ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ১২ এপ্রিল, ২০২২ at ৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ

FUTURIST বা ভবিষ্যৎ বাণী

নিকোলাস বেডমিন্টন নামে ফিউচারিস্ট মানে এক ভবিষ্যৎ বক্তা আছেন। তার বয়স ৫০। সে ২০৪০ সাল নাগাদ বিশ্বে বিভিন্ন পেশার কি অবস্থা হবে তার উপর বই লিখেছেন। আমাদের বয়সী মানুষের জন্য তার লেখা ‘ফ্যান্টনিমনে ফ্যা হলে ও বাস্তবে টেকনোলজিক্যাল পরিবর্তন ভবিষ্যতকে টোটালি পরিবর্তন করে দেবে। আমার সহধর্মিণী একজন শিশু বিশেষজ্ঞ হলেও জীবনচর্চায় নেহায়েৎ সাধারণ উপমহাদেশীয় মহিলা। সে বড় কোন হোটেলে সেমিনারেও যায় না। আজকের লেখাটা নিয়ে যখন তার সাথে আলাপ করলাম সে বলল দুনিয়া কি এই নিকোলাসের কথা মত চলবে,আমরা এক দেশের গরিব মানুষ আদার বেপারী জাহাজের খবর নিয়ে আগে যেমন লাভ ছিল না এখনো তাই।
তবুও নিকোলাস এর ভবিষ্যৎ নিদর্শন সারাবিশ্বে নতুন ভাবনা তৈরি করেছে। বর্তমান বিশ্বে তার ঘন্টাওয়ারী বক্তব্যের সর্বোচ্চ ফিস। তার বক্তব্যটা আমাদের দেশের মা-বাবা যারা ছেলেকে এটা ওটা বানাতে গলদঘর্ম ,তাদের জন্য একটা গলদ অশনি সংকেতও বটে। কারণ আজকে ২০২২ এ যে বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করলো সে ২০৪০ অর্থাৎ মাত্র ১৮ বছর বয়সে কি পেশা নিবে তা একটা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন? আদৌ অনেক পেশা থাকবে কিনা?
আজ থেকে ৩০ বছর আগেও কোর্ট বিল্ডিং, আগ্রাবাদ অঞ্চলে শুধু টাইপিস্ট-একটা কিছু টাইপ করার জন্য বসে থাকা, আজকে সে পেশা নেই। ধোপা নেই, কামার নেই, কুমোর নেই। কবিগুরুর পরিবারের জমিদারির শেষের দিকের পেশা ছিল ‘ব্রোকারী’, এখন অনেক ব্যবসায় ব্রোকারী নেই, সব অনলাইন। নিকোলাস এর বইটার নাম Facing Our Future- তরজমা করলে ভবিষ্যতের মুখোমুখি।
নিকোলাসের গবেষণায় আগামী ১২০ বছরে সব মানুষের চাকরি স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেটেড হয়ে যাবে। ২০২৪ সাল নাগাদ মেশিন সব অনুবাদের কার্যক্রম করবে। কোন অনুবাদক পেশা থাকবেনা, ২০২৬ সাল নাগাদ স্কুলের ছাত্রদের অমুক বিষয়ে রচনা লিখতে দিলে গুগলই তা করে ফেলবে। ২০২৭ সাল নাগাদ ট্রাক ড্রাইভিং অটোমেটেড হয়ে যাবে। ২০৩১ সাল নাগাদ খুচরা দোকানিরাও উঠে যাবে। বর্তমানে যেখানে মানুষ দিয়ে কুরিয়ার বা অনলাইনে ক্রয় সামগ্রী ঘরে পৌঁছে তা উঠে গিয়ে ড্রোন দিয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছানো হবে। ২০৪৯ সাল থেকে অধিক বিক্রিত বই বা Best Selling Book ও মেশিনে লিখে ফেলবে।২০৫৩ সাল নাগাদ অধিকাংশ ‘সার্জারি’ মেশিনে করবে। কোন কোন চাকরি অতীতের কামার কুমোর এর মত একেবারেই থাকবেনা। যেমন ট্যাক্সি ড্রাইভার, ক্যাশিয়ার, খুচরা দোকানী। এখনো উন্নত বিশ্বে অনেক দোকানে কোন ক্যাশ পয়েন্ট নেই। দাম শোধ, দাম টোকেন সব মেশিনে করা হয়। সবচেয়ে আঘাত আসবে ‘ডেলিভারি ম্যান’ এর চাকরিতে। সমস্ত ডেলিভারি করা হবে ড্রোন দিয়ে। নিকোলাস ব্যাডমিন্টন এর মাথায় এসব আসলো কেমনে? ছোটকালে সে ‘মিল্ক ম্যান’ এর কাজ করতো। অর্থাৎ দুধ দোহন, বোতলে ভরা, ভ্যানগাড়িতে উঠানো-এসব কারণে কলেজে যাওয়ার তার হয়নি।তার বাবা তাকে জোর করে কম্পিউটার সাইন্সে ভর্তি করে দিলে কম্পিউটিং করে করেই সে এক নামে ফিউচারিস্ট বনে গেল। বর্তমান নাসা,গুগোল, মাইক্রোসফট টেকনোলজিক্যাল ইনফর্মেশন শেয়ার করতে নিকোলাস কে কোটি ডলার দিতে হয়। একাউন্টিং, আইন, ডাক্তারি পেশা থাকলেও এগুলো হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ‘কৃত্তিম জ্ঞান’ এর আওতাধীন। টেলি মার্কেটিং টেলি সার্ভিসিং হবে। ডাক্তারের স্পর্শ ছাড়াই রোগী চিকিৎসা পাবে, পুরো করোনাকালে চিকিৎসা এভাবেই হয়েছে। কোন কোন রোগের ডায়াগনেসিস ডাক্তার থেকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এর মেশিন অধিকতর নিখুঁতভাবে কৃত্রিম জ্ঞান করবে। বর্তমানে দন্ত চিকিৎসার বহু ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে।
তাহলে ভবিষ্যৎ কোন পেশাগুলোর চাহিদা বাড়বে এবং কারা বেশি বেতন পাবে? আপনার সন্তানকে সেই দিকে খেয়াল রেখেই ক্যারিয়ার নিতে হবে। প্রথম পেশা যার চাহিদা হবে বেশি- Human Centred ডিজাইনার ও নীতিবাদ। এটা কি? বর্তমানে আপনার ছবি, পোস্টার, জীবনের সব গুগোল, মাইক্রোসফটের আওতায়। তার বিপরীতে আপনার ব্যক্তিগত তথ্যের একক গোপনীয়তাও রক্ষা কারী হবে এই পেশার লোকজন। ২য় চাহিদা হবে ডাটা সাইন্টিস্ট এর। ২০৪০ সাল নাগাদ এরা দিনে ২০০ পেটাবাইটস তথ্য সৃষ্টি করবে। এটা বোঝা সহজ হবে আমরা যারা মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করি তারা ৪-৫ জিবি বা গিগাবাইট লোড করি। এরকম মাসে তা খরচ করি। অনেকে ২-৩ জিবি ও নেয়। এরকম 10 লক্ষ জিবি এক পেটাবাইট করে। তাহলে একজন ডাটা সাইন্টিস্ট দিনে ২০০ পেটাবাইট তথ্য সৃষ্টি করা আমাদের কল্পনার বাইরে। আপনি এই ব্যাটা দের কাছে সবকিছুর জন্য যেতে হবে। ওদের কামাই ও হবে সে রকম।
আরেকটি প্রয়োজনীয় ও বেশি বেতনের পেশা হবে ‘রোবট থেরাপিস্ট’। এরা রোবটকে ঠিকঠাক তো চালাবে, রোবট লিঙ্গুইস্ট বা অনুবাদক, এখন একজন অনুবাদক ২-৩ টা ভাষা জানে। রোবট লিঙ্গুইস্টরা একসাথে ২০০ভাষা অনুবাদ করবে। নির্মাণ প্রকৌশলীদের বলা হবে মেটা ভার্স আরকিটেক্ট। শুধু মেশিনে নির্মাণ শিল্পের খরচ, লোড, ডিজাইন সব করবে।
সাংবাদিকতা, অভিনয়, শিল্পী এদের কাজ ও বর্তমানের মত থাকবে না। ওদেরকে বলা হবে অপঃরাধঃবফ ধৎঃরংঃ ও ঈৎবধঃড়ৎ। গণমাধ্যম না থেকে প্রত্যেক ভিন্নভাবে নিজ নিজ কর্ম প্রদর্শন করবে। এই একটি ক্ষেত্রে নিকোলাস এর মতে হয় আবারো ‘লাইভ থিয়েটার’ ও “পথনাট্য” মঞ্চনাটকের দিকে ঝুঁকতে পারে।
আরেকটি পেশা হবে সাইবার সিকিউরিটি ও মিচ ইনফর্মেশন এক্সপার্ট, এদের চাহিদা ও বেতন ও বেশি।
বায়ো হ্যাকার এটা? একটা পেশা হবে যাদের কাজ হবে অর্গণে প্রতিস্থাপন করে বা জীবন স্টাইল পরিবর্তন করে মানুষকে দীর্ঘ জীবন দান করার বিজ্ঞান। এদের খদ্দের হবে বেশি। আরেকটি গরম পেশা হবে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং। মানুষের রসনার চাহিদা অনুযায়ী এরা হরেক রকম খাদ্যতালিকা দেবে, এদের চাহিদা ও উপার্জন ও হবে বেশি।
তাহলে সব পেশায় কি পরিবর্তন হবে? না, কারণ কিছু কিছু কাজ মানুষ মানুষের হাতেই হোক- এটাই পছন্দ করবে। যেমন ঘরে বানানো পিঠা, নাস্তা, স্যান্ডউইচ, এগুলো মানুষ মেশিনে পছন্দ করবে না। তাই হোমমেড খাবার এর কদর থেকেই যাবে।
তাহলে বর্তমান উচ্চশিক্ষা বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর কি হবে? এখানেও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান গুলোর ট্রেইনি হিসেবে পড়বে ও ভাতাও পাবে- এভাবেই প্রতিষ্ঠানগুলো চলবে।
ভবিষ্যতে কি মানুষ ও তার প্রদত্ত মনন-মেধার কোনো দাম থাকবে না? নিশ্চয়ই নয়, আসলে মেশিন-প্রযুক্তি মানুষ Symbiosis হিসেবে থাকবে। Symbiosis মানে এমন পন্থা যা থেকে দুজনেরই লাভ, মানুষের প্রয়োজন প্রযুক্তির আর প্রযুক্তি প্রয়োজন মেধা।
তবে Empathic reasoning বা সহানুভূতিশীল বিষয় তর্ক-বিতর্ক সহায়তা মানবিক পারস্পারিক সোহার্দ্য ও সর্বোপরি সৃজনশীল চিন্তা ও কর্ম মেশিন অটমেশন দিয়ে হবে না। এসব ক্ষেত্রে মানুষ থাকবে জাহাজের নাবিকের ভূমিকায়। আজকের জীবন আমাদের পূর্বপুরুষদের অজানা ও কল্পনার বাইরে ছিল। আমি রেললাইনের পাশের মানুষ আমার এলাকায় চাষারা জীবন শুরু করত ফাস্ট ট্রেনের (সকাল ছয়টা) হুইসেল শুনে। ‘লাঞ্চ’ খেত ১২ টার ট্রেন এর হুইসেল শুনে, ছাত্ররা শুতে যেত ‘লাস্ট ট্রেন’ এর (রাত ১০:৩০ টা) হুইসেল শুনে। অধিকাংশের ঘরে কোন ঘড়ি ছিল না, এখন ৫০-৬০ বৎসর জীবন কোথায়? আগামী ২০-৩০ বছরে কি হবে? যারা নবীন তাদের ভবিষ্যতের প্রস্তুতি ও চিন্তাভাবনা থাকতে হবে।
আমার সহধর্মিণী শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে টাকা রাখে। কারণ প্রাইভেট ব্যাংকে রাখলে বড়রা খেয়ে ফেলবে। ব্যবসা করতে চায় না। কারণ লাভ পাপ। ফিস কম নেয় কারণ সারাজীবন বৃত্তিতে পড়েছে। আমার ছেলেরা বলে আব্বু, আম্মুর কথা বাদ দাও, উনি এখনো ‘কমিউনিস্ট’। আর আমার স্ত্রী উত্তর বলে পুঁজিবাদী বিশ্বের তথ্যের বিশ্বাস নাই। দেখা যাক বিশ্ব কোন দিকে যায়।
লেখকঃ চিকিৎসক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমরা কোন পথে অগ্রসর হচ্ছি!
পরবর্তী নিবন্ধবলিউড অভিনেতার জীবনাবসান