প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৪ মার্চ, ২০২১ at ৮:১৩ পূর্বাহ্ণ

সুলতানী আমলে তুরস্ক আরব ও ইউরোপ নিয়ে বিশ্বের বিশাল অংশ শাসন করত। ১ম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সাথে তুরস্কের পরাজয় এবং এর প্রভাবে তুর্কি সুলতানাতের বিশাল সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। তারপরও বর্তমান তুরস্কের পরিধি ১০ লাখ ১ হাজার ৫ শত বর্গ কি.মি। যা আমাদের বাংলাদেশের প্রায় ৬ গুণ বড়। জনসংখ্যা ৮২ মিলিয়ন অর্থাৎ ৮ কোটি ২ লাখ প্রায় (২০১৯ জরীপে)।
তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এর্দোগান। তিনি বিশ্বে রাজা, বাদশাহ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীগণের মধ্যে অন্যতম সাহসী ব্যক্তিত্ব হিসেবে মুসলিম বিশ্বে বিবেচিত বলা চলে। বিশেষ করে মুসলিম কল্যাণে ন্যায় নীতিতে থেকে। এতে পশ্চিমা বিশ্বের বাঁকা দৃষ্টি থাকলেও এ সাহসী ব্যক্তিত্ব এসব কিছু পরোয়া করে বলে মনে হয় না।
যুগে যুগে বিশ্বে মুসলমানের কল্যাণে অনেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। তৎমধ্যে সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, আলজেরিয়ার বুমেদীন, ইন্দোনেশিয়ার সুকুর্ণ, মালয়শিয়ার মাহাথির মুহাম্মদ অন্যতম। আজ মাহাথির মুহাম্মদ অতি বার্ধক্যে জীবনের শেষপ্রান্তে। বিশ্বে মুসলমানদের নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব ছিল হেজাজ নিয়ে সৌদি আরবের। পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা হাজার বছর হেজাজ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত, যা ১৯২৪ সাল থেকে বর্তমান সৌদি আরবের অন্তর্ভুক্ত। মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে সাথে নিয়ে বাদশাহ ফয়সল বিশ্বে মুসলমানগণের কল্যাণে ভূমিকা পালন করেছিলেন। পশ্চিমা বিশ্বের চোখ রাঙানো হুমকি ধামকি উপেক্ষা করে তেল অবরোধ করেছিলেন বাদশাহ ফয়সল। সে জন্য বিশ্বে তেলের জন্য হাহাকার পড়ে যায়। ১৯৬৭ এর ইসরাইলী যুদ্ধের প্রতিশোধ নিতে ১৯৭৩ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বাদশাহ ফয়সালের সমর্থন নিয়ে নিজেদের ১৯৬৭ এর যুদ্ধে হস্তচ্যুত সিনাই উপদ্বীপ পুনরুদ্ধারে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। ১৭ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার পথে। এতে ইহুদি ইসরাইলের বন্ধু আমেরিকা সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বসে, ফলে যুদ্ধ বিরতি হয়। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে ৬০ হাজার বর্গ কি.মি বিশাল সিনাই উপদ্বীপ অঞ্চল ইসরাইল মিশরকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু জর্ডানের পূর্ব জেরুজালেম ও সিরিয়ার গোলান মালভূমি ফিরে পাওয়া গেল না। পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাদশাহ ফয়সল ও প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে শহীদ করা হয় বলে প্রচার রয়েছে। বাদশাহ খালেদ, অতঃপর বাদশাহ ফাহাদ, তারপর বাদশাহ আবদুল্লাহ সৌদি আরব শাসন করেন। এরপর ক্ষমতায় বাদশাহ ফাহাদের সহোদর ছোট ভাই সালমান।
যেখানে বাদশাহ ফয়সলের উত্তরসূরী স্থলে বাদশাহ সালমানই মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে দেয়ার কথা সেখানে ভুল পররাষ্ট্রনীতিসহ প্রাসাদ কোন্দলসহ নানান কারণে নিজের দেশ নিয়ে চিন্তায়। মুসলিম বিশ্বের কল্যাণ চিন্তা করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। আরববসন্তসহ নানান কারণে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে অনেক ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতায় রয়েছে।
তুরস্কেরও আভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতা যে নাই তা বলা যাবে না। তারপরও প্রেসিডেন্ট এর্দোগান বিশ্ব মুসলমানের কল্যাণে চিন্তায় যতটুকু সম্ভব ভূমিকা পালন করছেন তা প্রশংসার দাবিদার।
১৯৫৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রিসেপ তায়েপ এর্দোগানের জন্ম। আরবের অধিকাংশ শাসকের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও সাধারণ মুসলিম জনগণের মাঝে এর্দোগানের জনপ্রিয়তা হু-হু করে বাড়তেই আছে। অনারবত আছেই, আরব জনগণের মাঝেও তার জনপ্রিয়তা দ্রুত বেড়ে গেছে।
১৯৯৪ সালে তিনি ইসলামিক কল্যাণ পার্টি থেকে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৯৮ সালে একটি ভাষণের কারণে ৪ মাসের জন্য তাকে দণ্ডিত করা হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালে তিনি মধ্যপন্থি রক্ষণশীল এ,কে পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে নির্বাচনে জয় লাভ করে এর্দোগান প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৩-১৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হন। শাসনতন্ত্র সংশোধন এবং এর অনুকূলে ভোট পেয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। ২০১৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হন। আমেরিকায় বসবাসকারী এর্দোগানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফতুল্লা গুলেন, তুরস্কসহ বিশ্বের অনেক দেশে তার দল, সংগঠনের ব্যাপক কর্ম তৎপরতা রয়েছে। ফতুল্লা গুলেনকে সাথে নিয়ে আমেরিকা অভ্যুত্থান ঘটায় বলে বিশ্বে বহুল প্রচারিত। তবে এর্দোগানের প্রতি তুর্কি জনগণের বিশাল জনপ্রিয়তা থাকায় তাঁর আহ্বানে হাজার হাজার সাহসী জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে আসে । যার কারণে সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়।
বর্তমানে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব এর্দোগানকে সহ্য করতে পারছে বলে মনে হয় না। তার মূলে বিশ্ব মুসলমানের কল্যাণে তার সাহসী ভূমিকা।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে রাজতন্ত্রীয় আরব রাষ্ট্র আমেরিকাকে খুশি করতে ইসরাইলের প্রতি নমনীয়। একাধিক দেশ কূটনীতিক সম্পর্ক, বিমান যাতায়াত চালু করেছে। তার মূলে জনগণের অনুভূতিকে উপেক্ষা করে রাজতন্ত্রীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে এসব করা হচ্ছে।
এক জনমত জরিপে ফিলিস্তিন ইস্যুতে সাধারণ আরব জনগণের আবেগের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা ইসরাইলের সাথে সম্পর্কে ইচ্ছুক আরব নেতাদের মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। অর্থাৎ ৮৮ শতাংশ আরব ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিপক্ষে।
যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপসাগরীয় রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ গিওর্গিও বলেন, অনির্বাচিত আরব শাসকদের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা আর আরব জনগণের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা এক বিষয় নয়। এসব কিছুর প্রতিফলনে এও বুঝা যায়, ইসরাইল নীতিতে আরবসহ মুসলিম বিশ্ব এর্দোগান ও ইরানের প্রতি সহমর্মিতা, একাত্মতাবোধ দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে।
তুরস্কের অভ্যন্তরে এর্দোগানের দেশপ্রেম, সাহসী পদক্ষেপ মুসলিম বিশ্বের কল্যাণে ভূমিকা পালনে বিরোধীরা সুবিধা করে উঠতে পারছে না।
আমাদের বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। নিজের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত ৮/১০ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে সহমর্মিতা দেখাতে এর্দোগান তাঁর স্ত্রীকে পাঠান আমাদের দেশে। মুসলিম বিশ্বের কোন রাজা বাদশাহ প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা তাদের স্ত্রী রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে এসেছেন বলে মনে পড়ে না।
তুরস্কের আভ্যন্তরীণ সমস্যাও কম নয়। কুর্দি বিদ্রোহ, সিরিয়া ইরাক পার্শ্ববর্তী দেশে অশান্ত পরিবেশ তুরস্কের জন্য মাথা ব্যথার কারণ। তারপরেও এর্দোগান দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবকছিু কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।
বিশ্বে প্রায় ১৩০ কোটি মুসলমানের বসবাস। তৎমধ্যে এর্দোগানই মুসলিম বিশ্বে অন্যতম নেতা হিসেবে বিবেচিত বলা যাবে। আরব বা অনারব যে কোন মুসলমান এর্দোগানের প্রতি নেতৃত্বের আসনে থাকার যোগ্যতা মনে হয় শতকরা ৯৫ জন মুসলমান একমত হবেন। তুরস্কের পাশাপাশি মুসলিমের বিশ্বে কল্যাণে রিসেপ তাইয়েপ এর্দোগানের সাহসী ভূমিকার সফলতা কামনা করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবন খালিদের প্রতি সুবিচার করেনি
পরবর্তী নিবন্ধফটিকছড়ির এসএসসি ৯৩ ব্যাচের মিলনমেলা