সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে

| রবিবার , ৭ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস’ আজ। ১৯৪৮ সালের এ দিনেই প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সেই থেকে প্রতিবছর নানা প্রতিপাদ্যের আলোকে পালিত হচ্ছে এ দিবসটি। সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত অন্যতম খাত হলো স্বাস্থ্য। বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছরে এ খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্য ছাড়াও অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুমত্যুর হার হ্রাস, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির বিস্তার, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ ও মৃত্যুহার নিম্নমুখী, পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রীর নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩০এ আনয়ন, অপুষ্টি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে দেশব্যাপী ভিটামিন এ ও ফলিক এসিড বিতরণএ সবই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সফলতার চিত্র।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, দেশে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে কমলেও বাড়ছে অসংক্রামক ব্যাধি। দেশে স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির মতে, প্রতি বছর দেশে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত রোগীদের মধ্যে ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক রোগে ভুগে মারা গেছে। তাদের মধ্যে হৃদরোগীদের হার সর্বোচ্চ, যা ৩০ শতাংশের বেশি। সাম্প্রতিক বছরে হৃদরোগের অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে গুণগতমান ও উৎকর্ষ বেড়েছে। তবে অস্ত্রোপচারের সংখ্যা, চিকিৎসা ব্যয় ও আঞ্চলিক অবকাঠামোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, এ বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবার উন্নয়নে বাজেট বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের জীবনাচার ও খাদ্যাভ্যাসে সতর্কতা এবং প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিরোধমূলক সচেতনতা আরো বাড়াতে হবে।

বলা জরুরি যে, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যে মানুষের অধিকার, কারো দয়া বা করুণার বিষয় নয়এটাও সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে বোঝানো এবং সরকারিবেসরকারি পর্যায়ে যারা সেবা প্রদানকারীর ভূমিকায় আছেন তাদের জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরির জন্য সচেষ্ট হতে হবে। অধিকারভিত্তিক একটি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারলেই এইসব ক্ষেত্রে অর্জন, এসডিজির গোলসমূহ অর্জন করা এবং সর্বোপরি যে কোনো বিপদশঙ্কুল পরিস্থিতি আরও সুদৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করা সহজতর হবে। স্বাস্থ্য অধিকারের দাবিতে দেশে একটি স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।

অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান স্বাস্থ্যখাতের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলেছিলেন, আগে আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’। এখন ওই আকাঙ্ক্ষায় নতুন কিছু শব্দ যোগ করতে হয়েছে। এখন আমরা বলছি ‘সবার জন্য সহজলভ্য ও মানসম্মত স্বাস্থ্য’। আগে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ বললে বোঝা যেত দেশের মোটামুটি সব জায়গায় হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বানালেই হয়ে গেল। এখন কিন্তু আমাদের ‘মানসম্মত ও সহজলভ্য স্বাস্থ্য’ বলতে হচ্ছে। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ বলতে যে আকাঙ্ক্ষার কথা আমরা বলে এসেছি, তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। তবে দিনবদলের কারণে আকাঙ্ক্ষাটাকেও এখন আমাদের নতুন করে সাজাতে হচ্ছে। তিনি বলেছেন, এখন স্বাস্থ্য খরচ অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। সরকারি হিসাবের তথ্য বলছে, আমাদের স্বাস্থ্যের পেছনে যত খরচ হয়, তার ৬৭ শতাংশই মানুষ নিজের পকেট থেকে খরচ করছে। অথচ বৈশ্বিক মান হচ্ছে ৩৪ শতাংশের মতো। তার প্রায় দ্বিগুণ আমরা খরচ করছি। আমাদের কাছে স্বাস্থ্য খরচ একটা বড় বোঝা। স্বাস্থ্যসেবার খরচের বিষয়টি আমরা ঠিকমতো স্বীকার করি না বলে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কমে যাচ্ছে বা দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্যবিমোচন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। আসলে সকলের জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের বিষয়টি অর্থনৈতিক মুক্তি, সুশাসন, পরিবেশ ইত্যাদি অনেক কিছুর সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মডেল হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতিও পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্যের উন্নতিতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশ পুরস্কৃত হয়েছে। তারপরও সকলের জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার বিষয়টি সুদূর পরাহতই রয়ে গেছে। ফলে ২০১৬ থেকে ২০৩০ মেয়াদে এসডিজির যে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্ব সহকারে সকলের জন্য স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সারা বিশ্বের সিদ্ধান্ত। শুধু বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত নয়। প্রত্যেক মানুষ, সর্বস্থানে এবং সর্বস্তরে স্বাস্থ্য সেক্টরের একটি অ্যাকসেস থাকতে হবে। এটি আমাদের জন্মগত অধিকার, এটি রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতেই হবে। শুধু আমার পকেটে টাকা নেই বলে আমি স্বাস্থ্যসেবা পাব না, তা কিন্তু হবে না। কাজেই সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশের উন্নয়নের জন্য একে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে যখন প্রয়োজন তখনই যেকোনো ধরনের চিকিৎসাসেবা বিনা মূল্যে গ্রহণ করতে পারবে, তখনই আমাদের দেশে ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হবে। এ জন্য আরো লম্বা পথ পাড়ি দিতে হতে পারে; যদিও আমাদের মতো এত জনবহুল দেশের সব মানুষকে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া কঠিন। তবু সরকারের উদ্যোগ থাকলে তা অসম্ভব হবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে