ভূগোলের গোল

ডা. কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ৮ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:২১ পূর্বাহ্ণ

করোনা…অতঃপর
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকার রেললাইনের পাশের এক বস্তিবাসী মহিলাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কেন করোনার আক্রমণের পিক সময়েও সে বাইরে কাজ করতে যায়। তার সাফ জবাব করোনায় না মরলেও না খেয়ে সে মরতে চায় না। তাই করোনার মৃত্যুভীতি উপেক্ষা করে এই দুঃখী মহিলা কাজে যায়। জীবিকার প্রয়োজন মানুষের সর্বাগ্রে। জীবিকা ছাড়াও মৃত্যু, এটাই গরীবের নিয়তি।
করোনা সারা বিশ্বের মানুষকে এক মহা দ্বিধা (Dilema)য় ফেলেছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে করোনা মানুষকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করে ফেলেছে। সবচেয়ে নিম্নবিত্তের যারা তারা নিয়তির শিকার। তাদের বাঁচা মরা সবই নিয়তি। কারণ জীবিকা তাদের মৃত্যুটা বিলম্বিত করে শুধু। তারা পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের স্বাভাবিক খদ্দের নয়।
দ্বিতীয় একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী যাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, জীবিকা, কর্ম, আয় সবই বিপন্ন হয়েছে কোভিড-১৯ দ্বারা। তারা ক্ষুব্ধ রাষ্ট্রের উপর, সমাজের উপর। এখানে নিম্ন-বিত্ত, মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ বিত্তদের মানুষ যাদের আয় কমে যাওয়াতে জীবনের অসংগতি ও দুর্ভোগ বেড়ে গেছে-এ বিরাট জনগোষ্ঠী রয়েছে।

তৃতীয় একটা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা বহাল তবিয়তে আছে। কারণ তাদের অনেকের আয় করোনাকে কেন্দ্র করে বরং বেড়ে গিয়েছে।
ইটালীর দুইজন প্রফেসর মাসিনো মোরেলি ও রবার্টো সেনসোলো ১৩০০ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত প্যানডেমিক বা অতিমারী নিয়ে গবেষণা করেছেন। প্রত্যেক প্যানডেমিকের পর বিশ্বে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। সমাজের বিশাল জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক বৈষম্য, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক ‘Well being’ এর জন্য আন্দোলন করে। এসব আন্দোলন তিন ধরনের এফেক্ট তৈরি করে।
১। মানুষ প্রথাগত রাজনীতি ও ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতা করে।
২। অর্থনৈতিক মন্দা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।
৩। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা কিছু নিয়ম নীতি তোয়াক্কা না করা এক সাইকোলোজিক্যাল ব্যারাম সৃষ্টি হয়। বর্তমানে কোভিড-১৯ কে কেন্দ্র করে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ার থেকে আমেরিকার মিশিগান, ইন্দোনেশিয়া থেকে মরোক্কো পৃথিবীর বহু দেশে বিক্ষুব্ধ আন্দোলন বেড়ে গিয়েছে। প্রতিবেশী ভারতে কোন নেতা-সংগঠন ছাড়াই পরিযায়ী শ্রমিকেরা খাদ্যের জন্য, জীবিকার জন্য বিক্ষোভ করেছে। বিগত বৎসরের তুলনায় কোভিড কালে আম জনতার বিক্ষোভ ১২% বেড়ে গিয়েছে।
জর্জ ইউবার নামে এক বৃটিশ কবি ১৬২৫ সালে ইউরোপীয় প্লেগ কালে লন্ডনে মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্বের নিয়মের বিরুদ্ধে বিশাল বিক্ষোভ করে। ২০২০ সালে লন্ডন, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন ও উত্তর আমেরিকায় মাস্ক না পরার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। ৫০০ বছরের ব্যবধানে দুই বিক্ষোভের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ অভিন্ন।
ইসরায়েলের নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কোভিড বিক্ষোভ রাজনৈতিক বিক্ষোভে রূপ নেয়। সার্বিয়া, হংকং, ইউক্রেন, ইকুয়েডর, ব্রাজিল, পেরুসহ পৃথিবীর ২৬টি দেশে মার্চ ২০ থেকে অক্টোবর ২০ পর্যন্ত ৩০টি বিশাল বিক্ষোভ হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ মালাউতে মানুষ খাদ্যের জন্য বিক্ষোভ করেছে।
লক-ডাউন, মাস্ক পরার বিরুদ্ধে স্পেন, ফ্রান্স, লাইপাজিগ (জার্মানী)সহ পৃথিবীর অনেক দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। এসবের সাথে আমেরিকা উত্তাল হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্রুয়েড শ্বেতাংগ পুলিশ কর্তৃক শ্বাসরোধ করে হত্যার ঘটনা ‘Black life matters’ আন্দোলন আমেরিকা থেকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। এখন বেরিয়ে এসেছে মার্কিন উদার গণতন্ত্রের ছায়ায় কিভাবে বর্ণবাদ ও বৈষম্য কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে এখনো দংশন করছে।
বর্তমান বিশ্বে ৬৯০ মিলিয়ন লোক অপুষ্টিতে ভুগছে। এক বছর করোনা শেষে অপুষ্টিতে ভোগার সংখ্যা ১৪০ মিলিয়ন অর্থাৎ ১৪ কোটি বেড়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী কার্যক্রম (Global Workforce) ৩.৩ বিলিয়ন মানুষ চাকরি হারাতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা পাবে না,নানামুখী সমস্যায় পড়বে।
বাংলাদেশ ও করোনায় পর্যুদস্ত বিশ্ব অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এখানে কোভিড ও কোভিড পরবর্তী ক্রাইম, ধর্ষণ, তরুণ বয়সী অস্থিরতা ইতিমধ্যে দৃশ্যমান। মধ্য প্রাচ্য থেকে প্রতিদিন ফেরৎ আসছে কর্মজীবী মানুষ। আমাদের দেশে মোট কর্মসংস্থানের ৮০-৯০% ইনফরমাল সেক্টরে। এটা এখন বিধ্বস্ত প্রায়। এই বিপুল বেকার মানুষ সামাল দেওয়া কোন রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব নয়। এটাই বড় সমস্যা। সরকারের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। কিন্তু সমস্যা বিশ্বজনীন ও বিশাল। বাংলাদেশে ১১ কোটি High Risk অর্থনৈতিক জনগোষ্ঠী আছে। তার মধ্যে ৫.৫ কোটি অতি দরিদ্র মানুষ দৈনিক ১৬০ টাকার কম আয় করে। এই গরীবের গ্রুপে কোভিড অতিরিক্ত জনগণকে সামিল করছে। South Asian network on Economic modeling (SANEM) মতে কোভিড পরবর্তী বৎসরে দারিদ্র দ্বিগুণ বেড়ে যেতে পারে। এই মহামারী আমাদের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশকে যেমন ক্ষতি করেছে তেমনি অন্য দেশকেও ক্ষতি করেছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে এমনিতেই অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রবল। রাষ্ট্রের উপরে ১০% ধনী দেশের ৮০% সম্পদের মালিক, ২০১৭ সালে অঙফামের রিপোর্ট অনুসারে ভারতে ধনী ১% লোক ৭৩% সম্পদের মালিক। ২০০০ সালে ভারতে ৯ জন বিলিয়নার ছিল। ২০১৭ সালে বিলিয়নারের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০১ এ। এই বড় লোকদের সম্পদ একযুগে বেড়েছে ১০ গুণ। বড় লোকদের সম্মিলিত সম্পদ ভারতের ২০১৮-২০১৯ এর কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে বেশী। ভারতের স্বাস্থ্য সেবার চমক বিশ্বব্যাপী, তারা হেলথ টুরিজমও করে। কিন্তু সাধারণ নাগরিকের কাছে এই সেবা এখনো অধরা। প্রতি সেকেন্ডে ২ জন ভারতীয় রোগের খরচের কারণে দারিদ্র্য সীমায় পতিত হয়। গার্মেন্টস এর একজন এঙিকিউটিভ যে বেতন পায় বাৎসরিক ন্যূনতম মজুরী প্রাপ্ত একজন ভারতীয় তা কামাতে ৯৪১ বছর চাকরি করতে হবে। (অঙফাম)। এতে বোঝা যায় উন্নয়ন, কর্পোরেট ব্যবসা ও বৈষম্য ভিন্ন জিনিষ।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বৈষম্যকে করোনা আরো বৃদ্ধি করেছে। বিশ্বব্যাপী এই যে বিক্ষোভ এতে শামিল হচ্ছে রাষ্ট্রের একটি বৃহৎ অংশ। করোনার আগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ট্রাম্প মার্কা পপুলিস্ট সরকার ক্ষমতা দখল করে। ট্রাম্পের পরাজয় সমস্ত পপুলিষ্ট সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে। যে কোন সরকারের পক্ষে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও আয়-বৈষম্য কমানোর দিকে অবশ্যই সমস্ত প্রচেষ্টা নিয়োজিত করতে হবে। অতীতে যেমন মহামারী পরবর্তী বিশ্ব সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে তেমনি করোনাও বর্তমান বিশ্ব সমাজকে পরিবর্তন করবে। এই নতুন বিশ্ব ইতিমধ্যেই দেশে দেশে ইঙ্গিত দিচ্ছে। অধিকাংশ মানুষের দৈন্য-দুর্দশা উপেক্ষা করা হয়তো আর সম্ভব হবে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধতরুণ প্রজন্মের পথচলা : বিদ্যা ও নৈতিক শিক্ষাই কাম্য
পরবর্তী নিবন্ধসুনীল অর্থনীতির সুখোদয়