বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্র : বিশিষ্টজনদের অংশগ্রহণ বাড়ুক

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ৬ জুন, ২০২৩ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ টেলিভিশনচট্টগ্রাম কেন্দ্রের বড়ই দুর্ভাগ্য, শুরু থেকেই এ কেন্দ্রটি অনাদরে ও স্নেহহীনতায় বেড়ে উঠেছে। যেন ‘জন্ম থেকেই জ্বলছে’ এ কেন্দ্রটি। কোনো ভালো কাজে প্রশংসা তো জোটেই নি, বরং নিন্দা করেই এর কণ্ঠ রুদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তবে এটাও ঠিক যে, কেন্দ্রটি কিছুদিন ভালো চলে, আবার ফিরে যায় পুরনো দায়সারা মনোভাবে। আমরা বলছি না যে বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠান নিয়ে কেউ সমালোচনা করতে পারবে না। বলছি না যে, সব অনুষ্ঠান ভালো ও উন্নত মানের। তবে অস্বীকার করতে পারবো না যে, এখান থেকেই বহু মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান প্রচার হয়, যা বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

বাংলাদেশ টেলিভিশনচট্টগ্রাম কেন্দ্র নিয়ে নানা অভিযোগ বিভিন্ন মহলের। যাঁরা নিয়মিত অনুষ্ঠান করেন, তাঁদের অভিযোগ এক ধরনের; আবার যাঁরা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না, অনুষ্ঠান পান না, তাঁদের অভিযোগ আরেক ধরনের। গত ১২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন বর্তমান জেনারেল ম্যানেজার। এই কয়েক মাসে তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযোগ তৈরি হয়ে গেছে। প্রোগ্রাম ম্যানেজারের বিরুদ্ধে তো অভিযোগের অন্ত নেই। দুর্মুখরা বলেন, ‘খোদ ফেরেশতাকে এনে এই কেন্দ্রে বসিয়ে দিলেও অভিযোগকারীরা তাঁকেও শয়তানের কাতারে ফেলে দেবেন’। এই অভিযোগ নিয়ে এখন নয়, আগামীতে লিখবো। আপাতত এটুকু বলা যায়, বাংলাদেশ টেলিভিশনচট্টগ্রাম কেন্দ্রের প্রথম জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ ও গত ১২ জানুয়ারি বিটিভির জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত মাহফুজা আক্তার ছাড়া প্রত্যেক জিএম কমবেশি অভিযোগের বোঝা কাঁধে নিয়ে বিদায় নিয়েছেন এখান থেকে। এ অভিযোগ অনেকক্ষেত্রে হয়তো সত্য নয়। তবু সেটা তাঁদের জন্য বিব্রতকর।

দেখতে দেখতে অনেক বছর অতিবাহিত হলো। গত ১৯ ডিসেম্বর ২০২১ ছিল এ কেন্দ্রের রজতজয়ন্তী। এ উপলক্ষ্যে নানা কর্মসূচি উদযাপিত হয়েছে। ‘রজতরেখা’ নামে একটা সংকলন প্রকাশ হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মাটি ও মানুষের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি শিক্ষা এবং সংস্কৃতির বিকাশের লক্ষ্যে এ কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। অনেক পরিশ্রম, আন্দোলন আর সংগ্রামের ফসল আমাদের বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র। এ কেন্দ্রে আছে অনেক সমস্যা, আছে অতৃপ্তি, আছে অনেক সীমাবদ্ধতা। ব্যবস্থাপনাতেও আছে নানা ত্রুটি। তবু আমরা মনে করি, এটি চট্টগ্রামের মানুষের জন্য বড় সম্পদ, বড় প্রাপ্তি। শুরুতে ১৯৯৬ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন কেন্দ্র হিসেবে মাত্র দেড় ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হতো। পরে ধীরে ধীরে তার সমপ্রচার সময় বৃদ্ধি পায়। নানা সংকটের মধ্যেও ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে শুরু হয় ৬ ঘণ্টার স্যাটেলাইট সম্প্রচার কার্যক্রম। ২০১৯ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে শুরু হয় ৯ ঘণ্টার সম্প্রচার। ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় ১২ ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার। ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে বঙ্গবন্ধু১ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠান বহির্বিশ্বেও সম্প্রচার শুরু হয়। প্রায় ত্রিশ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৩৮ ফুট বা ১৩৩ দশমিক ৫ মিটার উঁচু চট্টগ্রাম টেলিভিশন কেন্দ্রের টাওয়ার নির্মাণ সম্পন্ন করা হয়। এই টাওয়ার দিয়ে ১২টি ক্যাবল চ্যানেল ও দুটি টেরিস্ট্রিয়াল চ্যানেল চালানো যায়। টাওয়ারের পাশেই স্থাপন করা হয়েছে ট্রান্সমিশন। এই ট্রান্সমিশন দিয়ে বিটিভি, বিটিভি ওয়ার্ল্ড, সংসদ টিভি ও চট্টগ্রাম টেলিভিশন কেন্দ্র সম্প্রচার করা হচ্ছে। এর ফলে চট্টগ্রামের মত সারাদেশেও বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠান টেরিস্ট্রিয়াল হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ১৮ ঘণ্টা এবং ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচারে গেছে এ কেন্দ্র।

এ কেন্দ্রে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে গত ১২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন নূর আনোয়ার হোসেন রনজু। যোগদানের পূর্বে তিনি বিটিভির কন্ট্রোলার/ প্রোগ্রাম ম্যানেজার (পিএম) (বিভাগীয় প্রধান, অনুষ্ঠান বিভাগ, ঢাকা কেন্দ্র) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছে সাংবাদিকতা দিয়ে। সেহিসেবে গত ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের পিএইচপি ভিআইপি লাউঞ্জে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, আমি এখানে শুধু সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আসিনি। আমি এর আগে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত ছিলাম। সেই পেশার টানেই কিন্তু চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য এসেছি। আমি যতদিন বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকবো, ততদিন এই কেন্দ্রের উন্নয়নে চেষ্টা চালিয়ে যাবো। ভালো লাগলো কথাগুলো শুনে। কিন্তু শিল্পীসমাজ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিনি এখনো পর্যন্ত তাঁর কেন্দ্রকে গোছাতে পারেননি। অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, রেকর্ডিংয়ের সিডিউল ও সম্প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁকে বেগ পেতে হচ্ছে। যার কারণে নিয়মিত অনুষ্ঠানগুলোর যথাযথ প্রচারে বিঘ্ন ঘটছে। বেশ কয়েকটি ভালো অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের শিল্পসাহিত্য, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, ইতিহাস ঐতিহ্য, পর্যটন ও সমস্যাসম্ভাবনা ধারণ করে অনুষ্ঠান নির্মাণ এই কেন্দ্রের মুখ্য বিষয় হলেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যাচ্ছে না বলে মত প্রকাশ করেছেন অনেকে। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছেবর্তমান জিএম অনুষ্ঠান নির্মাণ বিষয়ে যদি একটু তদারকি করেন, তাহলে ‘চট্টগ্রাম’ উঠে আসবে স্বকীয় মর্যাদায়। আমি নিজে শুরু থেকেই এই কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ‘সৃজনে মননে’ নামে প্রকাশনা ও শিল্পসাহিত্য বিষয়ক একটা অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। এখানে আমি প্রশংসার সঙ্গে উল্লেখ করতে পারি, আগের জিএম মাহফুজা আক্তার আমার অনুষ্ঠান রেকর্ডিংয়ের সময়ে ক্যামেরার পেছনে একটা চেয়ারে বসে থাকতেন। একবার দুবার নয়, বেশ কয়েকবার দেখেছি তাঁকে। তাঁর এক বছরের দায়িত্বকালীন নতুন চিন্তা ও পরিকল্পনা প্রত্যক্ষ করেছেন অনেকেই। ঢাকায় অবস্থানরত চট্টগ্রামের লেখকদের কিভাবে একেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়, সেটাও তিনি ভাবতেন। তাঁদের নিয়ে তৈরি করা কয়েকটি অনুষ্ঠান আমাদের প্রীত করেছে।

বর্তমান জিএমএর প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, তিনি যেন নিয়মিত অনুষ্ঠানগুলোর সিডিউলটা দেখেন। পূর্বের জিএমএর সময়ে শিল্পীরা অনুষ্ঠানের রেকর্ড শেষ করেই সম্মানীচেক নিয়ে ফিরতেন। বর্তমানে সেই ধারাবাহিকতায় ঘাটতি দেখছেন তাঁরা। এছাড়া আমরা জানি, শিল্পসাহিত্য বিষয়ে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান প্রচার হয়ে থাকে এ কেন্দ্র থেকে। স্বরচিত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানও হয় দিবসভিত্তিক। চট্টগ্রামে অবস্থানরত কবিসাহিত্যিকরা সেখানে সুযোগ পেয়ে থাকেন। তাঁদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠাগুলো হতে পারে প্রতিনিধিত্বমূলক। কিন্তু অনেকের অভিযোগ, স্বরচিত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে নির্দিষ্ট কয়েকজন কবি ছাড়া অন্যরা সেখানে সুযোগ পান না। আমি নিজে চট্টগ্রামে অবস্থানরত কয়েকজন প্রথম সারির কবির নামও দিয়েছিলাম সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে। পরে দেখা যায়, এসব তোয়াক্কা না করে তাঁরা বারবার একই মুখ নিয়ে আসছেন সেই অনুষ্ঠানে। আগে ঈদ উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামে অবস্থানরত সাংবাদিক ও কবিসাহিত্যিকদের নিয়ে আড্ডার অনুষ্ঠান প্রচার হতো। গত ঈদে দেখা গেলো আড্ডায় এদের স্থান হয়নি।

আমরা চাই, চট্টগ্রামে অবস্থানরত বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা এ কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকুন, অংশগ্রহণ থাকুক তাঁদের। যিনি যে অঙ্গনে বিশিষ্ট, তাঁকে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে রাখা যায়। এ জন্য বলি, জি এমএর সামনে চট্টগ্রামে অবস্থানরত বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনদের একটা তালিকা থাকলে ভালো হতো। এই তালিকা প্রথম দিকে হয়তো অসম্পূর্ণ থাকবে, শুরু করলে ধীরে ধীরে তা পূর্ণাঙ্গ হবে।

আমরা প্রতিদিন নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চট্টগ্রামের রাজনীতিঅর্থনীতি, শিল্পসংস্কৃতি, ইতিহাসঐতিহ্যের চিত্র যেন প্রত্যক্ষ করি। এ সব অঙ্গনের প্রিয় মুখগুলোকে দেখে যেন প্রাণিত হই। চট্টগ্রামের এমন কোনো বিশিষ্ট জন থাকবে না, যাঁকে এই কেন্দ্রের কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে পাবো না।

এই কেন্দ্রের অবকাঠামোগত বেশ উন্নয়ন হয়েছে। নতুন নতুন প্রযোজক এসেছেন, নতুন ক্যামেরা এসেছে, এসেছেন ক্যামেরাম্যান। এডিটিংএর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দুটো স্টুডিও আছে। ভিআইপি কক্ষ করা হয়েছে, যেখানে অপেক্ষা করতে পারেন আগত বিশিষ্টজনরা। বহির্র্দৃশ্য ধারণের ক্ষেত্রে কাজে আসে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বিশাল ও দৃষ্টিনন্দন জায়গাটি। বলা যায় অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে যা যা প্রয়োজন, সবই বিদ্যমান এখানে। মোট কথা, দিন দিন পোক্ত হচ্ছে, সমৃদ্ধ হচ্ছে অভিজ্ঞতায়। আমরা আশা করছি, আগামীতে হবে অনুষ্ঠানের আরো মানোন্নয়ন।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের যানবাহনের একাল-সেকাল
পরবর্তী নিবন্ধডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজে শোক সভা