সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি

সাখাওয়াত হোসেন মজনু | সোমবার , ১ মার্চ, ২০২১ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

: স্বাধীনতা সংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা এবং একদল দেশপ্রেমিক।
: মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে এরা ছিলেন ছাত্রলীগ কর্মী ও নেতা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা সবাই ছিলেন রণাঙ্গনে। কারো হাতে ছিলো অস্ত্র, কারো হাতে গেরিলাযুদ্ধের কৌশল এবং কেউ ছিলেন জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি। ১ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর এরা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিরোধযোদ্ধা। এই বিপ্লবী মানুষগুলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা বাস্তবায়নে নিজেদের ত্যাগকে জাতীয়ভাবে স্থাপন করতে পারেননি। বিশেষ একটি সময়ে তাঁরা দেখতে পেলেন অনাহূত মানুষগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে গ্রাস করে নিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠিত করেছে ভোগের আসনটি। রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতিতে এই মানুষগুলো বিভিন্ন দলের ঘাড়ে চেপে একাত্তরকে নিয়ে গেছেন ভিন্ন পথে। এদের সহযাত্রী হয়েছিলেন বিভ্রান্ত কিছু অতিপ্রগতিশীল মানুষ। তারা মুখে এবং গতিময়তায় প্রমাণ করে ছিলেন যে, তারাই প্রকৃত দেশ প্রেমিক, আর প্রকৃত দেশ প্রেমিক মানুষদের নিয়ে গেলেন সমালোচনার দুয়ারে। ফলে আশাহত হয়ে ঐ মানুষগুলো চলে গেছেন বিস্মৃতির অতলে। নিজেদের আদর্শ ও নৈতিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত না হয়ে তারা পথ চলছিলেন আগামির অপেক্ষায়।
সেদিন ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১- এই মানুষগুলোকে নিয়ে সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টির জন্য আয়োজন হয়েছিলো একটি আড্ডার। কোন রাজনীতি বা দলীয় রাজনীতির চর্চার জন্য তারা এখানে আসেননি, এসেছিলেন পুরানো সতীর্থদের দেখতে, প্রাণখুলে কথা বলতে এবং বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে যাওয়া পুরোনো দিনের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের খবর নিতে। আড্ডার কেন্দ্র বিন্দুতে ছিলেন ডা. মাহফুজুর রহমান, আবদুল আহাদ চৌধুরী, তাজুল ইসলাম, দীলিপ দাশ, আবুল কাশেম এবং সমন্বয় সৃষ্টিকরা প্রাক্তন ছাত্রনেতা সোলায়মান খান, আ জ ম সাদেক, সুমূশময় চৌধুরী, স.ম নজরুল, নুরুল আরসাদ চৌধুরী, কাজী গোলাম সারওয়ার মজনু, জানে আলম, কামাল উদ্দিন জাফর হোসেন, সাল্লাহ উদ্দিন বাবুল, আবু তাহের চৌধুরী, আবু তাহের আলমদারসহ আরো অনেকে। এই মানুষগুলো রাজনৈতিক সচেতন তবে দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে রয়েছেন। তবে সবাই স্বাধীনতা সংগ্রামী। রাজনীতি ও দলীয় রাজনীতির বিবর্তনের মধ্যেও এরা স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তারা বেচাকেনার অনেক উর্ধ্বে। রাজনীতি এবং দলীয় রাজনীতির অবক্ষয়ের মধ্যেও তারা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও দেশপ্রেমের কথা শতভাগ মাথায় রেখে সমাজ শক্তির আদর্শে বিদ্যমান। এখন এই মানুষগুলো নেতিবাচক রাজনীতি বা ইতিবাচক রাজনীতির কোন ধারাতেই নেই। কেউ বলেন এরা দেশপ্রেমিক কিন্তু অভিমান নিয়ে বসে আছেন। যারা প্রকৃতই দেশকে ভালোবাসেন এবং দেশের কল্যাণ কামনা করেন তারা প্রতিক্রিয়াশীলদের পছন্দ করেন না। অন্যদিকে কেন তারা রাজনীতি বা দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে চেষ্টা করা প্রয়োজন। সাধারণ ভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এভাবে, তাহলে দেশের এমন একটি রাজনৈতিক দল আছে যেখানে প্রতিক্রিয়াশীলদের ছোঁয়া নেই? ডান বলুন আর বাম বলুন সবাই কোন না কোন সময় নিজেদের প্রয়োজনে তত্ত্ব দিয়েছেন। নেতিবাচক ও ইতিবাচক ধারাকে মিলিয়ে নিয়েছেন। ফলে ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধকে তারা শুধুই নিজের দল বা ক্ষমতার জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। এমন মানুষদের জোর দাবি ছিলো রাজনীতিতে চিরশত্রু আর চিরমিত্র নেই। এমন কথার অর্থ হচ্ছে আমার নেতিবাচক কাজকেও ইতিবাচক ধারায় নিয়ে যাওয়া। একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, যিনি বা যারা আমার স্বাধীনতার শত্রু ছিলেন, দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করছে, আমার গণতন্ত্র নির্বাসনে নিয়ে গেছে, আমার বোনকে একাত্তরে এবং এখন ধর্ষণ করছে আমার পতাকাকে বদলানোর কথা বলছে, আমার জাতীয় সঙ্গীতকে তাদের পছন্দ নয়, আমার ভোট আমি দিতে পারবো না, দিনের ভোট রাতে দেবো আমরা ব্যালট বক্স পাল্টে দেবো এমন চর্চাতো আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য চাইনি। সেদিন যারা আড্ডায় বসেছিলেন তারা কিন্তু এমন কথাগুলো বলেননি, শুনাননি তবে এরা ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রাম করেছিলেন স্বাধীন দেশের জন্য, গণমুখি শিক্ষা এবং গণমুখি অর্থনীতির জন্য, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। আমরা শিক্ষাকে ধনী আর দরিদ্র মানুষের জন্য বিভাজন করে তথাকথিত অভিজাত শ্রেণি সৃষ্টির জন্য যুদ্ধ করিনি এবং বন্ধুরা করেননি। ফলে যন্ত্রণাতো হবারই কথা। এখন অতিধনির ছেলেরাও অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে বিনামূল্যে বই পাচ্ছে আবার গ্রামের দরিদ্র শিক্ষার্থী শিশুটিও বিনামূল্যে বই পাচ্ছে। এখানে সমতার কথাবলা হলেও সৃষ্টি হচ্ছে বৈষম্যমূলক একটি শ্রেণি। সাধারণ মানের বাংলা মিডিয়ামে শিক্ষার চাইতে, ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাংলা মিডিয়াম এখন অভিজাত ধনীদের নিকট অনেকটা অপাংক্তেয়। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন একটি বৈষম্যমূলক সমাজ সৃষ্টির জন্য। যুদ্ধ করেছিলেন এই গ্রামীণ কৃষকদের ঘরে থেকে। এখনো বলা যায় যে, শতকরা ৮০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কৃষক বা কৃষকদের সন্তান। তবে অভিযাত মানুষগুলো এখন রাজনীতি ও সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে। এটাতো স্বাধীনতা পূর্ব ছাত্রলীগ চায়নি। তখন ছাত্রলীগ ছিলো আদর্শের ছোয়ায় সমৃদ্ধ এবং ছাত্রলীগ কোন দলের অঙ্গ সংগঠন ছিলো না। ফলে ১৯৬২ থেকেই তারা স্বাধীনতার কথা বলে ছিলো এবং তারাই একক সিদ্ধান্ত নিয়ে ২ মার্চ স্বাধীনতার পতাকা তুলেছিলো, ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলো। তখন যদি ছাত্রলীগ কোন দলের অঙ্গসংগঠন থাকতো তাহলে বাঙালি জাতির জন্য এতো বড় ভূমিকা রাখতে পারতো কি? সত্য হচ্ছে ছাত্রলীগ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তৈরি করেছিলো এবং সেই পতাকারতলে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো। স্বাধীন হয়েছিলো বাংলাদেশ।
যাদের নিয়ে একথাগুলো বলেছি তারা প্রত্যেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী। মুক্তিযোদ্ধা ও দেশ প্রেমিক। এখন তারা রাজনীতির চর্চা করেন তবে কোন দলের অধীনে নয়। রাজনীতি চর্চা এবং রাজনৈতিক দল করা কিন্তু এক নয়। তারা এখন সমাজ শক্তির অংশ। তারা হতাশ হলেও পথ ভ্রষ্ট নয়। তারা পুরানো সতীর্থদের নিয়ে বাঁচতে চাইছেন সম্প্রীতি ও পারিবারিক বন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে। পুরানো দিনের স্মৃতিতর্পণ করে বলতে চাইছেন, পুরানো সে দিনের কথা ভুলবে কিরে হায় … চোখের দেখা প্রাণের কথা সেকি ভোলা যায়! সত্যিই যায় না। রাজনীতি যখন নিরপেক্ষ অবস্থানে নেই তাইতো জীবনের এবেলায় পেতে চাইছি নিখাত বন্ধুত্ব এবং সম্প্রীতির মিলন। ছাত্রলীগের একাত্তরের বন্ধুরা একটি দেশ এনেছেন কিন্তু এখন তারা ….।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও আমাদের উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যৎ
পরবর্তী নিবন্ধঅলৌকিক শক্তি!