ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

জীবনের গল্প

চট্টগ্রামের কিছু ব্যক্তিত্ব শুধু চট্টগ্রামের জীবন চর্চা করেছেন বলে ঢাকা বা দেশের অন্য স্থানে তেমন পরিচিতি লাভ করেননি। এমন একজন রাজনৈতিক ও রম্য লেখক হচ্ছেন প্রয়াত অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ। তার লেখা প্রথম সাদা পৃষ্ঠায় কিছু তাৎপর্যপূর্ণ লাইন জুড়ে দিতেন, তেমনি দুটো লাইন হচ্ছে –
সবার উপরে মানুষ সত্য,
তাহার উপরেও শ্রেণী সত্য।

আমাদের মত শ্রেণীবিভক্ত সমাজে এই লাইনগুলো তীব্রভাবে প্রযোজ্য। নিরন্তর শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সমাজের রূপান্তর ঘটে। দেড়শ বছরের মার্কসবাদের কিছু কিছু নতুন শ্রেণীর উদ্ভব উল্লেখ থাকার কথা নয়। এসব শ্রেণি ধনী-দরিদ্র সব দেশেই থাকে। তবে অপেক্ষাকৃত গরিব দেশে যার অধিকাংশই এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় সেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রভাবশালী এক ধনী গোষ্ঠী থাকে। তাদেরকে বলে “ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট”। এরাই রাষ্ট্রে নীতি-আদর্শ নিয়ন্ত্রণ করে ও বাজারজাত করে। তার পরেও বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ থাকে। এরাই জনগণের মূল আবহাটাকে সমাজে ধরে রাখে। দেশের লোকায়ত রীতিনীতি, সংস্কৃতি, বিশাল মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের মাঝেই দৃঢ়ভাবে প্রোথিত থাকে। তাই কোনো দেশকে জানতে হলে, বুঝতে হবে এই ধ্রুপদী মানুষগুলোকে, তাদের জীবনের গল্প দেশের আসল গল্প।

গল্প-১
গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া এক ছেলে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় টিকে যায়। বাবা ভ্যান চালায়, পরিবারের অন্য পুরুষরা গতর খাটে। গ্রামের অধিকাংশ পরিবার এখনো এই শ্রেণির। মেডিকেলে ভর্তি, থাকা খাওয়ার খরচ, বইপত্র কেনা, অন্য সাধারণ পড়া থেকে ভিন্ন, খরচও বেশি। পাশ্চাত্যে প্রবাসী এক ডাক্তার তার সব খরচ বহন করার দায়িত্ব নেয়। পাঁচ বছর দুঃখে সুখে কেটে যায়। মেডিকেলের বর্ষ-সমাপনী পরীক্ষাগুলো এক চান্সে পাস করে। প্রতিবারই পাসের খবরটা আমাকে দিয়ে যায়। পা ছুঁয়ে সালাম করে। ভদ্রতা শিষ্টাচারের শেষ নেই। এমনিভাবে এমবিবিএস ফাইনাল পাস করে। ইন্টার্নি করে এক চান্সেই বিসিএস পাস করে। তার সাফল্যের সব খবরই সে এসে দিয়ে যায়। তাকে বললাম ফোনে জানালেই পারতে। সে বলল সশরীরে এসে দেখা করাটা অধিকতর যুক্তিযুক্ত। এটা আসলে বই বা পারিবারিক কোনো শিক্ষা নয় যা আমরা বলি। এটা খোদার একটা নেয়ামত যা আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দেয়। একদিন সে একটু বেশি সময় ধরে গল্প করল। বলল আমার জন্য একটা ঘড়ি এনেছেন। বেশি দামি ঘড়ি। সে যখন বলল এটা তার প্রথম বেতনের প্রথম কেনাকাটা তখন আমি আবেগাপ্লুত ও বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কয়েক মিনিট পর তাকে বললাম তোমাকে দোয়া করি, আমার ঘড়ির প্রয়োজন নেই। তোমার পরিবারের কাউকে এই ঘড়িটা দিলে বেশি ভালো হবে। মাথাটা লজ্জাবনত করে নব্য ডাক্তার বলল-তার পরিবারে ঘড়ির সময় চেনে এরকম কেউ নেই।
অজান্তেই আমিও অশ্রুসজল হলাম!

গল্প-২
রিকশাচালক মতি মিয়া ছোটকালেই মা-বাবা হারায়। চাচা-জ্যাঠার সংসারে বড় হয়। ২২ বছর বয়সেই বিয়ে হয় পাশের গাঁয়ের তমিজ শেখের মেয়ে কুলসুম বিবির সাথে। চর এলাকার মানুষ তারা। গ্রামের অন্য দশজনের মত কাজের সন্ধানে পাড়ি দেয় বড় শহরে। শহরে তাদের বসতি হয় কোন বস্তিতে। বস্তির জীবনের বর্ণনা আর কিবা হয়। সবাই ভাসমান মানুষ। কে কোথা থেকে এসেছে তার হদিস নেই। তবু তারা ঘর বাঁধে। সমাজ করে। কাজ করে হরেক পেশার, নারীরা অবধারিতভাবে বুয়ার কাজে জীবন কাটায়। মতি আর কুসুম নতুন জীবন শুরু হয়। এখানে নেই চরের মুক্ত হাওয়া, হাঁসের জলকেলী, নেই ন্যাংটা বাচ্চাদের উজ্জ্বল গোসল আর সাঁতার। বস্তিতে বসবাসকারী মতি-কুসুমরা জানে এটাই তাদের নিয়তি। ফেলে আসা চরের জীবনে হয়তো আর ফেরা হবে না। মতি রিকশা চালায়, হরেক রকমের যাত্রী ওঠে রিঙায়, এরা হরেক রকমের গল্প করে দশ-বিশ মিনিটের রাইডে, বুড়ো-বুড়িরা, ছেলে বৌমা, নাতি-নাতনির গল্প করে, কখনও সুখের, কখনো দুঃখের, কখনো হতাশার এসব গল্প। তরুণ-তরুণীরা রিঙার রাইডেই যেন সকল সুখ অনুভব করে। মেলার গল্প, চটপটি, ফুচকা খাওয়ার গল্প, আবার যারা একটু উচ্চ বিত্তের আরোহী ওরা বার্থ ডে, ম্যারেজ ডে কোথায় করবে। তা নিয়ে আলাপ করে। এসব বিশেষ দিনে কি পড়বে, কি খাবার হবে, কি গিফট হবে তা নিয়ে আলাপ করে। মতি মিয়া সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন রাজনৈতিক কর্মীরা আরোহী হয়। শুধু অমুক ভাই, তমুক ভাই – তমুক ভাইয়ের সুনাম-বদনাম নিয়ে, গ্রুপিং, ফাটাফাটি ইত্যাদি আলাপ করে।

রাতে ক্লান্ত শরীরে মতিন মিয়া আরোহীদের কথা আলাপ এর সাথে মতি-কুসুমের জীবনটা মেলাতে মেলাতে ঘুমিয়ে পড়ে। তার শুধু স্বপ্ন ওদের ম্যারেজ ডে তে কুসুমকে সে কি গিফট দিতে পারে। কুসুমও বাসায় কাজ করতে গিয়ে কত কথা শুনে, ঘুষ,পরকীয়া, সাহেব বেগমের কখনো আদর, কখনো ফাটাফাটি, অবাধ্য বাচ্চাদের হৈ চৈ। কুসুম শুধু ভাবে মতির সাথে তার কত শান্তি, ঝগড়া নেই, চাওয়া পাওয়ার ঝগড়া নেই, মতি প্রতিদিন দু-চার টাকা করে জমায় কুসুমের অজান্তে। কুসুম ও সামান্য মুষ্টি চাউল লুকিয়ে জমা করে এক জায়গায়। মতি ওদের ম্যারেজ ডে তে কুসুমকে একটা শাড়ি গিফট দিতে চায়। মাঝে মাঝে দোকানে শাড়ি দেখতে যায়। দাম কমের মধ্যে ৭-৮০০ টাকা, অত টাকা তো সে জমাতে পারেনি। আরেক রিঙাওয়ালার পরামর্শে মতি সাড়ে তিনশো টাকার এক শাড়ী পেয়ে যায়। মতি বউকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এটি রিঙার সিটের নিচে লুকিয়ে রাখে। এদিকে জমা মুষ্টি চাউল পাশের বড় বুবুর কাছে বিক্রি করে কুসুমও একটা লুংগি কিনে লুকিয়ে রাখে। মতি কুসুমকে বলে- রিঙার যাত্রীগুলো ম্যারেজ ডে তে কত কিছু গিফট করে আমি তো তা পারবো না, কিন্তু বড় শখ করে তোমার জন্য এ শাড়িটা কিনেছি! কুসুমও তাকে লুঙ্গিটা গিফট করে, দুজনে ঘুমিয়ে পড়ে। অনেকটা বেবী নাজনীনের “কাল ছিল স্বপনের রাত” মত। উচ্চবিত্তের সন্দেহ, নারী নির্যাতন, মারামারি, ফাটাফাটি গিফট নিয়ে অসন্তষ- কিছুই নেই মতি -কুসুমের নিবিষ্ট রাতে!

গল্প-৩
রোজা আর ঈদের গল্প আমার ৭০ বছরের এই জীবনে অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। ৪০ বছরের দরিদ্র বেশির সময়ে যা- এখন মধ্যম আয়ের আর ফ্লাইওভার, হাই-রাইজ আর শপিং মলে এর সময়েও তা, রোজার সাথে ‘মল’ যেমন এ যেমন উপচে পড়া খদ্দের তেমনি পথে-ঘাটে ও “ভূগর্ভ থেকে উঠে আসা” অভাবী আর দরিদ্রের গণজোয়ার। শহরের যেখানেই যাবেন শুধু ভিক্ষুক আর ভিক্ষুক! শুক্রবার মসজিদের দরজার সামনে ভিক্ষুকের সারিটা নেহায়েৎ অন্ধ না হলে না দেখার কথা নয়। হরেক রকমের বিকলাঙ্গ, প্রতিবন্ধী সাহায্যপ্রার্থী। ফুটপাতে দোকানের সান শেডে হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষ মা-বাবা শিশু, আবার কোথাও ঘুমন্ত মানুষের পাশেই শুয়ে আছে হয়ত তাদেরই মত অভুক্ত-অল্প ভুক্ত দুচারটা কুকুর! এরাও মানুষ! এই বাংলাদেশেরই মানুষ! ইফতারের সময় মসজিদের আশপাশে, বড়দের দুয়ারে পলিথিন নিয়ে সামান্য উচ্ছিষ্টের জন্য উদগ্র চাহনি। আধা ভাঙ্গা জিলাপি,আদা খাওয়া চপ পেলেই তৃপ্তির অবয়ব, উপর ওয়ালার দিকে হাত তুলে দোয়া করে। এরাও আমাদের দেশের মানুষ। আমি ভোর সকাল থেকে গভীর রাতেও নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জীবনের গল্পের উপজীব্য দেখতে যাই। এটা আমার বহুদিনের অভ্যাস! আসলেই এটা a tale of two cities !

দেশ চলছে! জীবন চলছে ! প্রতিটি শ্রেণি তার মতো দেশকে দেখছে! শ্রেণি বিভাজন আমাদের মত সমাজের দিন দিন প্রকটতর হচ্ছে। প্রতিটি শ্রেণি আবার এই সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাউকে বাদ দিয়ে সমাজ নয়। এ ধরনের বিভক্ত সমাজে কখনো সমঝোতা হয়না। প্রতিযোগিতা হয় কাকে ফেলে কে উপরে যাবে। এটা যদি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে হয় তখন হয় নৈরাজ্য। তবে দার্শনিক মার্কস এর ভাষায় এই দ্বন্দ্ব চিরন্তন, শ্রেণি সংগ্রাম চলতেই থাকবে। তাই রম্য লেখক আসহাব উদ্দীন সাদামাটা ভাষায় লিখেছেন- সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরেও শ্রেণি সত্য। শ্রেণি সংগ্রামই জীবনের শ্রেষ্ঠ গল্প।
লেখক : কলামিস্ট, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা বড়ই অবহেলিত
পরবর্তী নিবন্ধজাপানের নিগাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনা খরচে পড়বে সিভাসুর শিক্ষার্থীরা