বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস এবং মায়াকানন

ডা. বাসনা রানী মুহুরী | রবিবার , ২ এপ্রিল, ২০২৩ at ৪:৪৭ পূর্বাহ্ণ

একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন: নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্স– ‘মায়াকানন’। বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস২০২৩ এর প্রতিপাদ্য-‘রূপান্তরের অভিযাত্রায় সবার জন্য নিউরোবান্ধব অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্বগঠন’ এর বাস্তবায়নের একটি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ।

২০০৮ সাল থেকে প্রতি বছর ২রা এপ্রিল পালিত হচ্ছে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। সর্বস্তরে সচেতনতা সৃষ্টি এবং একটি অটিজম বান্ধব, নিউরোবান্ধব, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনও সমানভাবে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এ দিনটি বিশেষ গুরুত্বসহকারে উদযাপন করে আসছে। উদ্দেশ্য কাউকে পেছনে রেখে নয়, সবাইকে সাথে নিয়ে অটিজম এবং অন্যান্য স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধীদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এবং একটা সমন্বিত বা ইনক্লুসীব সমাজ গড়ে তোলা। বিগত বছরগুলোতে যেমন এটার প্রতিফলন ছিল প্রতিপাদ্য বিষয়ে যেমন

`Inclusive Quality Education for All’, 2022 ; ‌Inclusion in the Workplace ’, ২০২১ ; তেমনি এবারকার বিশ্বঅটিজম সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্যও

রূপান্তরের অভিযাত্রায় সবার জন্য নিউরোবান্ধব অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্বগঠন’সে একই ভাবনা বাস্তবায়নের ডাক।

২০১০ সালে মাত্র চারজন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছাত্রছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু তৎকালীন অটিস্টিক চিলড্রেন ডেভলোপমেন্ট এন্ড ওয়েলফেয়ার সেন্টার যা বর্তমানে নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন নামে সুপরিচিত। এটি সমাজসেবায় রেজিস্ট্রার্ড একটা বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অটিজম এবং অন্যান্য স্নায়ুবিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্নদের উত্তরণে দীর্ঘ প্রায় একযুগের অধিককাল নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে নিষ্পাপ অটিজম স্কুল এবং এর সাথে ২০২১ সালের জানুয়ারী থেকে সংযুক্ত হয়েছে নিষ্পাপ সমন্বিত বিদ্যালয়। দুই শিফটে পরিচালিত নিষ্পাপ অটিজম স্কুলে বর্তমানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১০০জন এবং নিষ্পাপ সমন্বিত স্কুলে শিশু শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১২০জন।

শুরু থেকে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্রছাত্রী একাডেমিক লেভেলে উত্তরণ হয়ে মূলধারার বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। কিন্তু আবার অনেকেই মূলধারার স্কুলে পড়ালেখার যোগ্যতা অর্জনের পরও স্কুল থেকে বিতারিত হয়েছে তাদের কিছুটা আচরণ এবং মূলধারার শিক্ষকদের সহযোগিতার অভাবে।

আমরা জানি অটিজম সারাজীবনের সমস্যা, এটি নিরাময়যোগ্য কোনো রোগ নয়, এটি একটি স্নায়ুবিক বিকাশজনিত সমস্যা। মূলধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি নির্দেশনা এবং নীতিমালা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্নদের জন্য। এ বাস্তবতা উপলব্ধী করেই নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন পরিচালনা করছে নিষ্পাপ সমন্বিত বিদ্যালয় যেখানে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সাথে নিষ্পাপ স্কুলের ২০ জন অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন ছাত্র ছাত্রী একই সাথে লেখাপড়া করছে যেখানকার শিক্ষকরাও স্পেশাল এডুকেটর।

অটিজম উত্তরণে অবদান রাখায় ২০১৮ সালে জাতীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত এ প্রতিষ্ঠান নিরলসভাবে কাজ করছে সামাজিক সচেতনতাবৃদ্ধিতে, অভিভাবক প্রশিক্ষণ, বিশেষায়িত শিক্ষকদের গুনগত মান বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেশি বিদেশি প্রশিক্ষকের মাধ্যমে। এ প্রতিষ্ঠানে বিএসএড এবং এমএসএড ডিগ্রিধারী শিক্ষকরা যেমন শিক্ষকতা করছেন তেমনি দেশি বিদেশি অকুপেশনালথেরাপিস্ট, স্পীচলেন্‌গুয়েজ থেরাপিস্টরাও যুক্ত আছেন ছাত্রছাত্রীদের উত্তরণে।

এখানে সুদূর কুমিল্লা থেকে শুরু করে টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদীয়া, কক্সবাজার থেকেও অভিভাবকরা তাঁদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানদের নিয়ে আসেন, যাদের চট্টগ্রাম শহরে নেই কোনো থাকার জায়গা বা অনেকেরই নেই স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী অভিভাবক প্রশিক্ষণ বা সেবা নেবার সুযোগ/ সামর্থ্য।

নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন এসব সমস্যা অনুধাবন করে একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে– ‘নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন মালটিপারপাস কমপ্লেক্সমায়াকানন” নন্দিরহাট, ১নং ওয়ার্ড, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, যে ভবনের নির্মাণ কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন এর উদ্যোগে, নিজস্ব এবং বিভিন্ন মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের অনুদানের অর্থে ভূমি ক্রয় করে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।

এখানে থাকছে🙁 অটিজম ও অন্যান্য স্নায়ুবিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্নদের জন্য)- আর পি সেনগুপ্তনিষ্পাপ সমন্বিত বিদ্যালয়: যেখানে শিশু শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সাথে বিশেষ শিশুরাও অধ্যয়নের সুযোগ পাবে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভবন নির্মাণ সমাপ্ত হলে স্থায়ী ভবনে এ স্কুল চলবে।

Respite Care বা অবকাশ যত্ন: কোনো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বা ব্যক্তির পরিচর্যাকারী/ অভিভাবক হঠাৎ জরুরি অসুবিধার কারণে সেবা দিতে অপারগ হলে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য তার সেবার ভার নেবে মায়াকানন।

উত্তরণবৃত্তিমূলক (Vocational)প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: স্বাবলম্বী এবং উপার্জনক্ষম করার লক্ষ্যে এ প্রকল্প কাজ করবে।

মায়াকাননইনক্লুসিভ হোম: কোনো অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি/ শিশু অভিভাবকহীন হলে এখানে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ পাবে, যাঁদের সেবাদানকারী হবে পূনর্বাসিত সাধারণ মানুষ, সে কাজের জন্য প্রশিক্ষণ কাজও শুরু হয়েছে।

অভিভাবক/ সেবাদানকারী (Caregiver) স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (আবাসিক/ অনাবাসিক): স্বল্প খরচে এখানে থেকে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দূর দূরান্ত থেকে আসা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বা তার অভিভাবকরা এ সুযোগ পাবেন।

সব ধরনের কার্যক্রম হবে মায়াকানন প্রকল্পের নিজস্ব যতটুকু সুযোগ সুবিধা থাকবে তার পরিধি বা বিস্তৃতি অনুযায়ী।

নিষ্পাপ অটিজম স্কুল: চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থলে ( প্রবর্তক মোড়, চট্টগ্রাম) ২০১০ সাল থেকে অটিজম এবং অন্যান্য স্নায়ুবিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্নদের জন্য সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা সংযোজন করে পরিচালিত হচ্ছে যেখানে বর্তমানে প্রায় ১০০জন ছাত্রছাত্রী আছে দুশিফটে।

মায়াকাননে আরও থাকছে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র এবং বিক্রয় ও প্রদর্শনী স্টল, খাবারের স্টল যা সক্ষম বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের একটি কর্মসংস্থান এবং উপার্জনের পথ সুগম করবে যেটা ইনক্লুসিব পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে।

অটিজম কোনো রোগ নয়, এটা স্নায়ুবিক বিকাশ জনিত সমস্যা। সিডিসি আমেরিকার মতে বর্তমানে প্রতি ৩৬ জন শিশুর মধ্যে একজন সনাক্ত অটিজম সমস্যায়। আমাদের দেশের সঠিক পরিসংখ্যান জানা না থাকলেও এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।

কোনো ঔষধের মাধ্যমে এটা সারানো সম্ভব নয়, প্রয়োজন প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্ত করে এর সঠিক পরিচর্যা করা বিভিন্ন পদ্ধতিতে যেমনঅকুপেশনাল থেরাপী, স্পীচলেন্‌গুয়েজ থেরাপী, সেন্সরী ইনটীগ্রেশন থেরাপী, বিশেষায়িত শিক্ষা বা স্পেশালএডুকেশন সহ অনেক অনেক পদ্ধতী যা এখনও প্রর্যন্ত বিভিন্ন গবেষনায় কার্যকরী প্রমানিত। এসব ব্যবস্‌হাপনার মাধ্যমেঅটিজম সমস্যাগ্রস্থদের এক বিশাল অংশকে স্বাবলম্বী করে তোলা যেমন সম্ভব তেমনি অনেকেই হয়তোবা সারা জীবনের জন্য অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারা দুরূহ। এসব বিষয় মাথায় রেখেই নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সমাজে এ বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের একিভূত করার লক্ষ্যে স্থায়ী মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্স ‘মায়াকানন’ প্রতিষ্ঠায় যেটার কন্সট্রাকশন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।

এই সুবিশাল প্রজেক্ট বাস্তবায়নে আপনাদের সকলের আন্তরিক সহযোগিতা ও দোয়া/ আশীর্বাদ বিনীতভাবে কামনা করছি।

আশাকরি সকল চিত্তবান ও বিত্তবানরা আমাদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন। ‘মানুষ মানুষের জন্য’।

লেখক: শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, সভাপতি, নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধকর্ণফুলী পেপার মিল, দ্রব্যমূল্যের কষাঘাত এবং কর্পোরেট পুঁজি