যানজটে নাকাল নগরবাসী : চাই নিরাপদ সড়ক

নেছার আহমদ | বুধবার , ২ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৩০ পূর্বাহ্ণ

শহর নগর বন্দরে বর্তমানে সড়কের প্রশস্ততা বেড়েছে, বেড়েছে সড়কের সংখ্যাও কিন্তু সংকীর্ণ সড়কে যে দীর্ঘ যানজট ছিল তা থেকে মুক্তি মেলেনি এখনো। ট্রাফিক বিভাগের অব্যবস্থাপনা, অদক্ষ চালক, আইন না মানার প্রবণতা শহরে যানজট সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। নিয়মিত পত্র পত্রিকায় যানজট এবং এর প্রতিকারে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর কাড়তে পারেনি।
যানজট নিরসনে অনেক সভা সেমিনার এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত সভা বা পরামর্শ থাকলেও তা কোনো সময়েই বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে সেখানে শুধু আমাদের দেশেই চোখে পড়ে সেই মান্ধাতা আমলের ট্রাফিক ব্যবস্থা। ট্রাফিক পুলিশ হাত উঠিয়ে সিগন্যাল দিয়ে গাড়ি চলাচল ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন। বিভিন্ন সময়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক সিগন্যাল সিস্টেম চালু করা হলেও তা বর্তমানে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সেগুলোর কার্যকারিতা কোথাও নেই বললেই চলে। আজ হতে ৩০/৪০ বছর আগেও আমরা দেখেছি নিয়মিত ট্রাফিক সপ্তাহ পালিত হতো। সে সময়ে গাড়ির চালক ও পথচারিদেরকে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী নেয়া হতো। আমরা আধুনিক হয়েছি ঠিকই কিন্তু পুরানো জড়াজীর্ণ ব্যবস্থাকে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। দিন দিন তা খারাপের দিকেই যাচ্ছে। প্রথমেই বলেছি, রাস্তার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই কিন্তু বর্ধিত রাস্তা এবং ফুটপাতের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না।
যানজটের কারণে মৌলিক কিছু সমস্যার মুখে আমরা। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এ সমস্যার প্রতিকার ও উপায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। যানজটের কারণে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্কুল-কলেজে যাওয়া আসার ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীরা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্কুল শেষে বিনোদন ও খেলাধুলার সময়টা যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে। বায়ু দূষিত হচ্ছে। গাড়ির মধ্যে বসে থাকার কারণে হাঁটু, কোমড় ও মেরুদণ্ডের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। যানজটের কারণে প্রজন্মের মধ্যে বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগে অনীহা সৃষ্টি হচ্ছে। যে সব স্থানে যানজট প্রচণ্ড সেখানে পরিকল্পনা অনুযায়ী মহানগরে ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন।
যানজটের বাইরে দেশব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার দিকে নজর দিলেই প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর বিভৎসতা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা হতে পরিত্রাণের জন্য এবং নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যে সব দপ্তরে দায়িত্ব রয়েছে তারাই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তেমন তৎপর নয়। ফলে প্রতিবছরই সড়ক দুর্ঘটনার প্রাণহানির সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। ২০১৭ সাল থেকে ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হচ্ছে। এবছরও দিবসটি মহাসমারোহে পালিত হয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের যে প্রতিপাদ্য তা মূলত পথচারী, যাত্রী এবং সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ কিভাবে সড়ক পারাপার হবে ও যাত্রীদের আচরণ কী হওয়া উচিত-এটিই মূল বিষয় ছিল। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মসূচি শোভাযাত্রা ও পথচারীদের সচেতনতা সৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ ছিল।
জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের জন্ম ১৯৯৫ সালে। কাউন্সিলের অধীনে ১৯৯৭ সালে থেকে দু্‌’বছর মেয়াদি নিরাপদ সড়ক সংক্রান্ত কৌশলগত পরিকল্পনা করে আসছে সরকার। ২০১৭ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা হচ্ছে। প্রতিবারই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি অর্ধেক কমানোর কথা বলা হয়েছে। তবে কিভাবে দুর্ঘটনা কমানো হবে-এর কারিগরি বা বৈজ্ঞানিক কোনো পদ্ধতি দাঁড় করাতে পারেনি সরকার। দুর্ঘটনা কমাতে সারা বছর ধরে যে কর্মসূচি থাকার কথা, এরও কোনো উল্লেখ নেই পরিকল্পনায়। নামকাওয়াস্তে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে কী কাজ করবে, এর ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বাধীন সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম হলেও নিরাপদ সড়ক সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মনোযোগ নেই তাদের। বরং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর চার লেন সড়ক, উড়ালসড়ক, মেট্রোরেলসহ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে তৎপর। সড়ক আইন বাস্তবায়ন, পথচারী পারাপার নিশ্চিত করা, চালকের লাইসেন্স ও যানবাহনের ফিটনেস নিশ্চিত করা, যানবাহনের গতিনিয়ন্ত্রণ-এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না।
২০১১ সালে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিল সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। উদ্দেশ্য ছিল সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে করণীয় ঠিক করা। কমিটি ৮৬ দফা প্রস্তাব দিয়েছিল। এর বেশির ভাগই চালক, যানবাহন ও সড়ক-সংশ্লিষ্ট সংস্কার প্রস্তাব ছিল। ওই প্রতিবেদন এখন বিআরটিএতে পড়ে আছে।
বিআরটিএ, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), বাংলাদেশ পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে রোড সেফটি উইং (নিরাপদ সড়কসংক্রান্ত শাখা) আছে। কিন্তু এসব দপ্তর সড়ক দুর্ঘটনার ওপর পূর্ণাঙ্গ কোনো গবেষণা করেনি। পুলিশ শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব মামলা হয়, এর নথি ধরে হতাহতের একটা হিসাব দেয়। সেটা ধরেই বেশির ভাগ বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি গবেষণা করে থাকে।
যান চলাচলের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বড় অংশীদার বিআরটিএ। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যসচিব ও সংস্থাটির চেয়ারম্যান। কিন্তু নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে সারা বছর তাদের তেমন তৎপরতা দেখা যায় না। প্রতিবছর ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসকে কেন্দ্র করে কিছু পোস্টার-লিফলেট বিতরণ, সভা সেমিনার করে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে কিছু চালকের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁদের রোড সেফটি উইংয়ের বাজেটই বছরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। এর একটা অংশ চলে যায় বৈঠক আপ্যায়নে। বাকিটা পোস্টার ছাপিয়ে ব্যয় করা হয়।
সওজ ও এলজিইডি দেশের প্রায় সব সড়কের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। দুটি সংস্থারই রোড সেফটি ঊইং আছে। তবে তাদের দৃশ্যমান কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না। পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে সংস্থাটি সচেতনতামূলক কিছু কর্মসূচী পালন করে। ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশকে কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এর বাইরে জনসচেতনতা ও বাস্তব ভিত্তিক পরিকল্পনা নজরে পড়ে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালের সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১০ বছর আগে দুর্ঘটনার যে ঝুঁকি ছিল তা আরও বেড়েছে। এর মধ্যে সড়ক চওড়া হয়েছে, যানবাহনের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে কিন্তু সড়ক ও যানবাহনের ত্রুটি রয়েই গেছে। সড়কে প্রতিনিয়ত মৃত্যু যেন ওঁৎপেতে রয়েছে। ফলে দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি বাড়ছে।
সড়ক ও মহাসড়ক চওড়া করার পর গাড়ি, দূর পাল্লার বাস ও ট্রাকের গতি বেড়েছে। কিন্তু একই সড়কে ধীর গতির ব্যাটারি রিঙা, অটোরিঙা চলাচল বন্ধ হয়নি। মহাসড়কের উপর হতে বাজার এবং দোকানপাট বন্ধ করা হয়নি। মাঝে মধ্যে হঠাৎ করে দেখা যায় অভিযান চালিয়ে মহাসড়কের উপর স্থাপিত দোকান উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু দুয়েকদিন পর অদৃশ্য হস্তক্ষেপে তা আবার নির্মাণ হয়ে যায়।
বর্তমান সময়ে উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ। দেশের আকাশ ছোয়া উন্নয়ন বিশ্বের নিকট বিস্ময়। অভ্যন্তরীন শহর, নগর ও মহানগরীতে ট্রাফিক অব্যবস্থায় যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিথর দাঁড়িয়ে থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রম ও সময়ের অপচয়দেশের বিস্ময়কর উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বর্ণিত বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সময়োপযোগী এবং বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সকল পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এবং জনপ্রতিনিধিদেরকে সংশ্লিষ্ট করে যদি আধুনিক চিন্তা চেতনায় এবং দেশীয় স্থানীয় পরিবেশ ও অবস্থানকে মাথায় রেখে কাজ করলে অচিরেই দেশ যানজট হতে মুক্তি ও সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধজেল হত্যা : বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়