মৃত্যুবার্ষিকীতে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

| বুধবার , ২১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ

সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য গৌরবময় ও প্রাচীন। কলকাতার বাইরে গোটা বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রথম দৈনিক (জ্যোতি : ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ), হিমালয়ান উপমহাদেশে মহিলা সম্পাদিত প্রথম দৈনিক পত্রিকা (সরহদ : ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ), তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সিনেমা ও বিনোদন পত্রিকার (উদয়ন : ১৯৫০) প্রকাশ ঘটে চট্টগ্রামে। তাছাড়া চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা চট্টগ্রামের বাইরেও তাঁদের কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে আছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমবিভ্যাহারে গণবাণী, লাঙ্গল, নবযুগ পত্রিকার সম্পাদক/প্রকাশক কমরেড মুযফফর আহমদ (সন্দ্বীপ), বাংলা ভাষায় মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত গ্রন্থকার, রাজনীতিবিদ মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (চন্দনাইশ), সাপ্তাহিক রক্তকেতু ও মুসলিম জগৎ-এর প্রকাশক-সম্পাদক আবদুর রশিদ সিদ্দিকী (চকরিয়া), কলকাতার দি স্টেটসম্যান পত্রিকার প্রথম ভারতীয় সহকারী সম্পাদক অধ্যাপক বীরেন্দ্র বিনোদ রায় (রাউজান), কলকাতার দৈনিক প্রত্যহ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মাসিক সাম্যবাদীসহ একাধিক পত্রিকার সম্পাদক লোকমান খান শেরওয়ানী (চট্টগ্রাম শহর)। এছাড়াও আছেন কবি দিদারুল আলম, আবদুল মোনেম ও ফরুক আহমদ নেজামপুরী। তাঁরা রেঙ্গুন থেকে বাংলা ভাষায় পত্রিকা বের করেন। সাংবাদিকতায় আরো যে ক জন পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে কালীশংকর চক্রবর্তী (পটিয়া), আলী আহমদ ওয়ালী ইসলামাবাদী (পাঠানটুলী), ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক (রাউজান) অন্যতম। এঁদের পরবর্তী প্রজন্মের সাংবাদিক হিসেবে অনন্য অবদান রেখেছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ।

কোহিনূর প্রেসে মামা ও পরবর্তী সময়ে শ্বশুর ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের সঙ্গে কাজ করতে করতে তাঁকে অনুসরণ করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। ইঞ্জিনিয়ার খালেকও আবিস্কার করেন অধ্যাপক খালেদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য। তাঁকে সামনে রেখে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে প্রকাশ করেন দৈনিক আজাদী। পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ইঞ্জিনিয়ার খালেক নিজেই। তাঁর মাধ্যমে দৈনিক আজাদী দিয়েই শুরু অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের সাংবাদিকতা-জীবন। ধীরে ধীরে রপ্ত করে নেন পত্রিকার সকল কাজ। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন আদর্শ সাংবাদিক হিসেবে। দৈনিক আজাদী প্রকাশের মাত্র ২ বছর পর ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। তাঁর মৃত্যুর পর আজাদীর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হয় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে।

সাংবাদিকতায় আগমন বিষয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকই আমাকে নিয়ে এলেন সাংবাদিকতায়। এমন একজন মহাত্মার পরশ নিয়ে আমি বড় হয়েছি, যিনি ছিলেন নিখাদ খাঁটি মানুষ। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে এসে তাঁর ইচ্ছে হলো চট্টগ্রাম থেকে একটি দৈনিক পত্রিকা বের করবেন। একদিন আমাকে ডেকে নিয়ে বসালেন। বললেন, খালেদ আমার দীর্ঘ দিনের সখ ও ইচ্ছা, চট্টগ্রাম থেকে একটি দৈনিক প্রকাশ করার। তুমি যদি আমার সাথে ওয়াদা করো, পত্রিকার সাথে থাকবে, তাহলে আমি উদ্যোগ গ্রহণ করবো। আমি তাঁর কাছে ওয়াদা করলাম। তিনি কঠোর পরিশ্রম করে সত্যি সত্যি দৈনিক আজাদী নামে একটি পত্রিকার অনুমোদন নিয়ে এলেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীর যাত্রার সাথে তিনি আমাকে সাংবাদিক বানালেন। তাঁর মৃত্যুর পর আমি হলাম সম্পাদক। এই হলো আমার সাংবাদিকতা জীবনের পদযাত্রা।

অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন একজন আদর্শবান সাংবাদিক। সাংবাদিকতার নীতি থেকে কখনো বিচ্যুত হন নি। পরমতসহিষ্ণুতার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সংবাদ-প্রতিবেদন আর সম্পাদকীয় মন্তব্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার দুরূহ কাজটি সুচারুরূপে সম্পাদন করেছেন অধ্যাপক খালেদ। সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারে তিনি যেমন সত্যনিষ্ঠ থাকার চেষ্টা করেছেন, তেমনি সম্পাদকীয় নীতিতে দেশের সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্কের নীতির সম্মানজনক সঙ্গতি রক্ষা করেছেন। সংবাদ প্রতিবেদনে যার যা প্রাপ্য কিংবা পাওয়া উচিত, তা তিনি অকৃপণভাবে দিয়ে গেছেন এবং এর পাশাপাশি সম্পাদকীয় মন্তব্যে বিষয় কিংবা ঘটনা বিশেষের মূল্যায়নপূর্বক নির্দেশনা দিয়েছেন।

অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ বহু ঝক্কি-ঝামেলা ও ধাক্কা সফলভাবে মোকাবেলা করেছেন। ঝুুঁকিপূর্ণ সাংবাদিকতা পেশায় তিনি ছিলেন সফল সৈনিক। নীতির ব্যাপারে ও সত্যানুসন্ধানে তিনি ছিলেন আপসহীন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে কোনো নীতি বিবর্জিত কর্মে তিনি লিপ্ত হন নি। সত্য ও ন্যায়ের দৃঢ় সমর্থক হিসেবে কাজ করেছেন। আদর্শ ও পেশার মর্যাদা সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রসৈনিকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

অভিজ্ঞ কোনো সাংবাদিক না থাকা সত্ত্বেও ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক যেমন কোহিনূর পত্রিকা ও প্রেসে সফল হন, তেমনি দৈনিক আজাদীকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। সম্পাদক হিসেবে তিনি অতুলনীয়। পত্রিকার জগৎকে নিজের জগৎ হিসেবে রূপান্তর করেন তিনি। সম্পাদকীয় লেখা, সংবাদ লেখা থেকে শুরু করে প্রুফ দেখার কাজও করতেন তিনি। সবকিছুর তদারকি তাঁর হাতে। নিয়মিত বসতেন নিউজ টেবিল। এপিপি, এএফপি, রয়টার্স, বাসস পরিবেশিত ইংরেজি নিউজ থেকে অনুবাদ করতেন। কখনো কখনো প্রেস রিলিজ থেকে সংবাদ তৈরি করতেন।

কখনো কখনো অন্যের তৈরি নিউজের ওপর চোখ বুলাতেন। ছোটোখাটো ত্রুটি থাকলে তা শুদ্ধ করে দিতেন আর বেশি কিছু বিচ্যুতি ঘটলে তিনি নিউজটি নিজে করে নবীনদের সামনে তুলে ধরে বলতেন; পড়ুন। মিলিয়ে দেখুন। অধ্যাপক খালেদ শুধু সম্পাদক হিসেবে নন, শুধু সাংবাদিক হিসেবেও নন, সামাজিক ব্যক্তিসত্তা হিসেবে অনেক অবদান রেখেছেন। ১৯৬২ থেকে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় একচল্লিশ বছর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক খালেদ। বাংলাদেশে এতো দীর্ঘদিন কেউ একটা দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন না। মনে হয় না আগামীতেও তাঁর এ কৃতিত্ব কেউ স্পর্শ করতে পারবে! আজ মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে