স্মরণ : রফিকুল আনোয়ার

মোস্তফা কামাল পাশা | সোমবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

মাত্র দেড়, দু’যুগ আগেও আওয়ামী লীগে নেতার চে’ কর্মীর সংখ্যা হাজারগুণ বেশি ছিলেন। এমনকী অনেক উদ্যমী নেতা নিজেদের কর্মী ভাবতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। সিনিয়র নেতার আহবান বা জরুরি তাগিদে নিজেরা যে কোন বিপদে আগেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বর্তমান রাজনীতির এলিট ধারায় এটা বিশ্বাস করাও কষ্ট। এখন সরকারি দলে কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি। বিষফলও উঠছে গোলায়। চকবাজার কাউন্সিলর উপ নির্বাচন, সামপ্রদায়িক উগ্রবাদীর দূর্গামন্ডপ ও হিন্দু পল্লীতে সহিংস হামলার অমোচনীয় দগদগে ক্ষত এর জ্বলন্ত প্রমাণ। সরকারি দলের কর্মীরা তৎক্ষণিক প্রতিরোধ ও পাহারায় থাকলে হিংসার আগুন শুরুতেই নিভানো সম্ভব হতো। জ্ঞান ও নীতি আদর্শ বিমুখ রাজনীতি এখন মূলধন ছাড়াই লাভজনক ব্যবসার মাধ্যম হয়ে গেছে।
বিদায়ী রাজনীতিক রফিকুল আনোয়ারেরা ছিলেন এর উল্টো ধারার যাত্রী। তিনি এমন একটি প্রিয় মুখ, যিনি বিপদে গণ মানুষের পাশে থেকেছেন সবসময়। কঠিন দুঃসময়ে ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগের মজবুত ভিত গড়ার সাহসী কাণ্ডারিও তিনি। ২৫ অক্টোবর তাঁর ৯ম প্রয়াণ বার্ষিকী। টানা দু’বারের নির্বাচিত এমপি রফিকুল আনোয়ার ২০১২ সালের এ’দিনে দলীয় কর্মী ও গণমানুষকে চোখের জলে ভাসিয়ে পাড়ি দেন অনন্তলোকে। ৮০ ও ৯০ দশক জুড়ে এরশাদ, বেগম জিয়া জমানায় জামাত-শিবির ও সাকা বাহিনী পুরো উত্তর চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতা-কর্মীদের বেছে বেছে খুন করে। ভয়াল সময়ে ৮০ দশকের শেষদিকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিক্ষানুরাগী রফিকুল আনোয়ার আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে আসেন।
এসময় এরশাদ সরকারের মদদপুষ্ট আধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত জামাত-শিবির ও সাকা’র সশস্ত্র ক্যাডারেরা নাজির হাট কলেজ ও মন্দাকিনকে দুর্গ বানিয়ে হাটহাজারি, রাউজান, ফটিকছড়িসহ পুরো চট্টগ্রামে বাছাইকরা বঙ্গবন্ধু অনুসারীদের উপর টানা সশস্ত্র হামলা চালায় প্রতিদিন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব কলেজ-বাজারে দিনে-দুপুরে হামলা হচ্ছে! প্রতিদিনই শিবির নাসির, এয়াকুব, হুমায়ুন, ইকবালের নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী পুরো জনপদকে মৃত্যু উপত্যকা বানায়। চট্টগ্রাম কলেজের সামনে রিকশা থেকে নামিয়ে ৮২ সালে সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত এজিএস তবারককে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে শিবিরের খুনের রাজনীতি অভিষেক হয়। এরপর চট্টগ্রামের একমাত্র সিটি কলেজ ছাড়া প্রায় সব ক’টি কলেজে প্রতিদিনই চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে খুন করা হয় টার্গেট করা সাহসী ছাত্র, যুবলীগ নেতা-কর্মিদের। নাজিরহাট কলেজ ভিপি আমিনুল করিম জাহাঙ্গীর, রুবেল, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বাবর, রাউজান কলেজ ভিপি মুজিব, এমইএস কলেজের বেলাল, নাজিরহাট কলেজের জমির, শ্যামল, হেলাল, ফুটবলার দিদার, ফটিকছড়ির আওয়ামী লীগ নেতা হারুন বশরসহ তুখোড় অগণিত ছাত্র, যুব নেতাকে হত্যা করে। আহত পঙ্গুর সংখ্যা অসংখ্য। কোনো বিচার নেই-গ্রেপ্তার নেই, উল্টো এরশাদের পুলিশ বাহিনী ঘাতক ক্যাডারদের নিরাপত্তা প্রটোকল দিত।
ভয়াল মৃত্যু উপত্যকায় আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাঁচিয়ে রাখতে মরণপণ লড়াই করেছি টানা দেড়যুগ। সাংবাদিকতা পেশার পাশাপাশি নিজে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্যের দায়িত্বে ছিলাম। ভয়াল দুর্যোগে রফিক ভাই, হাটহাজারীর আলহাজ্ব নাজিম উদ্দিন, ম. ইদ্রিস, এস এম কামাল উদ্দিন, মরহুম বাদশাহ আলম, সাবেক এমপি নুরুল আলম চৌধুরী, এ্যডভোকেট নুরুল হুদাসহ আরো অনেক অনেক নেতা শিবিরের টানা সন্ত্রাস রুখতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ-যুবলীগকে সুসংগঠিত করেন। নাজিম ভাই রফিক ভাই সশস্ত্র চক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবসময় পাশে ছিলেন। এরজন্য প্রচুর মূল্যও গুণতে হয় তাঁদের। বারবার জীবনের উপর হামলা হয়। কিন্তু পিছু ফিরেননি, দমেননি। তাঁদের টানা পরিশ্রম ও সহযোগিতায় উত্তর চট্টগ্রাম শিবির চক্রের ভয়াল প্রকাশ্য হামলা অনেকটা দমে যায়। নাজিম ভাই ৮৬ ও ৯১ সালে দু’দফা হাটহাজারি আসনে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনও করেন। প্রথমবার এরশাদের আব্দু বাহিনীর শ্বেত সন্ত্রাস এবং দ্বিতীয়বার দলীয় দুর্বলতায় সাফল্য আটকে যায়। ‘৯২ সালের ৩ জানুয়ারি অকালেই তাঁর প্রয়াণ ঘটে।
আবার রফিক ভাই নির্বাচনী রাজনীতিতে বেশ সফল। ‘৯১ সালে নিজে প্রার্থী না হয়ে নবাগত নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে (বর্তমান শরিক দলের এমপি) সমর্থন দিয়ে জিতিয়ে আনেন। ৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি দু’দফা টানা এমপি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে তত্বাবধায়ক সরকার বিএনপিকে জিতিয়ে আনতে দেশব্যাপী তীব্র প্রভাব বিস্তার করলেও ফটিকছড়িতে রফিকুল আনোয়ারের জয় ঠেকাতে পারেনি। রফিক ভাই ছিলেন গণ মানুষের নেতা। মৃত্যুকালীন সময়ে তিনি উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সি. সহসভাপতি ছিলেন। ফটিকছড়ির অসংখ্য মানুষ, প্রায় সব প্রতিষ্ঠান তাঁর সহযোগিতায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারি বরাদ্দের বাইরে জনকল্যাণমুখী কাজে অকাতরে খরচ করেছেন। গড়ে তুলেছেন, নানুপুর লায়লা-কবির ডিগ্রি কলেজসহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট। আধুনিক ও উন্নত ফটিকছড়ির রূপকার, আলহাজ্ব রফিকুল আনোয়ারকে বললে ভুল হবে না।
এক/এগারোর সরকার তাঁকে সাজানো অভিযোগে গ্রেপ্তার করে প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। জমিয়তুল ফালাহ ময়দানে মরহুমের নামাজে জানা যায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এ ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দেন। আটক অবস্থায় নির্মম নির্যাতনের কারণেই অকাল মৃত্যুর শিকার হয়েছেন তিনি ।
তাঁর মৃত্যুতে ফটিকছড়ি তথা চট্টগ্রামের মানুষ হারিয়েছে, একজন মানবতাবাদী নেতাকে। এটা পুরো আওয়ামী পরিবারের জন্য এক বড় ক্ষতি। জননেত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য রফিক ভাইয়ের অবদান ভুলেন নি। তাঁর একমাত্র মেয়ে খাদিজাতুল আনোয়ার সনিকে সংরক্ষিত আসনের এমপি হিসাবে নির্বাচিত করে এনেছেন। বিশ্বাস, মরহুম বাবার সুকর্ম ও মানবসেবার ব্রত মেয়ে আরো বেশি করে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট থাকবেন। ছোটভাই ফখরুল আনোয়ারও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা। বিভাগীয় সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। ৯ম প্রয়াণ দিবসে গণ মানুষের প্রিয়জন রফিকুল আনোয়ারের পবিত্র স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, সাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুর্নীতির শিকড় উৎপাটনে দুদকের ভূমিকা আরো শক্ত হোক
পরবর্তী নিবন্ধ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন