ফুটনোট

অপূর্ব জাহাঙ্গীর | শুক্রবার , ৮ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

“নতুন বছর নতুন দিন নতুন আমি” এই স্লোগানের দোহাই দিয়েই এই বছরটা শুরু করতে চাই। লেখাটা লিখছি জানুয়ারির ২ তারিখ, বাইরে এখনো টুকটাক সেলিব্রেশনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। চারিপাশের মানুষ জোরে শোরে ২০২০ -এর পতন উৎযাপন করছেন। আর সেই আওয়াজকে কমাতে আমি আলাপ করছি বব ডিলানের সাথে। আমাকে সে বার বার বলে যাচ্ছে ঞরসবং ধৎব ধ পযধহমরহম.
সময়টা তখন ১৯৭০। বিশ্ব হতচকিত। কেন? কারণ বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলস ভেঙ্গে যাচ্ছে! ব্যান্ড সদস্য পল ম্যাককার্টনি আর জন লেনন মিডিয়ার সামনে একে অন্যকে এক হাত দেখে নিচ্ছেন প্রায় প্রতিদিন। আর সেই সময়ই কিন্তু জর্জ হ্যারিসন, বিটলের মৃদুভাষী সদস্য বেরিয়ে পড়েছেন রক এন্ড রোল ঘরানার নতুন ইতিহাস গড়তে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে চলমান রেফুজি সংকটের একরকম সুরাহা করতে রবি শংকর আর জর্জ হ্যারিসন ছক আঁকছেন এক কন্সার্টের। উনারা তখনো জানতেন না যে তাদের এই কন্সার্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এবং যুগান্তকারী কনসার্টগুলোর একটা হতে যাচ্ছে। হাজারেরও বেশি মানুষ জড়ো হয়েছিল সেবার নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে। আমেরিকানদের জন্য এক বিটেল কে পারফর্ম করতে দেখা বেশ বড় ব্যাপার। তবে জর্জ হ্যারিসনের মতে ওইদিনের শো স্টপার ছিলেন আরেকজন। এমন একজন যিনি দুই বছর ধরে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছিলেন। আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বলা যাচ্ছিলো না সেই ব্যক্তি উপস্থিত থাকবেন কিনা, এমনকি যব ফরফহ্থঃ বাবহ ংযড় িঁঢ় ভড়ৎ ঃযব ফধু্থং ংড়ঁহফ পযবপশ. তবে তিনি এলেন স্টেজে উঠার ঠিক আগ মুহূর্তে কাধে গিটার হাঁতে। পুরো ম্যাডিসন স্কয়ার গেয়ে উঠলো ঐড় িসধহু ৎড়ধফং পধহ ধ সধহ ধিষশ ফড়হি! ৭০ দশকটা ছিলে শান্তি এবং যুদ্ধ বিরোধী উদ্যোগের সূচনাপর্ব। তৎকালীন তরুণ প্রজন্ম জন লেননের পেছনে দাঁড়িয়ে ক্রমবর্ধমান যুদ্ধ বিগ্রহে অতিষ্ঠ হয়ে স্লোগান দিয়েছিল “গিভ পিস এ চান্স”। কন্সার্ট ফর বাংলাদেশ সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক কনসার্টগুলোর একটি জয়া দ্বারা রক এন্ড রোল তাঁর মানবিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিল। তাই আমি মনে করি এমন আয়োজনে ডিলানের উপস্থিতি অনেকটা ঐশ্বরিক বিধানের মতই অনিবার্য ছিল।
আমার স্পিকার থেকে এখন ভেসে আসছে উডি গাথ্রির ঞযরং ষধহফ রং ুড়ঁৎ ষধহফ। যেই গান শুনে বব ডিলান তার গিটারটি হাতে নিয়েছিল। ডিলানের শুরু হয়েছিল নিউ ইয়র্কের গ্রিনউইচ ভিলেজ থেকে। ডিলান আর তাঁর ফেলো কমরেড পিট সিগার, জোন বায়াজরা নেমে এসেছিলেন মাটির কাছের মানুষদের মাঝে তাদের সঙ্গীত নিয়ে। এই অখ্যাত পাড়ার কফি সঁপের নিয়মিত খদ্দেররা তাদের আভান্ত গার্ড বা এঙপেরিমেন্টাল হবার স্বাধীনতা দিতেন, অনুপ্রেরণা দিতেন।
তাঁর প্রতিটা গানেই ছিল এই ঘুণে ধরা সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করে লেখা একেকটা স্টেটমেন্ট। যেমন – ঐড় িসধহু ফবধঃযং রিষষ রঃ ঃধশব ঃরষষ ঃযবু শহড় ি/ ঃযধঃ ঃড়ড় সধহু ঢ়বড়ঢ়ষব যধাব ফরবফ? স্বাধীনতার মুখোশে শত কোটি মানুষের মৃত্যুকে ধিক্কার জানায়। ডিলানের এই লাইনটা অনেকটা ডিলান কমরেডদের জন্য “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” শ্রেণির। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন যে গিটার হাতে বসে থাকাকেই শিল্পী বলে না, নাম যশ খ্যাতির ঊর্ধ্বে শিল্পীদের বৃহত্তর কর্ম আসলে কি।
আবার আরেকটা ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে ঃযব ংঁনলবপঃং ড়ভ উুষধহ ংড়হমং। বাইবেল থেকে শেঙপিয়ার, রূপকথা থেকে বিজ্ঞান, সবখানের ছোঁয়া তাঁর গানে আছে। এমন তারকা খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গান গাইছে, যা প্রথাগত ঘরানার বাইরে, আবার একইসাথে বিলবোর্ডে টপচার্টে থাকছে ঠিক একজন পপ তারকার মত। জ্যাক নিকোলসন যথার্থই বলেছিলেন, ডিলান আমাদের পপ সংগীত ঘরানায় প্রজ্ঞা এনেছেন।
১৩ অক্টোবর, ২০১৬, পপ যুগের রক নেতা পেলেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। যুক্তরাষ্ট্রের সংগীত ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক ধারা সৃষ্টির স্বীকৃতি হিসেবে ডিলানকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয় বলে জানিয়েছে রয়েল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস। সুইডিশ অ্যাকাডেমি বলছে, ‘অ্যামেরিকার সংগীত ধারায় নতুন কাব্যিক দ্যোতনা সৃষ্টির’ জন্য রক, ফোক, কান্ট্রি মিউজিকের এই কিংবদন্তিকে নোবেল পুরস্কারের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে। ডিলান, ৭৫ বছর বয়সী ২৫৯ তম আমেরিকান যিনি এই পুরস্কারটি পেলেন। খবরটি বের হবার সাথে সাথেই পুরো বিশ্ব মাতল ডিলানকে নিয়ে। কিন্তু মৃদুভাষী ডিলান রইলেন একেবারেই চুপ। সময় বাড়ল, সাথে বাড়ল প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনা। স্টিফেকন কিং বললেন ঃযব নৎরষষরধহঃ রহযবৎরঃড়ৎ ড়ভ ঃযব নধৎফরপ ঃৎধফরঃরড়হ. এতদিন পর লিরিক সাহিত্য জায়গা পেলো তাঁর যথার্থ দরবারে।
ডিলানের মত চুপচাপ মানুষ সুর ও কথার ছোঁয়াতে তাঁর ভেতরের সমস্ত আলাপ সেরে গিয়েছেন। নোবেল পুরস্কার অনেক বড় প্রাপ্তি হলেও বব ডিলানকে শুধুই কি নোবেল প্রাইজ উইনার বলা যায়? এ বলতে আমি নারাজ। আমি মনে করি উনি এসবের অনেক ঊর্ধ্বে। লেনার্ড কহেন যথার্থই বলেছেন, এ যেন মাউন্ট এভারেস্টকে স্বর্ণপদক দিয়ে বিশ্বের উচ্চতম পর্বত হিসেবে ঘোষণা দেয়া। ডিলান ডিলানই থাক, মানুষের থাক।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে যে আজ হঠাৎ ডিলান নিয়ে কেন লিখছি। কারণ এই বছর চিন্তা করেছি যখনই কোন দোটানায় পরব তখন নিজেকে জিজ্ঞেস করবো, ডযধঃ ড়িঁষফ উুষধহ ফড়?
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমার্কিন কংগ্রেস ভবনের ভেতরে থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা