রদূত সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কাছে আসতেই হাত বাড়িয়ে বলি, ‘আপনার সাথে এর আগে বার-দুয়েক ভার্চুয়াল মিটিংয়ে দেখা ও আলাপ হয়েছে, তার একটি আমার সঞ্চালনা করার সুযোগ হয়েছিল। ‘আসলে এত ভার্চুয়াল মিটিং হয় যে সব সময় মনে থাকেনা, উত্তরে বললেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী।
পরিচয় ও আনুষ্ঠানিক ছবি-তোলা পর্ব শেষে আমাদের পিছু রেখে রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদউল্লাহ পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও তার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যান সামনের দিকে। এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখান। পরে খাবার টেবিলে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে জম্পেশ আড্ডায় রাষ্ট্রদূত বলেন, তিনিই এই বাড়ির প্রথম বাসিন্দা এবং এটি বাংলাদেশের নিজস্ব ভবন, অর্থাৎ কেনা বাড়ি। ঘণ্টা দেড়েক পর ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যাই আমরা সবাই। সবার জন্যে নির্দিষ্ট আসন। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ডান পাশে রাষ্ট্রদূত, বাঁয়ে ঢাকা থেকে আসা এক সরকারি উচ্চ কর্মকর্তা, আজাদ সাহেব। মন্ত্রী পত্নীর বামদিকের আসনে রাষ্ট্রদূত পত্নী, ডানদিকে আমি। আমার ডানপাশে টেঙটাইল ব্যবসায়ী জসিমউদ্দিন লিটন। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে দেশ-বিদেশের নানা বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলাপ চলে, কখনো হাসি-তামাশা, কৌতুকও। নিজের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া, মন্ত্রী হওয়া, কেন অনেক বছর নিজ দেশে ফিরতে পারেননি, কূটনৈতিকদের পেশাগত দুর্বলতার কথা ইত্যাদি বিষয় তিনি কোন রাখঢাক না রেখে ওই সন্ধ্যায় বলে চলেন। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ শুরু হওয়া এই ডিনার-টেবিলে আড্ডা চলে রাত সাড়ে দশটা তক। পররাষ্ট্র মন্ত্রী কথা বলতে ও শুনতে ভালোবাসেন। বোধকরি শিক্ষক ছিলেন সেটিও একটি কারণ হতে পারে বলে ধারণা। হল্যান্ডে ক’দিন ধরে তার ছিল যা রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদউল্লাহর ভাষায় ‘whirlwind visit’ ঘূর্ণিঝড়-সফর, কিন্তু তাকে এতটুকু ক্লান্ত মনে হয়নি এই বয়সেও। তিনি যে আমাদের সাথে কাটানো-সময় উপভোগ করছিলেন তা টের পাচ্ছিলাম। এই আলাপচারিতা হয়তো আরো দীর্ঘস্থায়ী হতো যদি তার পাশে বসা আজাদ সাহেব তাকে ‘উঠার’ জন্যে মনে করিয়ে না দিতেন। মনে পড়ে, সাংবাদিকতা করাকালীন একবার কঙবাজার বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের সাথে সন্ধ্যা সাতটা থেকে শুরু হয়ে রাত বারটা অবধি পর্যটনের মটেলে এমন এক আড্ডায় নানা বিষয় নিয়ে খোলামেলা ভাব-বিনিময় হয়েছিল। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা থেকে নির্বাচিত ২১ জন সিনিয়র রিপোর্টারকে নিয়ে সাথে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ঢাকা থেকে একই প্লেনে গিয়েছিলেন। তখন খুব সম্ভবত ওই দলে আমি ছিলাম অভিজ্ঞতা ও বয়সে সবার চাইতে কম। ফিরে আসি বাংলাদেশ হাউজে।
কোথা থেকে শুরু করবো ভাবছি, কেননা পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেন বিষয় নেই যা নিয়ে কিছু না কিছু বলেননি। উপস্থিত বাংলাদেশীদের উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্যে বাংলাদেশী ডায়াসপোরা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের জ্ঞান, দক্ষতা, আইডিয়া আমাদের দরকার। আমরা এখন আর ভিখারির দেশ না। বাংলাদেশের দুটি সম্পদ- মানব ও পানি। এই দুটি সম্পদকে যদি আমরা যথার্থভাবে কাজে লাগাতে পারি তাহলে বাংলাদেশকে কেউ থামাতে পারবে না।” তিনি আরো বলেন, “আমরা দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারিনি, কিন্তু তারপরও তারা দেশে ২৫ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছে। পন্ডিতেরা বলেছিলেন কোভিডের কারণে এই আয় কমে ৭/৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে, কিন্তু উল্টো হয়েছে।” উপস্থিত একজন এই সময় যখন বললেন, সরকারের দেয়া ২% প্রণোদনার কারণে এটি হয়েছে, তখন তিনি সাথে সাথে সে দাবি খন্ডন করে বলেন, “সে সব কিছু না। সরকার যদিওবা এই নিয়ে বাহবা নেয়, আসলে তার (সরকার) কোন কৃতিত্ব নেই এখানে। যাদের বিদেশে অনেক টাকা আছে তাদের মধ্যে থেকে যারা পাঠাচ্ছে তারা এই দু-পার্সেন্ট বেনিফিট পাচ্ছে। গরিব শ্রমিক পাঠায়, হয়তো তার মা-বাবা বলছে কোভিডের জন্যে আমাদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, কাজ নাই, তখন ছেলে কিংবা ভাতিজা আগে যেখানে ১০০ রিয়েল পাঠাতো, ধার করে হোক বা সংগ্রহ করে হোক ২০০ রিয়েল পাঠাচ্ছে। দিজ ইজ দ্য মেজর রিজন হোয়াই রেমিট্যান্স ভলিউম ইন্‌ক্িরস্‌ড।” এই প্রসঙ্গে এক শ্রেণীর দালাদের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এরা কল-কারখানার গেইটে গিয়ে রিয়েল নিয়ে অপেক্ষা করে। শ্রমিকরা দেশে টাকা পাঠাবে। এই সমস্ত দালালদের রিয়েল দেয়, ওরা তৎক্ষণাৎ দেশে ‘বিকাশের’ (পাঠক আমি না, মানী ট্রান্সফার) মাধ্যমে টাকা পৌঁছে দেয়। আদমব্যাপারী প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, ”সব আদমব্যাপারী খারাপ না। কিন্তু কিছু কিছু আদমব্যাপারী আছে যারা সৌদির (নাগরিক) কাছে গিয়ে বলে, ‘তুমি আমাকে ১০টা চাকরী দাও, আমি তোমাকে টাকা দেব।’ তখন হয়তো সেই সৌদি বললেন, ‘আমার তো চাকরি নাই, দেব কোথা থেকে?’ তখন আদমব্যাপারী বলে, কোন সমস্যা নাই, তুমি শুধু ‘কাগজ’ দাও। তাতেই তুমি টাকা পাবে।’ সেই ‘কাগজ’ দেশে পাঠিয়ে আদমব্যাপারী দুই থেকে চার লক্ষ টাকায় বিক্রি করে, অথচ তার ওই ‘কাগজ’ কিনতে খরচ হয় ৩০০০ রিয়েল বা ৬০ হাজার টাকা।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রী যখন বিশাল অংকের রেমিটেন্সের কথা বললেন তখন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করি এই বলে, ‘রেমিট্যান্স আসছে সেটি ভালো, কিন্তু বিপুল পরিমাণ রিজার্ভ অলস পড়ে আছে, বিনিয়োগ তো হচ্ছে না, অর্থনীতির জন্যে এটি তো সুস্থ লক্ষণ নয়’। পররাষ্ট্র মন্ত্রী তার সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘সৌদি আরবের কোন রিজার্ভ নাই। তাদের যে টাকা আছে সব আমেরিকায় বন্ডে ইনভেস্ট করে রাখে। বাংলাদেশের মত গরিব দেশের রিজার্ভ দরকার। আমাদের আগে এল সি করতে হয়, তারপর ওরা মাল দেবে। ওরা হয়তো ভাবে, গরিব দেশ, যদি পরে টাকা দিতে না পারে।’ উপস্থিত বাংলাদেশী ব্যবসায়ী, ড. নাহিদ হাসান বলেন, ‘এল সি-বেইসড বিজনেস আমাদের জন্যে অভিশাপ। আমরা যদি গ্রেজুয়েট হই তাহলে বিনিয়োগ করতে হবে। তবে এটিও সত্য যে বাংলাদেশী ক্রেতারা ধীরে ধীরে ক্ষমতায়িত হচ্ছে।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের যে বিষয়টি আমার ভালো লাগে তা হলো তার সহজ-সরল বক্তব্য, এক ধরণের শিশু সারল্য খুঁজে পাই। তার নেই কৃত্রিম গাম্ভীর্য। যা মনে এসেছে ওই মুহূর্তে কোন দ্বিধা মনে না রেখে অকপটে বলে গেছেন। রাজনীতিবিদ বা কূটনীতিবিদ বলতে সাধারণ অর্থে আমরা যা বুঝি বা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে তার চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগেই উল্লেখ করেছি, অনেকদিন শিক্ষকতা করেছেন, হয়তো তার প্রভাব তার স্বভাবে, চরিত্রে পড়ে থাকবে। তিনি একাধারে অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ। জাতিসংঘে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল অবধি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন স্থায়ী প্রতিনিধি হিসাবে। সিলেট-১ আসন থেকে ২০১৮ সালে নির্বাচন করে এম পি নির্বাচিত হন, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ পান এই সাদামাটা এই বিজ্ঞ ব্যক্তিটি। জাতিসংঘে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা, দেশে ফিরে নির্বাচন করা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী হওয়া- সব কিছুর পেছনে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অবদান। সে প্রসঙ্গে লিখবো পরবর্তী সংখ্যায়। লিখবো কেন তিনি ১৯৭৮ এর পর বাংলাদেশে ফিরতে পারেননি সে কথাও।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাসপাতাল চাই, তবে পরিবেশ বিপন্ন করে নয়
পরবর্তী নিবন্ধবিনিয়োগবান্ধব নীতির কারণেই রপ্তানিতে বিস্ময়কর ভিয়েতনাম