রোহিঙ্গা সংকটের শেষ কোথায়

কাজী রুনু বিলকিস | সোমবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।এই রোহিঙ্গারা ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সেনবাহিনীর নৃশংসতা থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই মূহুর্তে বাংলাদেশে নিবন্ধিত ৯ লাখ ৬০হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। নিজ বাসভূমে এই রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে পরবাসী হয়ে আছে। ১৯৬২সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যূত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করলে সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের বিদেশি নাগরিক বলে ঘোষণা করে। তাদের সমস্ত নাগরিক অধিকার, ভোটাধিকার, মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।হত্যা, ধর্ষণ, সম্পত্তি হরণ নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা থেকে ওদের বঞ্চিত করা হয়। ত্রিমুখি আক্রমণের শিকার হয় তারা। মিয়ানমারের ভিতরে অতি জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতা একই সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কতৃক বিচারবহির্ভূত হত্যা, অবৈধ গ্রেফতার, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকারে পরিনত হয়। ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হাতে ১২জন নিরাপত্তা কর্মী নিহত হওয়ার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ক্লিয়ারেন্স অপারেশন শুরু করে। এই অপারেশনে প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়।আহত হয় অনেকে। নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিলে রোহিঙ্গার ঢেউ আছড়ে পড়ে বাংলাদেশের সীমানায়। মানবিক কারণে সরকার সীমানা উন্মুক্ত করে তাদের জন্য। নাগরিকত্ব আইনই মূলত তাদের রাষ্ট্রহীন করে তোলে। এই আইনের অধীনে ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী থাকলেও রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। রোহিঙ্গাদের আসার ছয় বছর পূর্ণ হলেও একজন রোহিঙ্গা ও ফিরে যেতে পারেনি। বরং এদের সংখ্যা আরও বেড়েছে। ছয় বছরে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা দুই লাখ আশি হাজারেরও বেশি। জন্ম নিয়ন্ত্রণে তাদের আগ্রহও কম।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এক বিশ্ব এক পরিবারের অংশ হওয়ার অধিকার তাদের আছে কিনা। বাংলাদেশ একা এই হতভাগ্য জনগোষ্ঠীর ভার কতদিন বয়ে বেড়াবে! বিশ্ব মোড়লদের মোড়লপনা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের ব্যাপারে উচ্চকিত হতে আমরা দেখিনা যতটা দেখা যায় বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ! রোহিঙ্গারা বর্তমানে আমাদের দেশের আর্থসামাজিক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।আন্তর্জাতিক সাহায্যও কমে এসেছে। বৈশ্বিক রাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় রোহিঙ্গা সংকট স্পষ্টতই একটা অংশ হয়ে পড়েছে। এই ভূরাজনৈতিক রেষারেষির কারণেই রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত গনহত্যার প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় যেমন নিষ্‌ক্িরয় থেকেছে তেমনি মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারের প্রশ্নেও ঐকমত্যে পৌঁছায়নি। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নে ঐকমত্য থাকলে ও তার প্রক্রিয়া এবং তদারকির প্রশ্নে মতভেদের কারণে মিয়ানমারের বৈষম্যমূলক নীতি পরিবর্তনে অনিহা,রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দানে অস্বীকৃতি এবং নানা ধরনের কূটকৌশলে পুরো ব্যাপারটা অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়েছে এবং প্রলম্বিত হচ্ছে। এই বিপুল সংখ্যক আশ্রিত রোহিঙ্গার জন্য ন্যূনতম মানবিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কি পরিমাণ অর্থ খরচ হচ্ছে তার কোন পরিসংখ্যান খুঁজে পেলামনা। আমাদের গণমাধ্যম গুলো কত গুরুত্বহীন খবর নিয়ে পৃষ্ঠা ভরিয়ে তোলে অথচ রোহিঙ্গা সংকটের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা নেই। জাতিসংঘ প্রতি বছর অর্থায়নের ঘাটতির কথা বলে আসছে। এই রকম বাস্তবতায় দেশের যে চাপ পড়েছে তা থেকে সহসা মুক্তি পাওয়ার কোন সুযোগ দেখছিনা।মিয়ানমার বেশ কয়েক দফায় বাংলাদেশের আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো একজনকে ও নেয়নি। বরঞ্চ মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী নিয়মিত বাংলাদেশের দিকে রোহিঙ্গাদের তাড়ানোর চেষ্টা করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মূলত চীন, ভারত ও রাশিয়ার বিশাল বিনিয়োগ ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের প্রধান অন্তরায়। তারা এই সমস্যাকে প্রলম্বিত করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে। মিয়ানমারে চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। দেশটিতে চীনের বিনিয়োগ ১৮বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা পশ্চিমা দেশের বিনিয়োগের পরিমাণের দ্বিগুণেরও বেশি। ভারত ও চীনের সাথে বাংলাদেশের দৃঢ় সম্পর্ক থাকলেও এই সমস্যা সমাধানে প্রত্যাশিতভাবে তাদের পাশে পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ বছরের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে পরীক্ষামূলক প্রকল্পের আওতায় মোট ৭১৭৬ রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশও চাইছে পরীক্ষামূলকভাবে হলেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হোক। এধরনের প্রত্যাবাসন বড় প্রত্যাবাসনের আগে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে ও বুঝতে সহায়তা করবে। চীনও বলছে এটা অবশ্যই টেকসই প্রক্রিয়া হবে। আমরাও আশা করি এই প্রত্যাবাসন ধারাবাহিক এবং টেকসই হবে। সেটা যেন নিশ্চিত করা যায়। তাদের দীর্ঘ অবস্থানের ফলে নানারকম আর্থসামাজিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে বৈষয়িক টানাপোড়ন ও মানষিক দূরত্ব বাড়ছে।

এছাড়া রোহিঙ্গাদের নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা ও আশংকাজনকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে।তারমানে এই নয় যে তারা অনাদিকাল ধরে থেকে যাবে। এই রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় জনগণের অস্তিত্ব হুমকির মুখে, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জননিরাপত্তা, বন পাহাড়, প্রাকৃতিক পরিবেশসহ অনেক কিছু ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এছাড়াও নিজেদের মধ্যে অনেকগুলো গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মারামারি, খুনাখুনি করে প্রায় ক্যাম্পগুলোতে রক্ত ঝরছে। এই সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশ আরও বড় ধরনের জটিলতায় পড়বে। তাই আমাদের প্রত্যাশা প্রত্যাবাসন যেন ধারাবাহিক এবং টেকসই হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। জি ২০ শীর্ষ সম্মেলনে ঘোষিত এক বিশ্ব এক পরিবার ভাবনা থেকে যেন বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত এই জনগোষ্ঠীটি বাদ পড়ে না যায়। বিশ্ব সমপ্রদায় যেন সমস্যাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা যেন একটা নিরাপদ ভূমি রেখে যেতে পারি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার সমস্যা ও উত্তরণের পথ
পরবর্তী নিবন্ধজি-২০ সম্মেলন ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে না বলা কথা