ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ

ট্রেন প্লাটফর্মে ড্রাইভার চম্পট

সব দেশে ভালো-মন্দ থাকে। আমরা মধ্যম দেশ হলেও এখানেও অনেক ভালো কিছু আছে। এখানে বিশেষ করে , উচ্চবিত্তদের জন্য সত্যিই এক ‘বেহেশতী দেশ’। কারণ কিছু সুবিধা তারা বিত্তের বিনিময়ে লাভ করে। পাশ্চাত্য দেশে যা না বিত্ত দিয়ে, না ক্ষমতা দিয়ে সম্ভব। করোনাকালীন সমাবেশ করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা হারিয়েছেন-এটা তৃতীয় বিশ্বে অসম্ভব ব্যাপার।
ভালো মন্দের একটা ব্যক্তিগত গল্প দিয়েই শুরু করি। আমার বাসায় বিদ্যুতের সমস্যা নিরসনে চার পাঁচ জনের কয়েকজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি কাজ করছিল। তাদের ভাষা ও কথাবার্তায় বুঝলাম ওরা চট্টগ্রামের বাইরের এবং একই এলাকার লোক। হয়তো একজন প্রথমে এসে আরেকজনকে নিয়ে এসেছে। জানতে চাইলাম তাদের বাড়ি কোথায়। আট বছর যাবৎ চট্টগ্রামে কাজ করছে। সবার বাড়ি কুষ্টিয়ায়, দুষ্টামি করে তাদের কাছে জানতে চাইলাম চট্টগ্রামে তাদের কি ভালো লাগে না। অনেকে জিজ্ঞেস করে চট্টগ্রাম কেমন লাগে? কি ভালো লাগে ইত্যাদি। কি ভালো লাগে না জিজ্ঞেস করায় ছেলেগুলো থতমত খেয়ে গেল। আমি কি না কি মনে করি। একজন সাহস করে বলল চট্টগ্রামের কিছুই তাদের ভালো লাগে না। জানতে চাইলাম সবচেয়ে কি খারাপ লাগে। সমস্বরে বলল আপনাদের ভাষা। এটা কোন মানুষ বোঝে? আস্ত একটা জংলি ভাষা তারপর কি খারাপ লাগে? সবাই বলল,আপনাদের রান্না। গুঁড়ো মসলাতে কেউ খায়? ওদের কুষ্টিয়ায় সব ফ্রেশ। আর বাটা মসলার রান্না। তাদের ভালো না লাগাটা যৌক্তিক। আজন্ম তারা এক ভালোলাগায় জীবন কাটিয়েছে। চট্টগ্রামের অজানা পরিবেশ, রান্না ভালো না লাগারই কথা।
লন্ডন ও যুক্তরাজ্যের আমার ভালো না লাগার জিনিসগুলো ও আজন্ম লালিত ভালোলাগার সাথে নতুন দেশের আপেক্ষিক ভালো না লাগা। প্রথমে বলি ট্রেন স্টেশনে ফেলে ড্রাইভারের ইঞ্জিন রুম ত্যাগ। বার্মিংহাম থেকে লন্ডনের ইউস্টন স্টেশনে যাব ট্রেনে। বাসের সময় বেশি লাগে তাই ট্রেনে চেপে বসলাম। আড়াই ঘন্টার মত ভ্রমণ। ছোটখাটো অনেক স্টেশনেই থামলো। মাঝামাঝি দূরত্বের একটি বড় স্টেশন নর্থহামপটন। শহরটা সিলভার স্টোন সার্কিট ট্রাক ও ব্রিটিশ কার রেস (প্রিক্স) এর জন্য বিখ্যাত। এই শহরে মার্সিডিজ গাড়ির ইঞ্জিন তৈরির একটা কারখানাও বিখ্যাত। যাহোক, এক স্টেশনে ট্রেনগুলো ২-৩ মিনিট এর বেশি থামে না। দেখলাম ট্রেনের দু তিনজন ক্রু তাদের ট্রলি ব্যাগ নিয়ে আরামসে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ১০ মিনিট পর ট্রেনে ঘোষণা করা হলো যে, এখানে ট্রেন ড্রাইভার বদলি হওয়ার কথা, যার নেমে যাবার কথা সে হেঁটে চলে যাচ্ছে। যার বদলি ড্রাইভার হিসেবে ইঞ্জিন চালানোর কথা তার আসতে দেরি হচ্ছে। বদলি ড্রাইভার আসলেই ট্রেন ছাড়বে। জনগণ ভাবলেশহীন ভাবে গল্প করছে। ফ্ল্যাটফর্মে হাঁটছে। দশ মিনিট পর পর ঘোষণা হচ্ছে বদলি ড্রাইভার এর সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না ইত্যাদি। এমনিভাবে ৭০ মিনিট পার হল। তারপরও কিন্তু বদলি ড্রাইভার এর খবর নেই। অবশেষে অন্য একটা ট্রেনে সব যাত্রীকে তুলে গন্তব্য স্টেশনে নিয়ে গেল। আমার খুব হাসি লাগলো এই ভেবে যে, বদলি ড্রাইভার আসার আগেই চলতি ড্রাইভার আস্ত একটা ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ফেলে চলে গেল। যে নেমে গেল তার ডিউটি শেষ। অতএব সে নেমে পড়ল। যার ডিউটি শুরু তার দেখা নেই। মোবাইলও বন্ধ। এখানে ড্রাইভারদের ইউনিয়ন (সংগঠন) খুব শক্ত। ওদেরকে হয়তো কিছু করাও যাবে না। আমাদের দেশে অনেক অসঙ্গতির মাঝেও ট্রেন ফেলে ড্রাইভার চলে গেলে যাত্রীরাই তাকে ধরে রাখত। বিলাতে বাস ড্রাইভার এর সংকট আরো প্রবল।
বিলাতে আরেকটা সংকটের বিভাগ হল NHS বা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস। সিস্টেমটা বড় জটিল, কিন্তু সার্বজনীন। সার্বজনীন হওয়াতে রোগীর ভিড় আরো বেশি। তবে বিশেষজ্ঞ পেতে অনেক সময় ১৮ থেকে ৩৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয় (২৭-৮-২২ গার্ডিয়ান)। তথ্য ও পরিসংখ্যান বাদ দিয়ে জরুরি বিভাগের (AC accident & Casualties) একটা অভিজ্ঞতা বলতে চাই। কোন এক খাবার থেকে সন্ধ্যায় আমার এক severe rash উঠল। সারা গায়ে চুলকানি, চোখ মুখ ঠোঁট ফুলে গেল। ভয়াবহ অবস্থা। দৌড়ে হাজির হলাম এক ইমারজেন্সিতে। দেখলাম বেশ ভির। আমিও টিকিট নিলাম। আমার ওয়েটিং টাইম তিন ঘন্টা ৩৮ মিনিট। এত ওয়েটিং হলে এমার্জেন্সি কি করে হলো? কোন শক এ পৌঁছে কিনা ভয়ে ভয়ে কাউন্টারে বললাম, ৩৮ মিনিট কমালো, দু-একজন অ্যাক্সিডেন্টের রোগী, মহিলা রোগী ও দেখলাম। অনেকে কাতরাচ্ছে। কিন্তু সহ্য করা ছাড়া উপায় নাই। যাহোক তিন ঘন্টা পর আমার ডাক এলো। তরুণ বয়সী ডাক্তার দেখলাম। সে আমার রোগের হিস্ট্রি নিতে চাইল। তাকে বললাম আমি অ্যালার্জির ডাক্তার। তুমি আমাকে অমুক ওষুধ দাও। সে তার ল্যাপটপে ওই ওষুধ তাদের তালিকায় পেল। আমাকে প্রেসক্রিপশন দিল। তখন রাত নয়টা পাঁচ মিনিট। যখন হাসপাতালের ফার্মেসিতে গেলাম তখন তারা টাকা নেওয়ার যন্ত্র বন্ধ করে দিল। বলল রাত ৯ টায় বন্ধ হয়। অনেক অনুরোধ করলাম কিছুই হলো না। তারাই ঘন্টার দূরত্বে নাইট ফার্মেসিতে যেতে বলল। অবশেষে সেখান থেকে ঔষধ নিলাম। আমাদের দেশের অন্তত ইমার্জেন্সির সাথে তুলনা করলাম। তিন ঘন্টা ইমারজেন্সিতে ডাক্তার না দেখলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে অবস্থা হতো।
সর্বশেষে যুক্তরাজ্যের কর ব্যবস্থার হ য ব র ল অবস্থা। যারা শিক্ষিত ও উচ্চকর প্রদানকারী তারা ভীষণভাবে নাখোশ। যারা হতদরিদ্র ক্যাটাগরির, বেকার ওরা খুব খুশি। কারণ ওরা সরকারি বেনিফিট ও পায় আবার ক্যাশ পেমেন্টে কামায় ও করে যার কোন ট্যাক্স দেয়ার গরজ হয় না। যুক্তরাজ্যের অনেক দক্ষ পেশাজীবী ট্যাক্স দেওয়া সংক্রান্ত জটিলতায় বিদেশে পাড়ি দেয়। যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যার উপরের ১% মানুষ সমস্ত আয়করের ২৫ পার্সেন্ট প্রদান করে, আর আয়করের ৯০% আসে সর্বসা করলে সর্বসাকুল্যে ৫০% মানুষ থেকে। তাহলে বাকি ৫০% লোক শুধু বেনিফিট খায়। ২০১২-১৫ সালে ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলনের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে ২৭% বেনিফিট ফ্রড (Fraud) হচ্ছে যুক্তরাজ্যে। অর্থাৎ বড় আয়ের মানুষগুলো বেজায় নাখোশ। ২০২০-২১ সালে ২১২ বিলিয়ন পাউন্ড সোশ্যাল বেনিফিট দেওয়া হয়। ২০৩৩ সালের পরে পুরো সোশ্যাল বেনিফিট ফান্ড শেষ হয়ে যাবে। এটা একটা ভয়াবহ অবস্থা।
যুক্তরাজ্যের আর্থিক অবস্থা অনেকটা পুরাতন জমিদারদের Decay বা ক্ষয় ও লয়ের মত। যুক্তরাজ্যে অনেকগুলো নিয়ম-কানুন আছে যা রাষ্ট্রের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক নয়। কিন্তু ভোট ব্যাংক এর কারণে রাজনৈতিক দল দুইটা তা শুনেও শোনে না, দেখেও দেখেনার মত চলতেই থাকে।
যেমন পৃথিবীর সব দেশে রাষ্ট্র টাকার নোট ছাপায়। কিন্তু রানীর ডিক্রি মূলে ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড একচেটিয়া ক্ষমতার যুক্তরাজ্যে নোট ছাপায়। ১০ পাউন্ডের একটা নোট ছাপাতে কয়েক পেন্স খরচ হয় মাত্র। ২০০৯ সালে নোট ছাপায় ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড যে লাভ করে তা দিয়ে ৯০০০০ (নব্বই হাজার) নার্সের বেতন দিতে পারত। সমস্ত লাভ যায় ব্যাংক মালিকদের পকেটে। যদি দসরকার নিজে নোট চাপাত তাতে যে লাভ হতো তাতে প্রত্যেক করদাতা ৩৩০০০ পাউন্ড কম দিতে পারতো। এ ধরনের বহু অসংগতি অর্থনীতি ও সোশ্যাল বেনিফিট এ চলছে যার ফলশ্রুতিতে নতুন বিনিয়োগ, রপ্তানি, শিল্প – সবখানেই সাংবাৎসরিক মন্দা চলতেই আছে। আরো হাসির ব্যাপার হলো আগের মতো মার্জিত জ্ঞানী রাজনীতিবিদদের আকালও চলছে। কিন্তু আমি দুঃখী দেশের মানুষ। আমার জন্য এসব আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবরের মত। দেশ বড়, সমস্যাও বড় তাদের।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজননেতা আব্দুল্লাহ্‌-আল-হারুন চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে হেলথ এক্সপো শুরু ১৫ সেপ্টেম্বর