ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২০ অক্টোবর, ২০২০ at ১০:২৯ পূর্বাহ্ণ

অর্থনৈতিক রিকভারী : চায়না

যে সব সভ্যতা পৃথিবীতে বেঁচে আছে তার মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন হচ্ছে চাইনীজ সভ্যতা। তার চেয়েও পুরাতন হচ্ছে সুমেরীয় সভ্যতা যা মেসোপটমিয়া অঞ্চলে ছিল। মেসো অর্থ মধ্যবর্তী, পটমিয়া অর্থ নদী। ফোরাত ও টাইগ্রীস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল বর্তমান ইরাক, সিরিয়া, তুর্কী ও কুয়েত অঞ্চল নিয়ে এই সভ্যতা বিস্তৃত ছিল। কিন্তু ধারাবাহিক লিখিত ইতিহাস না থাকায় চাইনীজ সভ্যতাকেই খ্রী: পূ: ৩৫০০ বছরের প্রাচীনতম সভ্যতা বলে গণ্য করা হয়। মিশরীয় সভ্যতা ৩১০০ খ্রীঃ পূর্ব থেকে খ্রীঃ পূঃ ৩৩২ পর্যন্ত আলোকজান্ডার কর্তৃক মিশর বিজয় পর্যন্ত ছিল। ভারতীয় আর্কিওলজিকেল সার্ভে ভারতীয় সভ্যতা উপরোক্ত সভ্যতা থেকেও প্রাচীন (৮০০০ খ্রীঃ পূঃ) বললেও আন্তর্জাতিক মহলে তা স্বীকৃত নয়।
যা হোক আধুনিক কালে চীন বৃটিশ ও জাপানি দখলের সময় পুরো চীন অত্যন্ত অনগ্রসর তো ছিলই বরং ঐতিহ্য গতভাবে পুরো দেশটাই তখন আফিম ও গাঁজায় আসক্ত ছিল। ১৯৪৯ সালে চীন স্বাধীন হয়। তার দু বছর আগে পাকিস্তান ও ভারত সৃষ্টি হয়। ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি চীন থেকে ভাল ছিল ও ভারতের অনেক রাজ্য থেকেও ভাল ছিল। সেই চীন আজকে কোথায় আর এই উপমহাদেশ কোথায় তা মিলিয়ে দেখলে প্রত্যেকের মনে প্রশ্ন জাগবে ১৯৫০ থেকে আজকের উন্নতির স্তরে চীন কিভাবে পৌঁছল? তার একটাই উত্তর কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্বাবধানে। পার্টির রাজনৈতিক চলমানতায় ভুল ভ্রান্তি নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক টার্গেট নির্ধারণে তারা সব নেতৃত্বই দেশের উন্নয়ন দ্রুত করেছে। চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ১৯৭৬ সালে কমরেড মাও সে তুং এর মৃত্যু। চীনের বর্তমান মিশ্র অর্থনীতির প্রবক্তা দেন শিয়া ও পিং। তার সময় থেকে চীনের অর্থনীতির বুনিয়াদ গড়ে ওঠলেও চীনের উপর দিয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুনামি বয়ে যায়। ১৯৮৯ সালে তিয়েনম্যান স্কোয়ারে ছাত্র হত্যার ঘটনায় তাবৎ বিশ্ব চীন বিরোধী হয়ে উঠে। ১৯৯৭ সালে এশিয়ান ফাইনানসিয়াল ক্রাইসিস এর সময় সবাই মনে করেছিল চীন এবার ‘শেষ’। ২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ঢুকলে সবাই মনে করেছিল চীনের রফতানির ‘মনোপলি’ শেষ। ২০০৮ সাল থেকে অবকাঠামো নির্মাণে চীন বেপরোয়া খরচ করতে থাকে। সবাই মনে করেছিল এই অসম খরচ চীনের অর্থনীতি সইতে পারবে না। কিন্তু প্রতিবারেই চীনের অর্থনীতি সংকট উত্তরণ করে ঘুরে দাঁড়ায়।
ব্লুমবার্গের অর্থনীতিবিদ থমাস অরলিন একটা বই লিখেছেন চাইনীজ অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর উপর। বইয়ের নাম-The Bubble that never pops-অর্থাৎ যে বেলুন কখনো ফুটা হয় না।
উহান রাজ্য থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে ৭-৮ মাস গোটা বিশ্ব লকডাউনে পড়ে। চায়না স্বভাবতই একদলীয় শাসনের কারণে আরো কড়াকড়ি বিধি নিষেধের মধ্য দিয়ে তাবৎ বিশ্বকে অবাক করে মহামারী থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু ঘটনা তলিয়ে দেখা গেছে যে পুরো সময়টাতেও অনেক মিল কারখানায় কাজ বন্ধ থাকেনি। শ্রমিকরা মিলের এলাকায় থেকে উৎপাদন চালিয়ে গেছে। বিভিন্ন পরিবহনে এশিয়াসহ অন্যান্য দেশে তার রফতানি সীমিত হলেও অব্যাহত ছিল।
বিশ্বব্যাংক ভবিষ্যৎবাণী করেছিল যে চীনের প্রবৃদ্ধি ২.৫% বা তার নীচে থাকবে। কিন্তু অর্থ বছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে প্রবৃদ্ধি ৩% বা তার বেশী হয়েছে। অর্থাৎ চায়নার অর্থনীতি আশাতীত ভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
চায়নার অর্থনীতির বিপদ আভ্যন্তরীণ এর চেয়েও আন্তর্জাতিক অবস্থার থেকে আসছে বেশী। যেমন করোনা ২য় সংক্রমণের ঢেউ, গ্লোবাল অর্থনৈতিক অনিশ্চিয়তা, চায়না-আমেরিকা অর্থনৈতিক যুদ্ধ, এই তিনটা বিষয় চীনের ঘুরে দাঁড়ানো শ্লথ করতে পারে। ১৯৯০ এর পর চীনে প্রবৃদ্ধি বর্তমানে খুব নীচে। কিন্তু উন্নত পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে এখনো অর্থনীতি সামলাতে পারছে না সেখানে চীন ইতিমধ্যে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
চীনের অর্থনৈতিক ঘুরে দাঁড়ানোর বড় সমস্যা চীন সরকারি প্রণোদনা দিয়েছে উৎপাদনের সাথে জড়িত মালিকদেরকে । ভোক্তাদেরকে পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্র যেভাবে প্রণোদনা দিয়েছে সেভাবে চীন দেয়নি। ফলে চীনে Retail sale আশানুরূপ রিকভারী হচ্ছে না এখনো।
সিডনীর NAB র অর্থনীতিবিদ রডরিগো কাটরিল এর মতে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো নির্ভর করে ভোক্তাদের উপর। ভোক্তারা চীনে এখনো রয় সয়ে খরচ করছে। অনেক ব্যক্তি মালিকানাধীন কারখানার শ্রমিকরা এখনো ৩০% কম বেতন পাচ্ছে। আবার অনেকের চাকরিও নেই। এই সমস্যাটা পরিশেষে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। আরো উল্লেখ্য চীনের জিডিপির ৫৮% ডমেসটিক কনজামশান অর্থাৎ ভোক্তাদের পকেট থেকে। ভোক্তাদের দিকে সরকার দৃষ্টি না দেয়ায় উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও ভোক্তারা খরচ করতে পারছে না। এ কারণে চীনের অর্থনৈতিক রিকভারী ধীরগতিতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশ মনে করেছিল যে চায়নার অর্থনীতি শেষ হয়ে গেল। আবার পাশ্চাত্য এও প্রচার করেছে যে চায়না থেকে পাঁচশ কারখানা এশিয়ার অন্যত্র চলে যাবে। জাপান সরকার চায়না থেকে যারা সরে যাবে তাদেরকে আর্থিক প্রণোদনা দিবে বললেও পাঁচ-সাতটা কোম্পানি তাতে সায় দিয়েছে। মার্কিন কোম্পানিগুলোও সরছে না। আসলে রাজনীতিবিদরা চায়নাকে ঠেকাতে চাইলেও গত ৩-৪ যুগ ধরে গড়ে ওঠা অবকাঠামোর সুবিধা ফেলে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো চায়না ছাড়বে-এটা অত্যন্ত সাদা মাটা সমীকরণ। চায়নার রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হলেই অর্থনীতির সমস্যা হবে। নতুবা কম্যুনিস্ট পার্টির নির্দেশনায় অর্থনীতির রিকভারী পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে দ্রুত হারে চলতেই থাকবে।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমহাত্মা গান্ধীর অহিংসনীতি ও প্রাসঙ্গিক কথা
পরবর্তী নিবন্ধমন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার কমেছে