সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি

সাখাওয়াত হোসেন মজনু | সোমবার , ২ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

: ১৯৭০ এর নির্বাচন, কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস- এম.এ. মালেক ও পোস্টার প্রসঙ্গ।
: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী ২৯ অক্টোবর (২০২০) দৈনিক আজাদী’র উপ সম্পাদকীয়তে ‘সৎ রাজনীতিকের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এম.এ. ওহাব’ শীর্ষক একটি লেখা স্মরণের পাতায় এনেছেন। নাসির ভাই’র নাম মনে এলে প্রথমেই মনে পড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চন্দপুরা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনের কথা। শতভাগ জীবন ঝুঁকির মধ্যেই তাঁকে এই অপারেশন সম্পন্ন করতে হয়েছিলো। আমার শ্রদ্ধার একজন ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি এখনো উজ্জ্বল। নিজের চোখে দেখা অসংখ্য স্মৃতি এবং কেমন করে অর্থের লোভ পরিহার করে স্বাধীন দেশের সূচনা লগ্নে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিয়ে এগিয়েছেন সে সময়ের কথা এখনো চোখের সামনে ভাসছে। দৈনিক আজাদীর এই লেখাটি পড়ে মনে পড়লো এম.এ. ওহাব, প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, এ বি এম নিজামুল হক, লোকমান হাকিম চৌধুরী, এস এম ফজলুল হক, আবদুল হক, এস এম খোরশেদ আলম, সেলিম জাহাঙ্গীর, ডা. জাকেরিয়া চৌধুরী, সাধন ধর এবং আরো ক’জনের একটি আড্ডার কথা। মহিলাদের মধ্যে ছিলেন ফাতেমা খায়রুননেছা লুসি, বাসনা হোড়সহ আরো অনেকে। স্থানটি ছিলো নুর আহমদ রোডস্থ মেট্রোপোল চেম্বার। চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ-এর কার্যালয়। সভাপতি প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ, সাধারণ সম্পাদক আমি। প্রতি সন্ধ্যায় এমন আড্ডা বসতো। সাথে থাকতো সৈয়দ মো. আবদুল লতিফ-এর রং চা, বেলা বিস্কুটের আপ্যায়ন। প্রসঙ্গ এসেছিলো ১৯৭০ এর নির্বাচন।
: এবার সে প্রসঙ্গে আড্ডার কথাগুলো বলি।
: তখনকার সময়ে যাঁরা রাজনীতি করতেন তাঁরা ছিলেন স্বচ্ছ এবং পরিচ্ছন্ন। তাঁদের মধ্যে সে আড্ডার প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ এবং এম. এ. ওহাব ৭০ এর নির্বাচনে এম.এন.এ (জাতীয় পরিষদ সদস্য) এম পি এ (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য) তাঁদের দু’জনই নির্বাচন করেছেন কর্মী ও জনসমর্থন নিয়ে। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম আর সিদ্দিকী তাঁদের দু’জনের জন্য দু’টি প্যাকেট পাঠিয়েছিলেন কিন্তু প্যাকেটগুলো তাঁদের হাতে পৌঁছায়নি। ইতোমধ্যে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের সকল কাজ বন্ধ করে এম.এ. মালেক নিজের দুলাভাই প্রফেসর খালেদ এর জন্য লিফলেট এবং পোস্টার ছাপার কাজ শুরু করেন। তখন এম.এ. মালেক সংবাদ পেলেন এম.এ. ওহাব সাহেব পোস্টার, লিফলেট ছাপাতে পারছেন না অর্থের অভাবে। ঢাকা থেকে আসা কেন্দ্রীয় পোস্টারই তাঁর ভরসা। এরিমধ্যে মালেক সাহেব নিজ গাড়িতে করে এম.এ. ওহাবের জন্য পোস্টার ছাপিয়ে পাঠালেন। পোস্টার দেখেতো ওহাব সাহেব থ বনে গেলেন। তিনি যা কখনোই ভাবেননি তা হয়েছে। নির্বাচন বিধি মেনে এম.এ. মালেক কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের কর্মীদের কাজে লাগিয়ে নির্বাচনের শেষ দিন পর্যন্ত পোস্টার পাঠিয়ে ছিলেন। সে আড্ডায় এম.এ. ওহাব এবং প্রফেসর খালেদ সাহেব শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছিলেন কোহিনূর প্রেসও এম.এ. মালেকের অবদানের কথা। যাঁদের নাম লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি তাঁরা প্রতিজনই ১৯৭০ এর নির্বাচনে প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ এবং এম.এ. ওহাবের নৌকা প্রতীকের সমর্থনে মাঠে ছিলেন। এম.এ. আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর জন্যও পোস্টার ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছিলো কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে। আড্ডা থেকে দুই প্রার্থী এমন কিছু কথা বলেছিলেন যার জবাব দেওয়া সবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিলো না। যেমন-
১. বঙ্গবন্ধু প্রায় রাতে প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ সাহেবের সাথে কথা বলতেন। সে সময়তো এখনকার মতো ফোনের সুব্যবস্থা ছিলো না। রাত ১টা ২টার পর তিনি ক্যাম্পেইনরেসের সাধন ধর, লোকমান হাকিম-কে নিয়ে চলে আসতেন সার্কেল অফিসারে অফিসে। বঙ্গবন্ধু ফোন করলে যেন ধরতে পারেন। ফোনে জিজ্ঞেস করতেন খালেদ তোমার খবর কি? তোমাদের সবার খবর রাখছি। তখনই সাধন ধর আবদারের সুরে বলতেন, খালেদ বঙ্গবন্ধু কি তোমাকে খালেদ বলতো! ইতিহাস বিকৃত করছো কেন? তখন লোকমান হাকিম বললেন, বঙ্গবন্ধু খালেদ দুলাভাইকে বলতেন প্রফেসর সাব। তখন খালেদ সাহেব লজ্জা পেতেন। এই আড্ডায় সেদিন যাঁরা ছিলেন তারা প্রতিজনই ছিলেন এই দু’জনের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ অংশীদার। তাছাড়া প্রফেসর খালেদ এর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক স্পিকার ও পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ফজলুল কাদের চৌধুরী। এজন্য আওয়ামী মহলে ১৬৯ আসনের মধ্যে খালেদ সাহেবের আসনটা জয়ের ধারণা থেকে বাদই রেখেছিলেন। সেজন্য রাউজান, হাটহাজারী অঞ্চলের প্রতিজন নেতা, কর্মী, সমর্থক ছিলেন সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায়। একদিকে ফজলুল কাদের চৌধুরীর অর্থ, প্রচারে গাড়ির ব্যবহার, কর্মী সমর্থক মহলে অর্থের ছড়াছড়ি। এর বিপরীতে নৌকা বাহিনীর প্রচার মাধ্যম ছিলো সাইকেল, নৌকা এবং অঞ্চল ভিত্তিক কর্মী বাহিনীর ঘরে ঘরে যাওয়া। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের হাউজ টু হাউজ প্রচারের ফলে নৌকার প্রার্থীরা পৌঁছে যায় প্রতিটি ঘরে ঘরে। তখন প্রভাবশালী প্রার্থীর অর্থের বিপরীতে নৌকার কর্মীরা চিড়া, মুড়ি, গুড়ে নিজেদের ক্ষুধা নিবারণ করেছিলেন। তারাতো পথের কথা ভাবেননি। পথ খুঁজে নিয়েছেন জমির ওপর দিয়ে, মেঠোপথ দিয়ে, কাদা জল মাড়িয়ে মানুষের দোরগোড়ায় নৌকা প্রতীক মানুষের ঘরে, ওঠানে, পুকুর পাড়ে সর্বত্র।
: ওহাব সাহেব মজা করে বলেছিলেন…।
: রাউজানে হারুন মিয়া (আবদুল্লাহ আল হারুন) হাটহাজারীর ওহাব মিয়া আর হাটহাজারী রাউজানে একসাথে খালেদ মিয়া। তখন শওকত হাফিজ খান রুশ্নি বলেছিলেন, তখন রাউজান ও হাটহাজারী অঞ্চলের অনেক সাধারণ মানুষতো খালেদ সাহেবের নাম জানতেন না এবং চিনতেন না। তারা অনেকে বলতেন নৌকার প্রফেসর। প্রচারে সময় গ্রামের মহিলারা হাতে করে মোটা চালের ভাত, পিঠা ও হাতে বানানো নাস্তা নিয়ে বাড়ির সামনে বসে থাকতেন। আমাদের কর্মীদের খাওয়াতেন যেন আমরা হুজুর। না খেলে কষ্ট পেতেন। তাই আমরা খেতাম, সাথে করে নিয়ে যেতাম। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে নিজের লুঙ্গি ছিঁড়ে গেছে টেরই পেতাম না। দেখেছি গ্রামের মানুষ লুঙ্গি এনে দিয়েছে। আমরা যাবো সে সংবাদের ভিত্তিতে অতি সাধারণ মানুষ রাতা মুরগি জবাই করে রেখেছেন, গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে জোর করে খেতে বসিয়ে দিয়েছেন। পাকা কলা, পেঁপে কেটে সামনে এনে রেখেছেন। এগুলো তাঁদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শন। এগুলো ফেলে গেলে মানুষের মনে আঘাত দেওয়া হতো, অশ্রদ্ধা করা হতো। তবে কোন কর্মী বা নেতা বা সমর্থকের জন্য একখানা পয়সা খরচ করতে হয়নি। এটাই ছিলো ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের নৈতিক শিক্ষা। দেখেছি মহান মুক্তিযুদ্ধে এখানে যারা উপস্থিত সবাই অংশ নিয়েছেন এবং বড় বড় দায়িত্বও তারা পালন করেছেন। এমন নেতাকর্মী ছিলেন বলেই আমাদের জয় এসেছে ১৯৭০ এর নির্বাচনে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে। শুধুমাত্র কর্মী নেতাদের ত্যাগ ছিলো বলে খালেদ মিয়া প্রচুর ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করতে পেরেছিলেন। নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু আমাকে ও খালেদ মিয়ার খবর জেনে কেঁদে ফেলেছিলেন। এম.এ. আজিজ নিজের কথা চিন্তা না করে দু’বার রাউজান ও হাটহাজারী অঞ্চলে আমাদের নির্বাচনী প্রচারনায় এসেছিলেন। খালেদ মিয়া জয়ী হওয়ার পথে রয়েছেন এমন সংবাদ পাওয়ার পরইতো কোহিনূর প্রেসের কর্মীরা প্রেস বন্ধ রেখে চলে যান রাউজান। খালেদ মিয়া কোন ধরনের বিজয় উৎসব করেননি। যদিও স্থানীয় কর্মীরা আবেগ দমন করতে না পেরে নিজেদের উদ্যোগে বিজয় মিছিল করেছিলেন বোম্বা চেরাগ বাতি জ্বালিয়ে। চোখের জল নিয়ন্ত্রণ করে তিনি বলেন, নির্বাচনী দুঃসময়ে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস, কোহিনূর প্রেসের কর্মী, এম.এ. মালেক যদি সে সময় পাশে না থাকতেন তাহলে আমাদের পক্ষে প্রচারে সফলতা আসতো কিনা জানি না।
আড্ডায় আড্ডায় প্রচুর ইতিহাস ওঠে এসেছে। কর্মী বাহিনীর সততার প্রমাণ মিলেছে, ত্যাগের ফসল ঘরে ওঠেছে। চিত্তের কাছে বিত্ত পরাজিত হয়েছে। প্রকৃত রাজনীতিক কেমন হয় তাও জানা গেছে। তাঁদের সে সময়ের কথাগুলো এখন মূল্যায়নের সময়। ভাবছি এমন ত্যাগের রাজনীতি কি আমরা ফিরে পাবো?
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু : ত্যাগী রাজনৈতিক ও সফল ব্যবসায়ী
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে