বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদ

রাশেদ রউফ | বৃহস্পতিবার , ১১ আগস্ট, ২০২২ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদ হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। তবে রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর যে ধরনের প্রতিবাদ এবং ঘাতকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা ছিল, তা হয়নি। ‘কয়েক দিন আগেও বাকশালে যোগ দেওয়ার জন্য গণভবনের সামনে যাঁদের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল, তাঁদের একাংশ রাতারাতি ভোল পাল্টে জবরদখলকারী শাসকদের সঙ্গে হাত মেলান। অনেকে ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তাঁদের বিভ্রান্তি ও হতাশা বেড়ে যায়, যখন দেখলেন কয়েকজন বাদে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্যরাই নতুন সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এই বিমূঢ় অবস্থা কাটিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ সংগঠিত করতে কিছুটা সময় লেগে যায়, যদিও কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে তাৎক্ষণিক মিছিল, প্রতিবাদ হয়েছে। প্রশাসনের মধ্যে বরগুনা মহকুমা প্রশাসক সিরাজউদ্দীন আহমদ স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, যার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র তিন দিন।’ [প্রথম যত প্রতিক্রিয়া / সোহরাব হাসান]।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক প্রতিবাদের পাশাপাশি শিল্পী-সাহিত্যিকদের শিল্পীত প্রতিবাদও ছিল উল্লেখ করার মতো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ হয়েছে শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায়। দেশের নানা প্রান্তের সাহসী কবি, ছড়াকার, শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা কঠিন দুঃসময়েও তাঁদের রচনায় প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা। জীবন বাজি রেখে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরেছিলেন তাঁদের সৃষ্টিকর্মে। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তাঁকে নিয়ে প্রথম কবিতা কে লিখেছিলেন, সেটা নিয়ে নানা কৌতূহল রয়েছে পাঠকমহলে। এ বিষয়ে আজকের এই রচনা।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অন্ধকার সময়ে ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমির একুশের কবিতা পাঠের আসরে প্রথম সাহস দেখান কবি নির্মলেন্দু গুণ। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন : ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’। কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, ‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,/ রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই সব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল/ আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।/ আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।’ কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতাটি বাংলা একাডেমিতে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার মাঝে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। অন্ধকারে এক বিন্দু আলোকরশ্মি দেখা গিয়েছিল। উৎফুল্ল দর্শক-শ্রোতা হয়ে সেই কবিতা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আবার অন্য এক তথ্যে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম কবিতা প্রকাশ করেছিলেন কবি কামাল চৌধুরী। ১৯৭৭ সালে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ‘জয়ধ্বনি’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর কবিতাটির নাম ছিল ‘জাতীয়তাময় জন্মমৃত্যু’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন প্রকাশ করতো এ জয়ধ্বনি পত্রিকা। ‘জাতীয়তাময় জন্মমৃত্যু’ কবিতার লাইনগুলো ছিল এরকম : ‘রক্ত দেখে পালিয়ে গেলে বক্ষপুরে ভয়/ ভাবলে না কার রক্ত এটা স্মৃতিগন্ধময়/ দেখলে না কার জন্মমৃত্যু জাতীয়তাময়।’ এই কবিতার লাইন দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের দেওয়ালে পোস্টার সাঁটা হয়েছিলো তখন।
এ প্রসঙ্গে কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, অনেকেই গোপনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু প্রকাশ করার সাহস পাননি। আমিই প্রথম সাহস দেখিয়েছিলাম। ১৯৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম। কবিতাটা পাঠ শেষে মনে হয়েছিল, আমার বুকের মধ্যে চেপে বসা একটি পাথর অপসারিত হয়ে গেল। অন্যদিকে, কবি কামাল চৌধুরী বলেন, ১৯৭৭ সালের কথা। আমি তখন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। বিশ বছর বয়েস- এখন যখন পেছনে ফিরি, সেই দিনগুলির কথা মনে করি, গৌরববোধ করি এ জন্য যে সেই কঠিন সময়ে সাহস দেখাতে পেরেছিলাম। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যার পর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ছিল আমার। তার কিছুদিন পর প্রথম পঠিত কবিতা ছিল নির্মলেন্দু গুণের ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’।
কবি কামাল চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ১৯৭৬ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সে সময়ের বাংলাদেশ ছিল এক আতংকিত জনপদ। বঙ্গবন্ধুর এই মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ জমা হয়েছিলো হৃদয়ে। কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না এই হত্যাকাণ্ড। বুকের ভেতর তীব্র প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিলো, প্রতিবাদী হয়ে উঠছিলো মন। কিন্তু সময় প্রতিকূল-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘাতকরা তৎপর, ছাত্রদের মধ্যেও তারা পেটোয়া বাহিনী তৈরি করেছে প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে। ১৯৭৭ সালের শেষদিকের ঘটনা। তারিখটা আজ আর মনে নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাশে তখন কয়েকটি চায়ের দোকান ছিলো। শরিফ মিয়ার স্টলে ষাটের দশকের কবিরা আড্ডা দিতেন। তার পাশেই ছিলো গফুর মিয়ার দোকান। আমরা সত্তরের দশকের তরুণ কবি-লেখকেরা গফুর মিয়ার দোকানে আড্ডা দিতে শুরু করলাম। এখানে বসেই আমি -‘মুজিব লোকান্তরে/ মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে’ শ্লোগানটি লিখলাম। ছাত্রলীগের একজন নেতা ছিলেন, আমার এক বছরের সিনিয়র, নাম মোহাম্মদ হায়দার আলী। থাকতেন হাজী মোহাম্মদ মহসিন হলে। হায়দার ভাই ছিলেন দেয়াল লিখনে ওস্তাদ। সে দিনই লেখাটি হায়দার ভাইয়ের হাতে দিলাম। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে হায়দার ভাইয়ের ঝকঝকে হাতের লেখায় ফুটে উঠলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী শ্লোগান : ‘মুজিব লোকান্তরে মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে’। পরবর্তীতে শ্লোগানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৭৯ সালের ছাত্রলীগের সংকলনের নাম করা হয় ‘মুজিব লোকান্তরে মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে’। তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন জনাব ওবায়দুল কাদের, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জনাব বাহলুল মজনুন চুন্নু। আজ যখন ভাবি, সেই দুঃসময়ের সাহসী এ কাজের কথা, তখন আবেগে উদ্বেলিত হই। কবিতার আবেগ আমাকে প্রবলভাবে সাহসী করে তুলেছিলে। হত্যার বিরুদ্ধে, মৃত্যুর বিরুদ্ধে, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস জুগিয়েছিলে। ১৯৭৭ সালে ঘাতক কবলিত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানাবার এই দুঃসাহস আজও আমার অহংকার।”
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও প্রাবন্ধিক মফিদুল হক ভিন্নমত তুলে ধরেছেন তাঁর একটি প্রবন্ধে। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশে তাঁকে নিয়ে প্রথম কবিতা লেখা হয়েছিল আরবিতে, দ্বিতীয় কবিতা রচিত হয়েছিল উর্দুতে আর তৃতীয় কবিতাটি রচিত হয়েছিল বাংলায়। ‘নওশাদ নূরী ও তার একটি কবিতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে মফিদুল হক লিখেছেন, ‘ইতিহাস এবং তার এক বিশেষ ক্ষণের পটভূমিকায় বিচার করলে আমাদের বিস্মিত হতে হয়, বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম কবিতাটি রচিত হয় আরবিতে, এরপর উর্দুতে এবং তাৎপর্যময় তৃতীয় কবিতাটি বাংলায়। প্রথম কবিতার রচয়িতা শেখ আবদুল হালিম, দ্বিতীয় কবিতার রচয়িতা নওশাদ নূরী এবং তৃতীয় কবিতার রচয়িতা নির্মলেন্দু গুণ এভাবে প্রথিত হয়ে যান জাতির ইতিহাসের সঙ্গে।’
প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই ঘটে অবিস্মরণীয় এক ঘটনা। কয়েকজন সাহসী মানুষ উদিত হলেন বইমেলার মাঠে, কবিতা পাঠের আসরের শামিয়ানার আশপাশে। তাঁদের হাতে বঙ্গবন্ধুকে বিষয় করে রচিত একগুচ্ছ ছড়া আর কবিতার অনন্যসাধারণ সংকলন ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’।
জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রকাশিত প্রথম সংকলন ছিল এটি। এককভাবে সংকলনটির কোনো সম্পাদক না থাকলেও এই সংকলনের নেপথ্যে ছিলেন আবদুল আজীজ। সংকলনটি প্রকাশের পরিকল্পনা, লেখা সংগ্রহ, ছাপাখানা নির্ধারণ, মুদ্রণব্যয় জোগাড়, প্রচ্ছদ নির্মাণসহ নানা কাজে সহযোগিতা করেছিলেন ভীষ্মদেব চৌধুরী, সিরাজুল ফরিদ, আলতাফ আলী হাসু, নূর-উদ-দীন শেখ এবং আর্টিস্ট মানিক দে।
যদিও এর আগে ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ শিরোনামে একটি ছোট্ট লিফলেট প্রকাশ করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টি ‘ওদের ক্ষমা নেই’ ও ‘ইস্পাত’ নামে বুলেটিনও প্রকাশ করেছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। গ্রন্থটির নাম ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’। বইটির সম্পাদক ছিলেন কবি মিনার মনসুর ও কবি দিলওয়ার চৌধুরী।
সম্পাদক মিনার মনসুর জানান, ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ প্রথম সংকলন। কিন্তু তা গ্রন্থাকারে বের হয়নি। বের হয়েছিল লিটল ম্যাগাজিন আকারে। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তাঁকে নিয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম সংকলন ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’। ঐতিহাসিক সংকলন ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ বইটির লেখক সূচিতে ছিলেন ড. মযহারুল ইসলাম, ড. আবদুল মতিন চৌধুরী, ড. কবীর চৌধুরী, ইসমাইল মোহাম্মদ, সন্তোষ গুপ্ত, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মাহাদেব সাহা, জাহিদুল হক, ওমর আলী, শাহাদাত বুলবুল, ফজলুল হক সরকার, শামসুল আলম সাঈদ, খালিদ আহসান, কামাল চৌধুরী, মিনার মনসুর, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবসার হাবীব, জাফর ওয়াজেদ, দিলওয়ার চৌধুরী, আলমগীর রেজা চৌধুরী, হারুন রশিদ, নাজিম হাসান, সুজাউদ্দিন কায়সার, বিনতা শাহীন, সনজীব বড়ুয়া, রবীন্দ্রনাথ অধিকারী, ইকবাল করিম, স্বপন দত্ত, শিশির দত্ত, খোরশেদ আলম সুজন, ইসরাইল খান ও জমীর চৌধুরী।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধফুটপাতে ওয়াসার পাম্প হাউজ!
পরবর্তী নিবন্ধচমেক হাসপাতাল গাইনি ওয়ার্ড থেকে ধরা আরো এক দালাল