বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ

বাঙালির স্বাধীনতা

ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী | শনিবার , ২৬ মার্চ, ২০২২ at ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ

রক্তস্নাত ভোরের আবাহন ছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। পূর্ব দিগন্তে সেদিনের যে রক্তলাল সূর্য উদয় হয়েছিল, তার রক্ত লালিমা যেন ৩০ লক্ষ শহিদের বুকের তাজা শোণিত ধারা। আর এই স্বাধীনতার মহানায়ক- মুখ্য কুশীলব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার শৃংখল-মুক্তি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ড লাল-সবুজের পতাকা অর্জনের উদ্দীপক বীর মুক্তিযোদ্ধারা। যাঁরা ছিলেন সাহসী সৈনিক-সূর্যসন্তান।
বাংলা ও বাঙালির মহান স্বাধীনতার শ্রদ্ধার্ঘ্যমাখা তর্পণ নিয়ে স্মরণ করি ৩০ লক্ষ শহিদ- যাঁরা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য নির্ভিকচিত্তে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। স্মরণ করি ২ লক্ষ বীরঙ্গনা মা-বোনদের, যাঁরা আমাদের এই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য নিজেদের সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়েছিলেন।
বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন এই স্বাধীনতা হঠাৎ করে পাওয়া ভূঁইফোঁড় কোনো তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি নয়। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো বাঙালির সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর উত্তোলিত তর্জনীর আহবান- “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো/ প্রত্যেক মহল্লায় মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো/ যার যা কিছু আছে তা দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।” এই দীপ্ত নির্দেশনা ছিলো বস্তুত স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধুর এই তেজদীপ্ত ডাকে সমস্ত বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা-নারী-পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়লো মৃত্যু আলিঙ্গনে।
বাঙালি মূলত শান্তিপ্রিয় জাতি। গঙ্গা বিধৌত এই ভাটি বাংলা পলল ভূমির নৃ-তাত্ত্বিক ইতিহাস হাজার বছরের। পাহাড়পুর-ওয়ারি-বটেশ্বর প্রভৃতি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বাংলার সমৃদ্ধ সভ্যতা, নগর পত্তন ও অগ্রগামিতার পরিচয়বাহী। বাঙালির মনীষী অতীশ দীপঙ্কর তাঁর মহান বাণী সহযোগে পৌঁছে গিয়েছিলেন বাধার বিন্ধ্যাচল হিমালয় পেরিয়ে সুদূর চীনে। নেপালের কপিলাবস্তুতে জন্ম নেওয়া গৌতম বুদ্ধ অনেকটা বাঙালি। কেননা দিনাজপুরের পঞ্চগড় থেকে ওই স্থানের সন্নিকটতা এই প্রতীতির সরসতা বহন করে। তো, চিন্তা-চেতনায়-বল-বীর্যে বাঙালির গৌরবগাথা ইতিহাসের ধূসর পৃষ্ঠায় সমহিমায় বিরাজমান আমাদের এই বাংলা ছিলো বস্তুত একটি শান্তির জনপদ। কিন্তু শৌর্যে ও তেজস্বীতায় বাঙালির গৌরব ঊন নয়। আমরা মহাবীর আলেকজান্ডার ও পুরুর সেই কিংবদন্তিপ্রতিম ঘটনা অবগত। পুরুর রাজ্য ছিলো মূলত প্রাচীন বাংলার জনপদ। সেই সময়ের পুরুর রাজ্যের হস্তিবাহিনীর অমিত যুদ্ধকৌশল ও শক্তি অবগত হয়েই তার জয়যাত্রা দক্ষিণাবর্তে অগ্রসর হয়নি। উত্তরাবর্তেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আরো অতীতে তাকালে দেখতে পাই- আর্যরা সিন্ধু নদী অতিক্রম করে আদি ভারতবর্ষে পদার্পণ করে। সেসময় বিন্ধ্যা পর্বত দক্ষিণাংশে বসত ছিলো অস্ট্রিক-দ্রাবিড় সম্প্রদায়ের। আমরা তাদেরই উত্তরসূরী।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে পাই- একসো পাদুমা তার চৌষট্টি পাখুড়ি/তহি চড়ই নাচই ডোম্বি বাখুড়ি… এর অর্থ হলো- এক সে পদ্ম তার চৌষট্টি পাপড়ি/ তাতে চড়ে নাচছে ডোমের বেটিটি। এই আদিম সমাজের বাঙালিরা ভীম-কোল-নিজাদ প্রভৃতি জাতিতে বিভক্ত ছিলো। আর্যরা তাদেরই উত্তরসূরী। কালক্রমে বিশ্বকবি ‘সহমন’ কবিতায় লেখেন- “কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা/দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা/হেথায় আর্য, হেথায় অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন/শক-হুন-দল পাঠান মোঘল এক দেহে হল লীন।” বাংলা ছিলো একটি সমৃদ্ধ জনপদ এখানে ছিলো গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ। আদিম গ্রাম-সমাজ ছিলো কৃষিপ্রধান এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ।
১৭৫৭ সালে বাংলার সীমিত স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলো। ব্রিটিশ বেনিয়ারা দখলে নিলো এদশের শাসন ভার। কার্ল মার্কস ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রশ্নে’ গ্রন্থে রেললাইন প্রতিষ্ঠাকে হাজার বছরের গ্রাম সমাজের ভেঙে দেওয়া বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত ছিলো তা-ই। প্রথা বিরোধী লেখক নীরদ সি চৌধুরী ব্রিটিশদের আগমনকে অগ্রসরমানতার দিকে যাত্রা বলেছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘কালান্তর’।
শান্তি ও সুখের জনপদে ইংরেজ বেনিয়ারা সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করে ভ্রাতৃঘাতী বিরোধ ও রক্তপাতের বীজ বপন করে দেয়। তারা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুলস’ নীতির আলোকে দু’টি ক্ষণস্থায়ী বিকলাঙ্গ রাষ্ট্র সৃষ্টি করে দেয় যার জন্মটাই ছিলো উদ্ভট ও অস্বাভাবিক। সে কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। আর এই স্বাজাত্য প্রেমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখার বীজ রোপণ করে মহীরূহে রূপান্তরিত করেন। আর এর ভিত্তিতে কর্মপ্রবাহ পরিচালিত করেন। স্বাধীনতার লক্ষ্যে তিনি গঠন করেন নিউক্লিয়াস।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ছিলো বঙ্গবন্ধুর অন্যতম লালিত স্বপ্ন। ৬৯’র এর ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনি স্বকণ্ঠে স্লোগান দেন- ‘আমার দেশ/তোমার দেশ/ বাংলাদেশ/ বাংলাদেশ।’ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যা কিছু সংঘটিত হয়েছে সবকিছু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই হয়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৫২ সালে বলেছিলেন, ‘একদিন আমি দক্ষিণ অফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হবো।’ আর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘একদিন আমি এই দেশকে স্বাধীন করবো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রিত্ব আমার কাছে তুচ্ছ।’ আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে ধাপে ধাপে তাঁর আরাধ্য কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এই-ই হলো বাংলা ও বাঙালির গৌরব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার এই পবিত্র লগ্নে তাঁর স্মৃতি তর্পণ করছি পরম শ্রদ্ধায়।
লেখক : সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাবন্ধিক ও গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেষের দেশের ভাব
পরবর্তী নিবন্ধস্বাধীনতার সুফল আজ উন্নয়নের এই বাংলাদেশ