এবার নিজের কথা কও
সব পেশাতে ভালো-মন্দ দুইটা দিক থাকে। আর বর্তমানে পেশার বিড়ম্বনা আরো বেড়ে গেছে। কেউ কাউকে নাহি ছাড়ে অবস্থা। পেশার বিড়ম্বনা আমি প্রথম টের পাই দৈনিক আজাদীর চিঠিপত্র বিভাগে এক পাঠক লিখেছিলেন, ডাক্তার সাহেব আপনি এত কথা লিখেন, নিজ পেশা মানুষকে কত উপকার ও ভোগান্তি দেয় আশা করি সে সম্বন্ধেও লিখবেন। আরো একবার এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়ি প্রকাশ্য এক অনুষ্ঠানে আমার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘বর্ণিল উদ্যমের’ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে নির্ধারিত আলোচকদের পর সভাপতি মহোদয় শ্রোতাদের মধ্যে দু-চারজনকে বলতে আহবান জানান। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের স্বনামধন্য অধ্যক্ষ রস মিশ্রিত ভাষায় বললেন, সবার কথা কইলি কবি এবার নিজের কথা কও। ডাক্তারি পেশায় যে রকম পাবলিক ইন্টারেকশন হয় অন্য খুব কম পেশায় এত বহুল ইন্টারেকশন হয়, হতদরিদ্র, খুনী, বড়লোক, ক্রিমিনাল থেকে শুরু করে উকিল, আমলা, রাজনীতিবিদ সবার সাথে ডাক্তারদের ইন্টারেকশন করতে হয়। কেউ খুশি কেউ অখুশী এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
ডাক্তারি পেশার পাবলিক পারসেপশনটাও বিচিত্র। আমাদের পেশার অনেকেই হয়তো তা আমলে নেয় না।
পশ্চিম বাংলার গায়ক নচিকেতার গান ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শুনে এদেশের আমজনতা। কিন্তু সেই নচিকেতার ‘ও ডাক্তার’ গানটা নিয়ে এক পিকনিকের ডাক্তাররা হৈ হট্টগোল শুরু করে দিল। আসলে ডাক্তার-পাবলিক সম্পর্ক জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। প্রত্যেকে অন্যের অবস্থান-প্রেক্ষিত না বুঝতে চাইলে তো হবে না। এই জন্য আমাদের দেশে বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে স্টেকহোল্ডারদের মতবিনিময় প্রয়োজন। যে কারণে আজকের বিষয়ের অবতারণা তা হচ্ছে দুই সপ্তাহ আগে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ৫০ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে করোনার ভ্যাকসিন সম্বন্ধে বলার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানান।
প্রশ্ন উত্তর পর্বে ভ্যাকসিন থেকে পুরো বিষয়টি ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কের টানাপোড়নের দিকে চলে যায়। প্রশ্নকর্তারা যে বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করে তাদের উষ্মা প্রকাশ করেছেন, তা আমি আমার পেশাজীবীদের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করছি যাতে আমরা একটা সুস্থ ও সুন্দর চিকিৎসা পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি।
রোগীরা অনেকে ভারতে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসে। বারবার ভারত যাওয়া প্রত্যেকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তারা ফলো আপ কনসালটেশন স্থানীয় ডাক্তারদের কাছে যায়। কোন কোন ‘বড় ডাক্তার’ নাকি রোগীদের বলে, যারা ভারত থেকে চিকিৎসা করে আসে তাদেরকে আবার ভারতেই চিকিৎসা নেওয়া উচিত। রোগীরা যখন বলে যে অমুক ডাক্তার অনেকক্ষণ যাবৎ রোগের বিবরণ শুনেছেন তখন নাকি এদেশের ‘বড় ডাক্তার’ বলেন ওই দেশের ডাক্তারদের কাম নাই তাই অনেকক্ষণ শোনেন।
একটা কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে যে এটা কমিউনিস্ট স্বাস্থ্যব্যবস্থাও নয়, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ব্যবস্থাও নয়। এটা একটা ধনবাদী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। তাই রোগীরা ফিসের বিনিময়ে যাকে ইচ্ছা তাকে দেখাতে পারে। পেশাজীবীরা যেহেতু কিসের বিনিময়ে সেবা দেন, তাই এখানে কনজিউমার স্যাটিসফ্যাকশন একটা প্রধান বিষয়। তাই পেশাজীবীদের সতর্কভাবে ইন্টারেকশন করা বাঞ্ছনীয়।
আরেকটি বাস্তব প্রশ্ন আসে, কেন ডাক্তারদের সিরিয়ালের জন্য ভোর সকালে দৌড়াতে হবে? অনেকে এত ভোরে সিরিয়াল নিতে আসতে হাইজাকার পাল্লায় পড়ে। ভোর ছয়টা থেকে সাতটা সিরিয়াল দেওয়ার কী কোন বিকল্প নেই?নর্মাল ওয়ার্কিং আওয়ারে রোগীর সুবিধামতো সময়ে দিনে সিরিয়াল দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
আরেকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যার কোন জধঃরড়হধষ উত্তর আমার কাছেও নেই। হয়তো সংশ্লিষ্ট ডাক্তারগণই জানেন। ডাক্তার শুধু এক রোগীর সাথেই কথা বলেন ও চিকিৎসা দেন, এমতাবস্থায় একত্রে দু-তিনজন ঢোকালে কোন রোগীর ব্যক্তিগত অনেক সমস্যায় বলা হয় না। একজনের মাঝে অন্য দু-একজন ঢোকে প্রাইভেসি নষ্ট করা বাঞ্ছনীয় নয়।
এখন আসা যাক পাবলিকদের প্রসঙ্গে ডাক্তারের বদনাম পথে-ঘাটে না করে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকেই করবেন যেহেতু আপনি কনজ্যুমার অ্যাক্ট অনুযায়ী সেবা খরিদ করেছেন, যদি তাও সম্ভব না হয় পেশাজীবীদের সংগঠনে বলবেন সমস্যার সমাধান চাই আমরা-মিডিয়ায় মুখরোচক সংবাদ চাই না। কোন সিরিয়াস রোগীর ক্ষেত্রে অনেক ধরনের সমস্যা হয়। হুট করে দলবল নিয়ে এসে হাসপাতাল ভাঙা, ডাক্তারকে আক্রমণ করা অনভিপ্রেত। এসব ক্ষেত্রে পরিচিত কোন ডাক্তার নিয়ে এসে বাস্তব অবস্থা জেনে বন্দোবস্ত করবেন।
সর্বশেষে আমাদের দেশে বর্তমানে ডিজিটাল সংবাদ মাধ্যমের শেষ নেই। এদের অনেকেরই তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নাই হুট করে ক্যামেরা নিয়ে এসে হাসপাতাল-ক্লিনিকে ফটো তুলে সংবাদ পরিবেশন রোগী, ডাক্তার কারো লাভ হয় না, এ সমস্ত প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিত। ডাক্তার-রোগী সবাই এদেশের মানুষ। আমাদের সমস্যা সমাধানের জন্য বিদেশ থেকে এঙপার্টও আসবে না। আমাদেরকেই একটা সুস্থ ওয়ার্কিং রিলেশন তৈরি করতে হবে। এর পথ হচ্ছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মতবিনিময়, যে কোনো পক্ষই সন্তুষ্ট না হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা উচিত। যারা কবি নজরুলের-‘এবার নিজের কথা কও’ বলে বারবার বলেছেন আশা করি তারাও এই সমস্যার স্বরূপ বুঝতে পারবেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক