প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র মক্কায় ও রাজশাহীতে আহলে হাদীস মতানুসারীর সাথে আলাপ

পবিত্র মক্কায় ও রাজশাহীতে আহলে হাদীস মতানুসারীর সাথে আলাপ আহলে হাদীস বা সালাফি। গত ২০/৩০ বছর থেকে দ্রুততার সাথে এ মতাদর্শ সহীহ বলে প্রচার চলছে। সংখ্যাও দ্রুততার সাথে বাড়তেছে। গত ২০১৯ হজ্বের পর মসজিদুল হারমে এবং গত (২০২০) মার্চের প্রথম সপ্তাহে রাজশাহীতে এ মতাদর্শের প্রধানের সাথে মতবিনিময় করার সুযোগ হয়।
১৪ শত বছরের ইতিহাসে মাজহাব ধর্মের প্রধান মাধ্যম ছিল, সাথে সুফিজম তথা তরিক্বত। ৪ মাজহাবের মধ্যে বিশ্বের এক এক অঞ্চলে এক এক মাজহাবের প্রাধান্য। তেমনি তরিক্বতেও বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। গত ১৪ শত বছরের ইতিহাসে আহলে হাদীস তথা সালাফীতে তেমন ব্যাপকতা ছিল না মনে করি। ফলে বর্তমান সৌদি আরবের সচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা ধর্মীয় উচ্চতর জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে হয়ত ভারতবর্ষ অথবা বাগদাদ, দামেস্ক, কায়রো ইত্যাদি অঞ্চলে গমন করতেন। এসব অঞ্চলে কোন না কোন মাজহাবের প্রাধান্য ছিল।
বর্তমানকালে সৌদি সরকার ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে কোটি কোটি রিয়াল ব্যয় করতেছে। এ খাত থেকে একটি বড় অংক ব্যয় করা হচ্ছে সালাফী তথা আহলে হাদীস ইসলামিক সঠিক মতাদর্শ বলে প্রচার করে। অবাক করা ব্যাপার লক্ষ লক্ষ হজ্ব ওমরাকারীগণকে বিভিন্ন ভাষায় বিনামূল্যে বই পুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে। অন্যতম মূল উদ্দেশ্য; সালাফী তথা আহলে হাদীসই সঠিক, সেই মতে চলা। অন্য সব শিরক বেদআত, তা থেকে দূরে থাকা। এতে আমাদের দেশে এর প্রতিফলন ঘটতেছে। আহলে হাদীসগণের সংখ্যা দ্রুত বাড়তেছে। বড় বড় মসজিদ গুলোতে মাগরিব, এশা, ফজরের নামাজে সূরা ফাতিহার পর পর সমন্বয়ে আমিন বলার সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে।
বয়স্কজন মাজহাব, সুফিজম মানলেও সন্তানেরা মনে করতেছে আব্বারা, মুরব্বিরা, বয়স্করা সেকেলে। তখন ইসলামের তেমন গবেষণা ছিল না, লেখাপড়া কম ছিল। তাই তাদের ভুলেই জীবন। অনেক সন্তানেরা যুক্তি দেখায়, অনেক সন্তানেরা নীরব থাকে।
হজ্ব আল্লাহ পাকের বাৎসরিক উৎসব। প্রায় বছরই মন থেকে তাড়িত হই এ উৎসবে যোগ দিতে। গত ২০১৯ হজ্বের পর মসজিদের হারমের মুদির এর অফিসে এবং গ্রাউন্ড ফ্লোরের ২/৩ জায়গায় হাজীগণের তথ্য কেন্দ্রে যাই। দুই হারমের প্রধান মুদির মসজিদুল হারমের বিখ্যাত খতিব শেখ সুদাইসী। তার অধীনে মসজিদুল হারম ও মসজিদে নববীর পৃথক পৃথক মুদির তথা ডাইরেক্টর বা পরিচালক রয়েছে। তার সাথে সাক্ষাৎ পেতে প্রচেষ্টা চালাতে হয়েছে। সাক্ষাৎ এর সময় ডেপুটি মুদিরও ছিল। সাক্ষাতে মূল বিষয় ছিল আমরা লক্ষাধিক মানুষ মিসফালায় থাকি। এ পথ দিয়ে পবিত্র মক্কায় অবস্থানরত লাখ লাখ হাজী নামাজ ও তাওয়াফ করতে আসে। আপনারা ব্যারিকেড দিচ্ছেন তা অমানবিক। মাত্র ৮/১০ হাজার ধনী হাজীর কল্যাণে জমজম (ক্লক টাওয়ার) কমপ্লেঙ, মক্কা টাওয়ার (হিলটন টাওয়ার), দার আল-তৌহিদ হোটেল মসজিদে হারমের চত্তরে লাগানো। এখানেই এ তিনটি হোটেল নির্মাণ গ্রহণযোগ্য নয়। রাজতন্ত্র তথা কঠোর আইনের শাসনের দেশ। কারও মতামত উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। বিন্দু বিন্দু সাগর। রাজ পরিবার মানুক বা না মানুক বাংলাদেশী একজন হজ্বযাত্রী হিসেবে মুদিরের মাধ্যমে আমার চরম অসন্তুষ্টি পৌঁছার চেষ্টা করি।
আগে থেকে প্রোগ্রাম করা ছিল, এতে আমাদের জন্য তারা সময়ও রেখেছে। এ সুযোগে বললাম- এখানে আসরের জামাত পড়তেছি আমাদের মাজহাব মতে আসরের টাইমের আগে হচ্ছে। এতে তারা ২ জন হতবাক হয়ে যান, যেহেতু হানাফী মাজহাবের এ বিষয়টি তাদের জানা ছিল না। তখন ডেপুটি মুদির প্রশ্ন করলেন ফজরের ওয়াক্তে কোন সমস্যা আছে কি না? বললাম অন্য চার ওয়াক্তে ওয়াক্তের ভিতর নামাজ হচ্ছে, কোন সমস্যা নাই। এখানে অবশ্য তাদের আতিথেয়তা, হাদিয়া, সম্মান স্মরণীয়। হজ্বের পর অন্যান্য দিন মসজিদুল হারমের হাজীগণের একাধিক তথ্য কেন্দ্র আরবীয়গণের সাথে বাংলাদেশীসহ ইন্ডিয়ান পেয়েছিলাম। ইন্ডিয়ান মুসলমানেরা হিন্দির পাশাপাশি উর্দু ইংরেজিতে পারদর্শী।
উল্লেখ্য আমার মোবাইলে মুসলিম প্রো এ্যাপস রয়েছে। বিশ্বের ৮/৯ টি স্থান থেকে বিভিন্ন গণনা পদ্ধতিতে নামাজের টাইম টেবল দেওয়া হয়। এতে আসরের নামাজের দুই ভাগ দেয়া আছে। একটি হানাফী মাজহাব, আরেকটা সালাফীসহ অন্য তিন মাজহাব। সৌভাগ্যক্রমে মুসলিম প্রো এ্যাপসে পবিত্র মক্কায় উম্মুল আল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় এর পদ্ধতিও ছিল। তাদের পদ্ধতিতে আহলে হাদীসের সাথে সাথে হানাফী মাজহাবেরটাও দেয়া আছে। মসজিদুল হারমে গ্রাউন্ড ফ্লোরে হজ্বযাত্রীগণের কল্যাণে পুস্তক বিতরণসহ প্রশ্নের উত্তর ও নানান ধর্মীয় সহায়তার কল্যাণে কয়েকটি তথ্য কেন্দ্র রয়েছে। একদিন মসজিদুল হারমে আছরের জামাতের পর পর এ রকম বড় তথ্য কেন্দ্রে যাই। তখন সালাফী ও অন্য মাজহাব মতে আছরের সময় হলেও, হানাফী মাজহাব মতে আছরের সময় হতে আরও ঘণ্টাখানেক বাকি। তথ্য কেন্দ্রে গিয়ে তাদেরকে আমার মোবাইলে নামাজের টাইম টেবল দেখালে তারা হতবাক হয়ে যায়। যেহেতু উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া হানাফী মাজহাবের আছরের টাইমে তখন সময় হয়নি। অবশ্য এক অফিসে হতবাক না হয়ে হানাফী মাজহাব বিশেষ করে ইমাম আবু হানিফার সমালোচনা করে।
জেনে আসছিলাম বাংলাদেশের রাজশাহীতে আহলে হাদীসের বড় জংশন। এখানে ছাত্র-ছাত্রীর পৃথক পৃথক বড় মাদ্‌রাসা এবং বড় বড় মাহফিল হয়, তাদের প্রকাশনাও ব্যাপক। লেখালেখির জগতে আছি, মাজহাব সুফিজম নিয়ে থাকলেও সব দিকের অনেক কিছু জানতে পারি। সে লক্ষে বিদেশী বাদেও দেশের বিভিন্ন মতাদর্শের অনেক পাক্ষিক-মাসিক ম্যাগাজিন আমার কাছে আসে, রাজশাহী থেকেও আসে। গত ১ মার্চ ২০২০ এডভোকেট মুহাম্মদ ইলিয়াস ও এডভোকেট আবুল কাশেমকে সাথে নিয়ে ঢাকা থেকে রাজশাহী যাওয়া হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মুহিব উল্লাহ ছিদ্দিকীর তত্ত্বাবধানে ৩ রাত বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে ছিলাম। তাকে আবদার করি এখানে আহলে হাদীসের বড় জংশন রয়েছে। ওখানকার প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করায়ে দিতে। এতে তিনি মোবাইলে যোগাযোগ করে পরদিন বিকালে আমাদের নিয়ে যান। ওখানকার প্রধান তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে দীর্ঘ সময় দেন, আতিথেয়তা ত আছেই। মাগরিবের জামাত ওখানে পড়া হয়। এখানে তিন ব্লকে বড় বড় শাখা দেখতে পাই। তৎমধ্যে এক ব্লকে শুধু ৭ শত ছাত্রী, অধিকাংশ আবাসিক। গত ফেব্রুয়ারিতে বড় ধরনের ৩ দিনব্যাপী মাহফিল হয়ে গেল। জায়গা অনুপাতে নারী পুরুষ সংকুলান হয় না। পুরুষেরা রাস্তার অন্যত্র বসতে পারলেও মহিলাদের বাউন্ডারীওয়ালের ভিতরে যতটুকু সংকুলান ততটুকু, এর অতিরিক্ত মহিলাদেরকে জায়গা দেওয়া সম্ভব হয় না, অনেককে ফিরে যেতে হয়। তাদের বহুবিধ প্রকাশনা। সে অনুুপাতে দক্ষ লোকবল আছে বুঝতে পারলাম। আমাদেরকেও নানান প্রকাশনা উপহার দেন।
দীর্ঘ আলাপে রাজশাহীর আহলে হাদীস প্রধানকে বার বার বুঝাতে চেষ্টা করি মত পার্থক্য থাকবে কিন্তু আমাদের কাজকর্ম যাতে উগ্রতার দিকে না যায়। ধর্ম নিয়ে যাতে বেশি বাড়াবাড়ি না হয়। আমরা প্রচার চালাই, মানুষ বেছে নিক কোনটা সঠিক। অর্থাৎ এসব নিয়ে যাতে বাড়াবাড়ি না করি, কোন ফাসাদ সৃষ্টি না হয়। জানি না আমার পরামর্শ তার কাছে গ্রহণযোগ্য হল কি না।
আমরা যারা মাজহাবে সুফিজমে বিশ্বাসী, আমাদের ভাবতে হবে দেশে দ্রুততার সাথে আহলে হাদীসের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তারা আমাদেরকে সেকেলে পরবর্তী আবির্ভাব বলে ভুল বুঝতেছে। বর্তমান ১৪৪২ হিজরি। ১৪০০ হিজরির আগে তথা আজ থেকে ৪২ বছর আগে আমরা অনেক অনেক ভাল ছিলাম। ধর্মে, তরিক্বতে , নৈতিকতা, আদর্শে, চরিত্রে, তাকওয়া পরহেজগারীতে আমরা আগের মত আছি মনে করি না। ঐ দিকে ১৪০০ হিজরির পর গত ৪২ বছরের মধ্যে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রের মধ্যে আহলে হাদীস তথা সালাফী প্রচারে ব্যাপকতা রয়েছে। যা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশে প্রভাব ফেলতেছে। বৃদ্ধ বয়স জীবনের শেষ প্রান্তে। জানি না আমাদের অবর্তমানে মাজহাব ও সুফিজম কোন অবস্থায় এসে দাঁড়ায়!
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধখেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত মহান মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননার শামিল