হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৩ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

পাকিস্তান : যে দেশে গণতন্ত্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে

জন্মলগ্ন থেকেই ধর্মীয় মৌলবাদ ও সামরিক শাসন পাকিস্তানের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। দেশ ভাগের আগে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কখনোই পাকিস্তানকে একটি আদর্শিক বা আইডিওলজিক্যাল রাষ্ট্র হিসাবে সৃষ্টি করার কথা বলেননি। তবে ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হবার পরপর তার উত্তরসূরিরা যে ‘পাকিস্তানী মতাদর্শ’ তৈরি করেন তার ভিত্তি ছিল -ইসলাম, ভারতের প্রতি বৈরিতা ও উর্দু ভাষা। এই তিনটি বিষয় পাকিস্তানের নুতন ‘জাতীয় আদর্শের’ মূল উপাদান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। জিন্নাহ ছিলেন আগাগোড়া ‘পশ্চিমা-শিক্ষিত’ এবং ‘নন-প্র্যাকটিসিং’ মুসলিম। যদিও বা তিনি মুসলিম জনগণকে এক করার জন্যে সহজ হাতিয়ার হিসাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন। প্রশ্ন আসছে জন্মলগ্ন থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায়, এমন কী পররাষ্ট্র নীতিতে দেশের সামরিক শক্তি কী করে এমন শক্ত অবস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম হলো। এর পেছনে অনেকের মতে, প্রথম কারণ কাশ্মীর এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা।

দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে কাশ্মীর-বিবাদকে ঘিরে ভারতের সাথে পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে উসকে দেয়। যার ফলে সদ্য স্বাধীন একটি দেশের অস্তিত্বের জন্যে একটি শক্তিশালী সামরিক প্রয়োজন দেখা যায় এবং দেশের প্রথম বাজেটের ৭০% ব্যয় ধরা হয় প্রতিরক্ষা খাতে। এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয় যাতে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী ধরে নেয় শত্রু-দেশ ভারতকে মোকাবেলা করতে হলে একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তির জরুরি। তারপর থেকে তো পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, সেনা শাসকরা একবার নয়, দুবার নয়, বারবার ক্ষমতায় এসেছেন অগণতান্ত্রিক ভাবে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের নলে উৎখাত করে। ক্ষমতায় না থাকলেও পেছন থেকে বরাবর কলকাঠি নেড়েছেন।

বিগত ৭৫ বছরে ভাগ্যাহত এই দেশটি ৫০ বছরের মত শাসিত হয়েছে দেশের মিলিটারি শাসক দ্বারা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে যারা বা যে সমস্ত রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছেন, মিলিটারি স্টাব্লিশমেন্টকে পাশ কাটিয়ে তারা ক্ষমতায় বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। যে কদিন ক্ষমতায় ছিলেন মিলিটারি স্টাব্লিশমেন্টের সাথে বোঝাপড়া করে তাদের ক্ষমতায় থাকতে হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকার হলেও দেশের প্রতিটি সামরিক, নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে মিলিটারি স্টাব্লিশমেন্টের পরামর্শ অনুযায়ী। মোদ্দাকথা, তাদের (মিলিটারি) কথাই ‘শেষ কথা’ বা ‘লাস্ট ওয়ার্ড’।

পাকিস্তানের ভাগ্য মন্দ। স্বাধীন দেশের প্রথম গভর্নর জেনারেল এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বছর না ঘুরতেই যহ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকাল মৃত্যুবরণ করার পর থেকে বলা চলে পাকিস্তানের গণতন্ত্র আর নিজ পায়ে শক্তভাবে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। পাকিস্তানের ‘শিশু-গণতন্ত্র’ সেই যে শুরুতেই ‘চোট’ পেল, তা আজ অবধি সারলো না। পাকিস্তান স্বাধীন হবার ৬ বছরের মাথায় তৎকালীন গভর্নর জেনারেল, গোলাম মুহাম্মদ সেনা প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানের সমর্থনে কেবল সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যুতই করলেন না, সাথে সাথে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদকে বাতিল ঘোষণা করলেন। এই কারণে যে ওই সংসদ গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা খর্ব করার পরিকল্পনা করছিল। বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে ক্ষমতায় এসে জনগণের আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা ত্যাগ করলেন। সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে সাহেবজাদা আলী ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। আইয়ুবের পতনের পর ক্ষমতায় এলেন আর এক সামরিক শাসক, জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি কেবল কঠোর হস্তে দেশ শাসন করলেন না, ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যা আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ, গণহত্যা করলেন। চিহ্নিত হলেন ‘খুনি ইয়াহিয়া’ হিসাবে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পশ্চিম পাকিস্তানে (পাকিস্তান) ক্ষমতায় এলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। অতি উচ্চাভিলাষী এই রাজনীতিবিদকে আর এক সেনাপ্রধান জেনারেল মোহাম্মদ জিয়াউল হক ১৯৭৭ সালে এক সেনা অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করলেন। কেবল যে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিলেন তা নয়, তাকে দুনীয়া থেকে সরিয়ে দিলেন ১৯৭৯ সালে ফাঁসি দিয়ে। জন্মলগ্ন থেকেই পাক সেনাবাহিনী পাকিস্তানের জনগণের মাঝে ‘ভারত-বিদ্বেষ’ প্রোথিত করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানের জনগণ এই বুঝেছিলেন যে তাদের একমাত্র শত্রু ভারত। হিন্দুস্থানকে হটিয়ে ‘ইসলামী ঝান্ডা’ পাকিস্তানে উড়াতে হবে, সে যে ভাবেই হোক না কেন। ফলে দেশের উন্নয়নে নিবিষ্ট হবার চাইতে তাদের তাবৎ শক্তি প্রয়োগ করা হয় পাকিস্তানের সামরিক শক্তিতে সমৃদ্ধ করা ও হিন্দুস্তানকে ঠেকানোর পেছনে। দেশে ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদ উঠলো মাথাচাড়া দিয়ে। পাশাপাশি সন্ত্রাস। আর এই উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদকে উস্কে দিলেন ক্ষমতায় এসে আর এক সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হক। পাকিস্তানের সংখ্যালঘু আহমদিয়া সমপ্রদায়ের বিরুদ্ধে তিনি দেশের বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে লেলিয়ে দিলেন। পাশাপাশি আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুজাহিদীনদের সকল প্রকার সাহায্য দেয়া শুরু করলেন। ভারতের সাথে পাল্লা দিয়ে পরমাণু প্রোগ্রাম শুরু করলেন। দুর্ভাগ্য তার, এক বিমান দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। এর ১০ বছর পর ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান পারমাণবিক পরীক্ষার বিস্ফোরণ ঘটায়।

দু-দফায় ক্ষমতায় এসেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি জুলফিকার আলী ভুট্টো তনয়া, বেনজির ভুট্টো। পাকিস্তানের প্রথম নারী প্রধান মন্ত্রী। জেনারেল জিয়াউল হক তাকে (বেনজির) কয়েক দফায় জেলে ভরেন এবং ১৯৮৪ সালে তিনি বৃটেনে ‘স্বেচ্ছা-নির্বাসনে’ চলে যান। বছর দুয়েকের মাথায় অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে এসে তার বাবার দল, পাকিস্তান পিপলস পার্টির হাল ধরেন। প্রধান মন্ত্রী হিসাবে বেনজির ভুট্টো দেশের রাজনীতিতে ‘সংস্কার’ আনতে চাইলে তিনি দেশের ইসলামী ও কনজারভেটিভ, পাশাপাশি অত্যন্ত ক্ষমতাশীল মিলিটারি ইস্টাব্লিশমেন্টের প্রচন্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এই বিরোধিতায় সামিল হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গুলাম ইসহাক খান। তার (বেনজির) বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনা হয় এবং গুলাম ইসহাক খান তাকে বরখাস্ত করেন। এলো নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ক্ষমতায় এলো রক্ষণশীল ইসলামিক ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স। তার পেছনেও সামরিক শক্তির হাত বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাস। বেনজির সংসদে আসন নিলেন বিরোধী বেঞ্চে। নওয়াজ শরীফ হলেন প্রধান মন্ত্রী। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মসনদের দিকে লোলুপ দৃষ্টি ছিল সেনাপতি জেনারেল মোশাররফের। প্রধান মন্ত্রী নওয়াজ শরীফ যখন চিন্তাভাবনা করছিলেন সেনা প্রধানের পদ থেকে জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে চাকুরিচ্যুত করবেন, ঠিক সেই মুহূর্তে সুযোগ বুঝে তিনি (জেনারেল মোশাররফ) নিজ দখলে নিলেন দেশের ক্ষমতা। জেনারেল মোশাররাফ যখন ক্ষমতায় তখন এক নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আত্মঘাতী বোমার আক্রমনে বেনজির ভুট্টো নিহত হন। তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ থেকে যায়, তবে ভুট্টোর সমর্থকদের সন্দেহের অঙ্‌গুলি জেনারেল মোশাররফের দিকে।

এখানেই সামরিক বাহিনীর ক্ষমতায় আরোহনের শেষ নয়। পাকিস্তানের ১০তম প্রেসিডেন্ট চার তারকা জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে ৭ বছর দেশ শাসন করার পর ২০০৮ সালে দেশ ছাড়তে হয় এবং ২০১৯ সালে তার অনুপস্থিতে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, যদিও বা সে রায়কে পরবর্তীতে লাহোর হাইকোর্ট বাতিল ঘোষণা করে। কেউ কেউ মনে করেছিলেন ইমরান খানের পদত্যাগকে ঘিরে সেনাবাহিনী হয়তো আবার পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসবে। যদিও বা সেনাবাহিনী থেকে এবার স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয় যে ‘এস্টাব্লিশমেন্টের’ অর্থাৎ সেনাবাহিনীর তেমন কোন পরিকল্পনা নেই। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষরা মনে করেন, ইমরান খানের ক্ষমতা থেকে বেরিয়ে যাবার পেছনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা এজেন্সি সমস্ত কলকাঠি নেড়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রাধান্য আগামীতে যে কমবে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। সামরিক এস্টাব্লিশমেন্টকে দেশের নিরাপত্তার জন্যে ‘অপরিহার্য্য’ করে তোলার লক্ষ্যে তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাথে বিরোধ, সংঘর্ষ জিইয়ে রেখেছে। কাশ্মীরকে ঘিরে সন্ত্রাসকে উস্কে দিয়েছে। নিজ দেশের সংখ্যালঘু বেলুচ জনগোষ্ঠীর উপর শাসন-শোষণ ছাড়াও তাদের আন্দোলনকে দমানোর জন্যে হত্যা, গুম, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে চলেছে, পাকিস্তানে বসবাসরত সংখ্যালঘু হিন্দু সমপ্রদায়ের উপর জোর করে ধর্মান্তর করা ছাড়াও নানা অত্যাচার ও নির্যাতন করে চলেছে। স্বাধিকার আন্দোলনরত বেলুচদের দাবি, পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় তাদের এলাকা অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে। যদিওবা প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল, কয়লা, তামা, সালফার ও স্বর্ণ সহ নানা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সব চাইতে বড় এবং সবচাইতে পিছিয়ে থাকা প্রদেশ। একাত্তরে আগে এমনটি ঘটেছিল সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর সাথে। আয়তন, জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদে পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে এগিয়ে থাকলেও ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাঙালিদের শাসন-শোষণ-নির্যাতন করেছিল। সে সময় তারা (পাকিস্তান সরকার) যে ভুল করেছিল, সেই ভুল থেকে পাকিস্তান যে এখনো শিক্ষা নেয়নি, সেটি বেলুচিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বুঝা যায়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, পাকিস্তানের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে সে দেশের জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে পাকিস্তান যে একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ বা ‘ফেইলড স্টেট’ তেমন ‘নেরেটিভকে’ সত্য বলে ধরে নিতে হবে।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিরোধী দল খোঁজাখুঁজি
পরবর্তী নিবন্ধআধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও শিল্পায়নের নবতর অধ্যায়