মাস্টার রুহুল আমীন চৌধুরী শিক্ষকতায় অনন্য আদর্শ

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী | শনিবার , ১৫ অক্টোবর, ২০২২ at ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ

মূল্যবোধের সংকট, নৈতিকতার সংকট ও সততার সংকটে ডুবে যাওয়া এ সমাজে শিক্ষকতায় ও জনসেবায় উৎসর্গীকৃত উজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর নাম শ্রদ্ধায় ও আবেগে এখনো মানুষের মুখে উচ্চারিত হয়। শিক্ষকতার আদর্শে অনন্য দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের গর্ব মাস্টার রুহুল আমীন চৌধুরী। সরকারি চাকরির লোভ বা ব্যবসা বাণিজ্যের মোহ থেকে মুক্ত থেকে তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন ৩৪ বছর। জ্ঞানের অন্বেষণে ছুটে যান কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ। আইনশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি নেবার অদম্য স্পৃহা থাকলেও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও দাঙার কারণে গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে দ্রুত ফিরে আসেন মাতৃভূমি চট্টগ্রামে। দীর্ঘ ৩২ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদেও দায়িত্ব পালন করে এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেছেন। তাঁর কঠোর অনুশাসন ও জনসেবার স্মৃতি এখনও মানুষের হৃদয়ে কিংবদন্তীতুল্য হয়ে আছে। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে ধূলোবালি মেখে ও রোদে পুড়ে একদিকে তিনি পরমনিষ্ঠায় ও অনন্য সাধনায় শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেছেন, অন্যদিকে অক্লান্ত পরিশ্রমে অনাবাদী জমিতে ঘাম ঝরিয়ে কৃষি খামার গড়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছেন।
সবুজ বৃক্ষলতার অনন্য বৈচিত্র্যে এবং উঁচু নিচু টিলার অনুপম সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ রাউজানের হলদিয়া। চোর-ডাকাতের উপদ্রব এবং বন্যপ্রাণীর উৎপাতসহ নানা প্রতিকূল পরিবেশে কঠোর পরিশ্রমে এলাকায় জনবসতি গড়ে তোলেন মাস্টার রুহুল আমীন চৌধুরী। গোপনে অনেক পরিবারকে অর্থ বা জমি জমা দিয়ে সহায়তা করেছেন। চোর-ডাকাতের ভয়ে এলাকার মানুষ আতঙ্কিত থাকত। কিন্তু দস্যুতার অপরাধ দমন করেছেন নির্ভয়ে, দৃঢ়চিত্তে। ব্রিটিশ আমলে তিনি জুরি বোর্ডের সদস্য পদ অলংকৃত করেন এবং অনেক বিবাদ-বিরোধ মীমাংসা করেছেন। বিচক্ষণতা ও দৃঢ়তা নিয়ে ন্যায় বিচারের প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কঠোর উদ্যম ও সাহসে অপরাধ দমন করে খ্যাতি অর্জনের স্বীকৃতি পেয়েছেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে অভিনন্দন পেয়ে। চট্টগ্রামের ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে বিশেষ ধন্যবাদপত্র পাঠিয়েছিলেন। ১৯২৭ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রীয় এক সংবর্ধনায় তাঁকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পুরস্কার হিসেবে সনদপত্র, ঘড়ি ও সোনার আংটি উপহার দেয়া হয়। এ ঘটনা সমসাময়িক ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল।
ভূগোল শাস্ত্রে তাঁর প্রতিভা ও পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। ব্রিটিশ আমলে রাউজান ‘আরআরএসি ইন্সটিটিউশন’ ছিল মেধাবীদের জন্য শিক্ষার মানে অনন্যসাধারণ এক প্রতিষ্ঠান। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের সূচনা ১৯২৯ সালে। তিনি ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রধান শিক্ষক। বাংলা, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। এ স্কুলে তাঁর শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ও প্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করে এ প্রতিষ্ঠানকে গৌরবান্বিত করেছেন। অসাধারণ মেধাবী শিক্ষক হিসেবে ভূগোল শাস্ত্রে তাঁর পাঠদান পদ্ধতি ছিল বিস্ময়কর। শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে স্থাপিত বিশ্ব মানচিত্রের দিকে দৃষ্টিপাত না করেই পেছন থেকে লাঠি উঁচিয়ে বিভিন্ন দেশ বা মহাদেশকে নির্ভূলভাবে মানচিত্রে চিহ্নিত করে শিক্ষার্থীদের তাক লাগিয়ে দিতেন। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় ফাঁকি দিলে তাদের জন্য অনিবার্য ছিল কঠোর শাস্তি, তারাই পরবর্তীতে তাঁর কঠোর অনুশাসনের ছোঁয়ায় সাফল্যের শিখরে উঠে সমাজকে আলোকিত করেছেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন বিচারপতি আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী, কাস্টমস ও ভ্যাট কমিশনার শহীদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রনজিত দে, দৈনিক আজাদী পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মাদ খালেদ, চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রনজিত ধর, বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের খ্যাতিম্যান কর্মকর্তা এজাহারুল ফয়েজসহ আরও বহু বরেণ্য ব্যক্তিত্ব।
১৯৭০-এর দশকে গ্রামে সুপেয় পানির প্রচণ্ড অভাবে পুকুরের পানি ছিল গ্রামবাসীদের পানীয় জলের একমাত্র সম্বল। এ কষ্ট অনুভব করে নিজ বাড়ির প্রাঙ্গণে নলকূপ স্থাপন করে জনসাধারণের পানীয়জলের অভাব দূর করেন। অগণিত মানুষ ও পশুপাখির প্রাণ তৃপ্ত হয় এ নলকূপের সুমিষ্ট জলধারায় এ পানিতে সিক্ত হয় আশে পার্শ্বের কৃষি জমি, যা সেচের সংকট দূর করে।
রুহুল আমীন চৌধুরী পাঁচপুকুরিয়া বিশাল কৃষি খামার গড়ে তুলেন। খামারবাড়িতে তিনি মসজিদও নির্মাণ করেন। এছাড়া ইয়াসিন্নগর জুবিলী প্রাথমিক বিদ্যালয়, জানিপাথার বিদ্যালয় এবং জুবিলী ঈদগাহ মাঠ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ার পেছনে তাঁর অনন্য অবদান ছিল। কষ্টার্জিত অর্থে দুর্গম অঞ্চলে বহু জমি কিনে তিনি চাষাবাদযোগ্য করে কৃষি উৎপাদনে বিশাল অবদান রাখেন। প্রচুর ভূ-সম্পত্তি তিনি জনকল্যাণে ওয়াকফ করে যান। তিনি তাঁর অনুজ যথাক্রমে বজলর রহমান চৌধুরী, বদিউল আলম চৌধুরী, ফজলুল হক এবং নজমুল হককে পরম আদরে লালন-পালন এবং তাদের পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করেন। তাঁদের অনেকেই রেঙ্গুন ও কলকাতায় পড়াশোনা করেন। তাঁর সহোদর এ্যাডভোকেট নজমুল হক কলকাতা থেকে আইন শাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করে চট্টগ্রাম বারে অত্যন্ত সৎ, নির্মোহ ও খ্যাতিমান আইনজীবী হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। হজ্ব পালনকালে মক্কা শরীফে তিনি ইন্তেকাল করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হিন্দু সমপ্রদায় অধ্যুষিত ডাবুয়া গ্রামে অভিযান চালালে প্রাণ রক্ষায় অনেকে পালিয়ে যায়। এ ভীতিকর পরিবেশে অসহায় দুটি হিন্দু পরিবারকে তাঁর বাড়িতে ৯ মাস নিরাপদ আশ্রয় প্রদান করেন। রাউজানে হিন্দু সমপ্রদায় এবং নিকটবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম সমপ্রদায়ের কাছে রুহুল আমীন চৌধুরী ছিলেন শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র। রাউজানে একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল, ‘রুহুল আমীন চৌধুরীর বাড়ি, জ্ঞানের বাড়ি।’ জমিদারতান্ত্রিক আচরণ নয়, বরং সততা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য এ পরিবারের স্বতন্ত্র ঐতিহ্য রয়েছে। অর্থ-বিত্তের প্রতিযোগিতায় ও ভোগবাদী জীবনের তাড়নায় এখন বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রামের সৌন্দর্য ও প্রকৃতির স্বাভাবিকতা। টিলাসমৃদ্ধ ইয়াসীন্নগরগ্রাম দালান-কোঠায় ভরে যাচ্ছে, অথচ অর্ধশত বছরের প্রাচীন টিনের চালার মাটির তৈরি বাড়ি ছিল রুহুল আমীন চৌধুরীর নির্মোহ জীবনযাপনের স্মারক। সারা দিন পরিশ্রম শেষে ক্লান্তিমাখা অবসন্ন শরীরে ঘর্মাক্ত শরীর শীতল করতে সামান্য হাতপাখা ছিল তাঁর সম্বল। পরিশ্রান্ত শরীর ঠাই পেত অতিসাধারণ কাঠের চৌকিতে। শাক-সবজি, পুকুরের মাছ- এই ছিল তাঁর দৈনন্দিন খাবার। তাঁর তিন পুত্র যথাক্রমে প্রধান হিসাব রক্ষক (অব:) মরহুম মোজাম্মেল হক চৌধুরী, প্রখ্যাত শিশু চিকিৎসক মরহুম ডাঃ মোমিনুল হক চৌধুরী এবং বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মাহফুজুল হক চৌধুরী। মাস্টারবাড়ির এ পরিবার কখনও অর্থবিত্তের লোভে ডুবে যায়নি। সন্তানরা কখনো নীতিহীনতা ও পথভ্রষ্টতার শিকার হয়নি। এ পরিবারে বর্তমান প্রজন্মের সবাই সুশিক্ষা, সততা ও বিনয়ী আচরণের জন্য সবার প্রিয় পাত্র। ব্রিটিশ যুগের গ্র্যাজুয়েট, জুরি বোর্ডের সদস্য, জনসেবামূলক দায়িত্বের বহুমাত্রিক পদে থেকেও রুহুল আমীন চৌধুরী ছিলেন নিষ্কলুষ চরিত্রের ব্যক্তি। প্রমোদ বিলাসিতায় না কাটিয়ে অর্ধ শতাব্দী প্রাচীন টিনের চালার ‘মাটির তৈরি’ ঘরে কেটেছে তাঁর জীবন। মাটির ঘরেই মাটির তৈরি মানুষের অন্তিম যাত্রা, এটিই পরম সত্য ও নিরেট বাস্তবতা। আজ ১৫ অক্টোবর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করে পরকালীন শান্তির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করছি।
তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে নেই আড়ম্বর বা আনুষ্ঠানিকতার ছোঁয়া, কিন্তু আছে অগণিত মানুষের দোয়া। অন্তিম যাত্রাকালে তিনি রেখে যাননি বিপুল অর্থবিত্ত বা আলীশান দালান কোঠা। রেখে গেছেন সৎ, শিক্ষিত ও বিনয়ী তিন পুত্র এবং তাঁদের বংশধর, যাঁরা স্ব স্ব পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত। সময়ের বিবর্তনে ইতিহাসের পাতা থেকে মানুষ হারিয়ে যায়, কিন্তু মন থেকে হারিয়ে যায় না। মানুষের হৃদয়ে তাঁদের স্মৃতি অম্লান। ভোগবাদীতা ও স্বার্থপরতার ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত এ সমাজে ত্যাগে ও সততায় দীপ্যমান মাস্টার রুহুল আমীন চৌধুরীর নিঃস্বার্থ সমাজসেবা এবং নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকতা সমৃদ্ধ যে জীবনযাপন, তা বর্তমানে মূল্যবোধে দুর্বল এ সমাজে সৎ ও সুন্দর জীবন গড়ার অনন্য দিকদর্শন।
লেখক : মহাপরিচালক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর

পূর্ববর্তী নিবন্ধচোখ ওঠা, সচেতনতার বিকল্প নেই
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে