প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র মক্কা বিজয় ও নবী পাক (স.)’র সতর্কতা

হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে ইসলাম বিজয়ের পথে এগিয়ে যায়। নবী পাক (স.)’র প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করার সুযোগ আসায় আরব উপদ্বীপ তথা জজিরাতুল আরবে জনগণের মাঝে ইসলাম গ্রহণে সাড়া জাগে। মহান আল্লাহ পাক বলেন,“ নিশ্চয় আমি আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়।” সূরা ফাতাহ,আয়াত-১।
এমন পরিস্থিতিতে নবী পাক (স.) মক্কা মোকাররমা বিজয়ের জন্য সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তা অতি গোপনে, তথাকার কাফেরেরা যাতে রক্তপাত ঘটাতে না পারে। যদিও তাদের সে অবস্থা নাই। হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ, আমর বিন আস সহ বাঘা বাঘা কুরাইশরা ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেছেন। তখন তাদের সর্ব সম্মত নেতা আবু সুফিয়ানের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছ বলা যাবে। হয়ত প্রতিরোধ করতে পারবে, কিন্তু সাফল্যের সামর্থ্য তাদের ছিল না।
তারপরেও রহমতুললিল আলামীন দু’জাহানের সর্দার নবী পাক (স.)’র মন থেকে তাড়িত হবে স্বাভাবিক; যাতে মক্কা মোকাররমায় কোন রক্তপাত না হয়।
নবী পাক (স.) পবিত্র মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলেন। তাঁর এই অভিযানের প্রস্তুতি অত্যন্ত গোপনে হচ্ছিল। মক্কা মোকাররমার ইসলাম বিরোধিতা যেন জানতে না পারে,এ কারণেই গোপনীয়তার প্রয়োজন ছিল। আল্লাহর নবী তাঁর পরিকল্পনার কথা কাউকে জানালেন না। যুদ্ধ বা রক্তপাত ছিল তাঁর পবিত্র স্বভাবের বাইরে। তিনি তাঁর পবিত্র অন্তর থেকে কামনা করতেন,মক্কা মোকাররমার বিজয় যেন কোন ধরনের রক্তপাত ব্যতীতই হয়ে যায়। তিনি জানতেন, মক্কা মোকাররমাবাসী তাঁর সাথে শত্রুতা করলেও তারা তাঁর পরম আপনজন। তারা বুঝে না,সত্য চিনে না,না বুঝে তাঁর সাথে শত্রুতা করে। সুতরাং কোন ধরনের যুদ্ধ ব্যতীতই তিনি মক্কা মোকাররমা জয়ের আশা পোষণ করছিলেন। গোপন পরিকল্পনার ভিত্তিতে তিনি অগ্রসর হতে থাকলেন। মিত্র গোত্রদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছিল,কিন্তু কেন কি উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হতে বলা হল,তারা তা জানতে পারলেন না। এমনকি হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (র.)’ও জানতেন না, আল্লাহর নবী কোন দিকে যাবেন।
এমন পরিস্থিতিতে পবিত্র মদিনায় অবস্থানরত এক বদরী সাহাবা অতি গোপনীয়তার মধ্যেও নবী পাক (স.)’র পবিত্র মক্কা বিজয়ের পরিকল্পনা অনুধাবন করতে পারেন। এতে পবিত্র মদিনা থেকে পবিত্র মক্কা এক মহিলা যাত্রীর মাধ্যমে গোপনে তাঁর পরিবারবর্গের নিরাপত্তা চিন্তা করে একটি চিঠি দেন। ইহা নবী পাক (স.) ওহীর মাধ্যমে জানতে পারেন। সাথে সাথে নবী পাক (স.) হযরত আলী (ক.) কে নির্দেশ দেন দ্রুত গিয়ে পথে মহিলা কে আটক করে চিঠি উদ্ধার করতে সাথে কয়েকজন সাথী। সেই মতে চিঠি উদ্ধার হয়। হযরত ওমর (র.) ঐ সাহাবার কঠোর শাস্তি দাবি করেন। মহান বদরী সাহাবা সরল মনে পরিবারবর্গের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে চিঠি দিয়েছিলেন বলে ক্ষমা করে দেন।
রহমতুললিল আলামীন নবী পাক (স.) পবিত্র মক্কা বিজয়ে রক্তপাত এড়াতে কতই না সাবধানতা অবলম্বন করেন। শত্রুপক্ষের গুপ্তচরদের দৃষ্টি এড়িয়ে তিনি বিশাল এক বাহিনী প্রস্তুত করলেন। সমস্ত বাহিনী একত্রিত করে মদিনা মুনাওয়ারা থেকে সবাই একত্রে যাত্রা করবেন। পথে আল্লাহর নবীর সাথে নিজের গোত্রের পতাকা আর বাহিনী নিয়ে মিলিত হয়, তিনি এমন ব্যবস্থা করলেন। কোন অভিযানের ব্যাপারে সাধারণত তিনি এত গোপনীয়তা অবলম্বন করতেন না।
মদিনা মুনাওয়ারা থেকে কেউ বের হয়ে মক্কা মোকাররমার দিকে যাবে, এমন পথসমূহে তিনি পাহারা বসালেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে কুলসুমকে দায়িত্ব দিলেন, আল্লাহর নবী মদিনা মুনাওয়ারায় অনুুপস্থিত থাকা অবস্থায় তিনি যেন মদিনা মুনাওয়ারা শাসকের দায়িত্ব পালন করেন।
নবী পাক (স.) অষ্টম হিজরি সনের রমজান মাসের দশ তারিখে মদিনা মুনাওয়ারা থেকে মক্কা মোকাররমা অভিমুখে বের হলেন। তিনি এমন বর্ণাঢ্য অবস্থায় কোন অভিযানেই বের হননি। এই অভিযানে তিনি এমন সুসজ্জিত অবস্থায় বের হলেন, যেন ইসলামের শত্রুদের কলিজায় কাঁপন ধরে। দশ হাজার সুসজ্জিত বাহিনী আল্লাহর রাসূলের সাথে। তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁর মাতৃভূমির দিকে। যেখান থেকে একদিন তিনি অশ্রু বির্সজন দিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন। পবিত্র কা’বাঘরের দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন,‘হে কা’বা! তোমার নিষ্ঠুর সন্তানরা আমাকে থাকতে দিল না।’
আল্লাহর নবী বিশাল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। এবার আর জনমানবহীন প্রান্তর দিয়ে নয়, জনপদ দিয়েই তিনি তাওহিদের বিজয় কেতন উড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিটি জনপদ থেকে পতাকাসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আল্লাহর রাসূলের সাথে যোগ দিচ্ছেন। বিশাল এক জনসমুদ্রে তরঙ্গের ওপরে তরঙ্গ দৃষ্টি করে পবিত্র মক্কার দিকে প্রবল বেগে এগিয়ে চলছে। বিভিন্ন গোত্রের দু’একজন তখন পর্যন্ত ইসলামের সাথে শত্রুতা পোষণ করত, তারা চক্ষু বিস্ফোরিত করে তাওহিদের এই তরঙ্গ দেখছে।
আল্লাহর নবী রাতের অন্ধকারে মক্কা মোকাররমা থেকে অনতিদূরে মাররুজ জাহরান নামক এলাকায় এসে উপস্থিত হলেন। সেখানেই তিনি যাত্রাবিরতি করে সৈন্যবাহিনীকে শিবির স্থাপন করতে আদেশ দিলেন। হাজার হাজার তাঁবু স্থাপন করা হল। তিনি আদেশ দিলেন, প্রতিটি তাঁবুতেই যেন পৃথকভাবে রান্নার আয়োজন করা হয়। এ কারণে প্রতিটি তাঁবুতেই পৃথকভাবে চুলা জ্বালানোর প্রয়োজন হল। ক্ষণিকের ভেতরেই হাজার হাজার চুলা জ্বলে উঠল। রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে বিশাল প্রান্তর আলোকিত হয়ে উঠল। সে আলোয় মক্কা মোকাররমা নগরী যেন উদ্ভাসিত হয়ে গেল। ভয়ে ইসলাম বিরোধীদের কলিজা যেন কন্ঠনালী দিয়ে বের হয়ে আসার উপক্রম হল। নবী পাক (স.) রাতের অন্ধকারে অধিক সংখ্যক চুলা জ্বালানোর যে আদেশ দিলেন,এর পেছনে ছিল সামরিক কৌশল। ইসলামের শত্রুগণ যেন ধারণা করে,লক্ষ লক্ষ বাহিনী মক্কার মোকাররমার দিকে এগিয়ে আসছে। ঘটেছিলও তাই, কুরাইশরা দেখল যেন লক্ষ চুলা জ্বলছে। চুলার সংখ্যা যখন নিরুপণ করা যাচ্ছে না, তাহলে সৈন্যের সংখ্যা নিশ্চয়ই লাখ কয়েক হবে।
চরম আতঙ্কে তাদের নিশ্বাস যেন বন্ধ হবার উপক্রম হল। তারা নবী পাক (স.)’র বাহিনীর সঠিক সংখ্যা জানার জন্য হযরত খাদিজা (র.)’র ভাইয়ের সন্তান হাকিম ইবনে হিজাম,বুদাইল ইবনে ওয়াকা ও তাদের নেতা স্বয়ং আবু সুফিয়ানকে প্রেরণ করল। তারা ছদ্মবেশে মুসলিম বাহিনীর দিকে এগিয়ে এল প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য। ওদিকে আল্লাহর নবীর চাচা হযরত আব্বাস (র.) ইসলাম গ্রহণ করলেও তিনি মক্কা মোকাররমাতেই অবস্থান করতেন। তিনি যেদিন পরিবার পরিজন নিয়ে মদিনা মুনাওয়ারার দিকে হিজরত করলেন, সে দিন নবী পাক (স.) মদিনা মুনাওয়ারা থেকে মক্কা মোকাররমা অভিযানে বের হলেন। পথে চাচা ভাতিজার সাক্ষাৎ হল। তিনিও মক্কা মোকাররমা অভিযানে শামিল হলেন।
হযরত আব্বাস (র.) ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,সে যেন মক্কা মোকাররমায় গিয়ে কুরাইশদের কাছে বলে,যথা সময়ে এসে আল্লাহর নবীর কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজেদের নিরাপত্তা কামনা করে। হযরত আব্বাস নবী পাকের খচ্চরে চড়ে অনুসন্ধান করছিলেন। এমন সময় তাঁর সাথে আবু সুফিয়ানের দেখা হয়ে গেল। হযরত আব্বাস তাকে বললেন,“দেখতে পাচ্ছ ত,আল্লাহর রাসূল বিশাল এক বাহিনী নিয়ে এসেছেন। মক্কা মোকাররমার কুরাইশরা এবার ধূলার সাথে মিশে যাবে।”
আবু সুফিয়ান ব্যগ্র কণ্ঠে হযরত আব্বাসকে বললেন,“আমার মা-বাপ তোমার জন্য কোরবান হউক। এই অবস্থায় আমাকে কি করতে হবে বলে দাও।”
তিনি বললেন, “তোমাকে দেখতে পেলে নিশ্চয়ই মুসলিম বাহিনী মাথা কেটে নেবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তুমি আমার এই খচ্চরের পেছনে উঠে বস। আল্লাহর রাসূলের কাছে চল, আমি তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।” পবিত্র মক্কার কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান,যার দাপটে রণভূমি কেঁপে উঠে, সেই নেতা আজ নিজের প্রাণের মায়ায় কোন কথা না বলে আল্লাহর রাসূলের চাচার পেছনে উঠে বসল। হযরত আব্বাস খচ্চর ছুটিয়ে আল্লাহর নবীর দিকে যেতে থাকলেন। হযরত ওমর আগুনের যে চুলা জ্বালিয়েছেন,তার পাশ দিয়ে হযরত আব্বাস যাচ্ছিলেন। হযরত ওমর তাকে দেখে ফেললেন। তিনি বলে উঠলেন, ‘আল্লাহর শোকর যে, তিনি তাঁর দুশমনকে আমাদের ভিতরে এনে দিয়েছেন।’
কিন্তু তাকে হত্যা করতে হলে আল্লাহর রাসূলের অনুমতি প্রয়োজন,এ কারণে হযরত ওমর (র.) দ্রুত নবী পাক (স.)’র দিকে ছুটলেন। হযরত আব্বাস খচ্চর ছুটিয়ে আল্লাহর নবীর কাছে উপস্থিত হয়ে আবু সুফিয়ানের প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করলেন। হযরত ওমরও তাকে হত্যা করার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। নবী পাক (স.) কোন পক্ষেই সাড়া দিলেন না। হযরত আব্বাস হযরত ওমরকে বললেন,‘হে ওমর! এই লোক যদি তোমার কবিলার হত তাহলে কি তুমি এতই কঠোর হতে পারতে?
হযরত ওমর (র.) বললেন, ‘আপনি এমন করে বলবেন না। আপনি যেদিন ইসলাম কবুল করেছিলেন,সেদিন আমি যা আনন্দিত হয়েছিলাম আমার পিতা খাত্তাব ইসলাম কবুল করলেও এতটা আনন্দিত হতাম না।’
এই সেই আবু সুফিয়ান,যার নেতৃত্বে নবী পাক (স.)’র প্রিয় চাচা হযরত হামজা (র.)কে হত্যা করে তাঁর বুক চিরে কলিজা বের করে চিবিয়েছিল আবু সুফিয়ানেরই স্ত্রী হিন্দা। স্বয়ং আবু সুফিয়ান হযরত হামজার পবিত্র দেহে বর্শার আঘাত করে নানা কটু কথা বলেছিল। তার অতীত কর্মতৎপরতা সমস্ত মুসলমানের সামনে ছিল স্পষ্ট। অজস্র অপরাধে সে অপরাধী। তাঁর প্রতিটি অপরাধই ছিল মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য। কিন্তু যার সামনে সে দাঁড়িয়েছিল নত মস্তকে, তিনি ছিলেন রাহমাতুললিল আলামীন। করুণার মূর্ত প্রতীক হিসেবে যিনি পৃথিবীতে আগমন করেছেন। আল্লাহর নবী আবু সুফিয়ানের কানের কাছে মুখ নিয়ে অভয় দান করলেন, ‘কোন ভয় নেই,এটা ভয়ের জায়গা নয়।’
ঐতিহাসিক আত তাবারী বলেন, আবু সুফিয়ানের সাথে আল্লাহর নবীর কিছু কথা হয়েছিল। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হে আবু সুফিয়ান! এখনও কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, যে আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই? আবু সুফিয়ান বলেছিল, ‘ আজ যদি অন্য কোন ইলাহ থাকত, তাহলে ত আমাদের কাজেই আসত।’ (আগামীবারে সমাপ্ত)

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধঅবশেষে ইচ্ছেটা পূরণ হলো