স্মরণ: খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী

এডভোকেট মাহবুব উদ্দিন আহমদ চৌধুরী | মঙ্গলবার , ১৩ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ

আজ ১৩ এপ্রিল ২০২১ আমিরুল হজ্ব খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর ৫৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৬২ সালের এ দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১৮৮৬ সালে জন্মগ্রহণকারী খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী ব্রিটিশের দোর্দণ্ড প্রতাপের সময় পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন দু’বার। তখনকার বদি আহমদ চৌধুরীর সমকালীন পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন শেরে বাংলা এ,কে ফজলুল হক, শ্রীমতি নেলী সেন গুপ্তা, সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী (খাদ্যমন্ত্রী) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বাবু ধীরেন্দ্র লাল দত্ত, বাবু কিরণ শংকর রায়, বাবু সন্তোষ কুমার বসু প্রমুখ উপমহাদেশ খ্যাত ব্রিটিশ সরকারের আতংক পার্লামেন্ট সদস্যগণ। খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী ২য় বারের মত যখন পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত তখন যুদ্ধে ব্রিটিশ-জাপান মুখোমুখি হন। বিশ্ব যুদ্ধের ওয়ার ফিল্ড ছিল বৃহত্তর চট্টগ্রাম। ফলে চট্টগ্রামে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয় এবং দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয় চট্টগ্রামসহ আশপাশের এলাকা। তখন বদি আহমদ চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকা ছিল বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ বৃহত্তর নোয়াখালী, ত্রিপুরা (বর্তমান বৃহত্তর কুমিল্লা) ও বৃহত্তর সিলেট। সে সময় অর্থাৎ ১৯৪৪ সালে দুর্ভিক্ষের কারণে অহরহ মানুষ মারা যাবার কথা স্বভাবতই তার কাছে পৌঁছাতে থাকে। ফলে তিনি সে বছর ৮ মে দার্জিলিং এ ইংরেজ লাট সাহেবের সাথে দেখা করে চট্টগ্রামের বিভাগের দুরবস্থার একটা চিত্র তুলে ধরেন। একখানি আবেদনপত্র দিয়ে আসেন দুর্ভিক্ষ নিবারণের জন্য। কিন্তু তাতে কোন কাজ হল না।
তৎকালীন সিভিল-সাপ্লাই মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী লাট সাহেবের নিকট থেকে আবেদনপত্র পেয়ে জবাব দিলেন, যানবাহনের অভাবে চট্টগ্রাম বিভাগে চাল প্রেরণ সম্ভব নহে। উপায়ান্তর না দেখে এই চট্টগ্রামের একশত ভাগ খাঁটি মাটির মানুষ আমিরুল হজ্ব খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী সেই বছর অর্থাৎ ১৯৪৪ সালের ৫ জুন পার্লামেন্টে উপস্থাপন করেন এক জরুরি মোশান। এদিন সময়ের অভাবে মোশান বাতিল হয়। ৭ জুন তিনি বিষয়টি পুনঃ উপস্থাপন করলেন এবং উক্ত মোশান না মঞ্জুর করা হলে তখনকার শেরে বাংলা এ,কে ফজলুল হক, শ্রীমতি নেলী সেনগুপ্তা, বাবু ধীরেন্দ্র লাল দত্তসহ বাঘা বাঘা পার্লামেন্ট সদস্যগণ ১০ মিনিটের জন্য হলেও চট্টগ্রামের দুরবস্থার কথা বলার সুযোগ দেয়ার সুপারিশ করেন। কিন্তু তাও যখন ব্যর্থ হয় তখন নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে কারও আদেশ নির্দেশের তোয়াক্কা না করে বহু বাঘা বাঘা তেজস্বী বাগ্মী ও বিদ্বান নেতৃবর্গের উপস্থিতিতে ব্রিটিশের দোর্দণ্ডপ্রতাপকে উপেক্ষা করে অবিভক্ত বাংলার কলকাতা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে চাটগাঁর বদি আহমদ চৌধুরী অনাহারজনিত মৃত্যু কাহিনী ও চট্টগ্রামের দুর্দশা সম্পর্কিত বক্তৃতা শুরু করেন। অনেক চেষ্টা করেও তাকে দাবাতে না পেরে স্পিকার ২৪ ঘণ্টার জন্য তাঁকে এসেম্বলী হলের বাইরে থাকার নির্দেশ দিলে তিনি ক্ষিপ্ত বাঘের মত গর্জন করে বলে উঠেন:“ আমি চট্টগ্রামের লোক! আমার দেশের লোক অনাহারে মারা যাবে অথচ মেম্বারী গদী রক্ষার জন্য এই অন্যায় আদেশ রক্ষা করে (এসেম্বলী হলের) বের হব তা আমার পক্ষে কখনও সম্ভব হবে না।” “ আমার তিন কথা (১) হয় চট্টগ্রাম বিভাগে চাল দিতে হবে, অথবা (২) আমাকে এখানে মেরে ফেলতে হবে অথবা (৩) আমি এখানে কাউকে কোন কাজ করতে দেব না। আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত, শেষ রক্তবিন্দু শরীরে থাকা পর্যন্ত, আমি বের হব না। আমার দেশের দুঃখ কষ্টের কথা আমি বলবই বলব।”
তাঁর মরণপণ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে স্পিকার বাধ্য হয়ে পরবর্তী ১৫ জুনের অধিবেশনে চালের আলোচনার জন্য তার মোশান মঞ্জুর করেন। তখন চট্টগ্রামের ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান তার দীর্ঘ বক্তৃতায় সরকারি গেজেট ও অন্যান্য প্রমাণপত্র উপস্থাপন করে প্রমাণ করেন চট্টগ্রাম ও অবিভক্ত বাংলার অন্যান্য অঞ্চলসমূহের মধ্যে চালের দামের এক বিরাট ব্যবধানের কথা। উল্লেখ্য, তখন কলকাতায় চালের দাম ছিল টাকায় আড়াই সের আর চট্টগ্রামে টাকায় তিন পোয়া। তার এ যুক্তিনির্ভর ও অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত দাবী সহযোগী সদস্যগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার দু’খানি বিশেষ ট্রেন ও দু’খানি বিশেষ স্টীমার যোগে চট্টগ্রামে ৭ লাখ টন চাউল প্রেরণ করেন। ফলে বহু লোক মারা যাওয়ার পর খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর জীবন মরণ সংগ্রামের ফলে চট্টগ্রামবাসী পর্যাপ্ত চাউল প্রাপ্তিতে চাউলের দাম নিম্নগামী হয়। আর দুর্ভিক্ষ থেমে গিয়ে চট্টগ্রামবাসী বাকী মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান।
তখনকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি.এস. এম. স্টুয়ার্ট সেই চাল পেয়ে অধীনস্থ সকল অফিসারদের উপস্থিতিতে প্রকাশ্য স্থানে চট্টগ্রামের লড়াকু পার্লামেন্টারিয়ান খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে বলেন,“আপনি আজ চট্টগ্রামবাসীকেও বিভাগীয় লোকদেরকে বাচাঁলেন।” আজ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারিনি। যিনি দোর্দন্ড প্রতাপশালী ব্রিটিশের রক্তচক্ষু ও সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে নিজের জীবন বাজি রেখে ব্রিটিশ রাজের অনিচ্ছাকে ইচ্ছায় পরিণত করেছিলেন এবং অনাহারজনিত নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে চট্টগ্রামবাসীকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন এমন এক কর্মবীর দেশপ্রেমিক ও চট্টগ্রামের খাঁটি মাটির মানুষটিকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে আমরা কতটুকু সমর্থ হয়েছি। চট্টগ্রামের অনেক বাঘা বাঘা ব্যক্তিবর্গ শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প তথা সমাজসেবায় অবদান রেখে চলে গেছেন। আমরা এদের অনেককে বিশেষ ফলাও করে মূল্যায়ন করে থাকি। আমাদের বুঝতে হবে সবার উপরে শ্রেষ্ঠ অবদান ঐ মহান ব্যক্তির যিনি মানুষের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। মানুষের জীবন থাকলেই তো শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প ইত্যাদি সেবার প্রশ্ন আসবে।
এখানে উল্লেখ্য, খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী সমাজের আরও দশজনের মত বিশাল সমাজসেবাসহ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। ফলে তিনি একাধারে খান বাহাদুর ও আমিরুল হজ্ব উপাধি প্রাপ্তসহ ১২/১৪ টি বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সদস্য ছিলেন। যেমন-ইন্ডিয়া রোড কমিটি, ক্যালকাটা পোর্ট হজ্ব কমিটি, আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে এ্যাডভাইজারী কমিটি, বেঙ্গল এঙারসাইজ স্ট্যান্ডিং কমিটি, বেঙ্গল রেভিনিউ স্ট্যান্ডিং কমিটি, বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল বোর্ড, চট্টগ্রাম বিভাগীয় জেনারেল হাসপাতাল এন্ড মেডিকেল কলেজ স্কুল, চট্টগ্রাম জেলা বোর্ড, চট্টগ্রাম স্কুল বোর্ড নামক বিশাল প্রতিষ্ঠানাদীর সদস্য ছিলেন। তেমনি ছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালটির কমিশনার, ভাইস-প্রেসিডেন্ট ক্যালকাটাস্থ বেঙ্গল লাইব্রেরী, সেক্রেটারী চট্টগ্রাম বিভাগীয় জমিদার এসোসিয়েশনসহ বাঁশখালী তাঁর নিজস্ব ইউনিয়ন বোর্ডের এক নাগাড়ে ত্রিশ বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁর উপর ছিলেন দীর্ঘকালীন জেল ভিজিটর ও স্পেশাল জুরি (বিচারক)। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন ক্যালকাটা দেশপ্রিয় সুগার মিল, পটিয়া টি এস্টেট, হেগিং বাগান ইত্যাদির। এসবের পরও অনেক ছোট বড় প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন পৃষ্ঠপোষক, উপদেষ্টা। অর্থাৎ চট্টগ্রামের বাঘা বাঘা ব্যক্তিত্বগণ যেমনি শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, সমাজসেবায় অবদান রেখে খ্যাতিমান হয়ে আছেন তেমনি খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে সমাজসেবায়, দেশসেবায় বিশাল অবদান রেখে গেছেন। সবকিছুর উপর তার বিশেষ যে অবদান রয়েছে তা হল ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে অবিভক্ত বাংলার কলকাতা পার্লামেন্টে জীবন মরণ সংগ্রামের মাধ্যমে ৭ লাখ টন চাউল প্রাপ্তি। এ চাল প্রাপ্তির ফলে চট্টগ্রাম বিভাগের অসংখ্য মানুষ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়। ৫৯ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাই যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন। আমিন।
লেখক : সাবেক সভাপতি, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি

পূর্ববর্তী নিবন্ধনববর্ষ, নব নয়
পরবর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধে ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীর আত্মদান