প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ

ওস্তাদের ফয়েজে মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী মাইজভান্ডার গেলেন

মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী। হুগলি মোহসেনিয়া মাদ্‌রাসায় ওস্তাদ হযরত মাওলানা সুফি গোলাম সালমানী (রহ.)’র ফয়েজে তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। মন মানসিকতায় এসে যায় আমুল পরিবর্তন। সুফি অলি দরবেশগণের প্রতি এসে যায় শ্রদ্ধা।
ফলে ১৮৯৫ সালে মাইজভান্ডার গমন করেছিলেন হযরত মাওলানা আহমদুল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ)’র নিকট দোয়া প্রার্থী হয়ে।
মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী জন্ম ১৮৭৫ সালে ও ইন্তেকাল ১৯৫০ সালে। তিনি ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত ৪ বছর সময় নিয়ে আত্মজীবনী লিখে যান। এতে খোলা মনে সবকিছু লিখে যেতে সংকোচ করেননি।
তিনি ছিলেন সচ্ছল পরিবারের সন্তান। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য কলকাতার উদ্দেশ্যে জাহাজে উঠিয়ে দিতে তার বাবা সাথে আসেন। এমন সময় জাহাজে একজন ওস্তাদের দেখা হয়। এতে পিতা খুশি মনে সন্তানকে ওস্তাদের নিকট হস্তান্তর করেন। ওস্তাদ ছিলেন হুগলিতে প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশ খ্যাত মোহসেনিয়া মাদ্‌রাসার শিক্ষক। এতে মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী কলকাতা আলিয়া মাদ্‌রাসার স্থলে হুগলি মোহসেনিয়ার ছাত্র হয়ে হোস্টেলে থাকতেন।
মাওলানা ইসলামাবাদী আত্মজীবনীতে আরও লিখেন, তিনি এই মাদ্‌রাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। মাদ্‌রাসার ছাত্র হলেও তিনি মোল্লা, পীর, ফকির তথা সুফিজমের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করতেন। নিজেকে নিজে অতি যোগ্য ছাত্র মনে করতেন। অন্যান্য সহপাঠীরা জ্ঞানের তুলনায় তার চেয়ে পিছিয়ে মনে করতেন। কয়েক বছরের ব্যবধানে উপরের শ্রেণীতে গেলে এ মাদ্‌রাসায় হেড মাওলানা হযরত মাওলানা সুফি গোলাম সালমানী (রহ.)’র ছাত্র হওয়ার পরম সৌভাগ্য লাভ করেন ইসলামাবাদী।
এ ওস্তাদ ছিলেন তরিকত জগতের মহান শেখ তথা পীর। ছিলেন হযরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)’র খলিফা। ফুরফুরা নিবাসী হযরত মাওলানা সুফি গোলাম সালমানী (রহ.)’র আপন মামাত ভাই হলেন হযরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসীর অপর খলিফা বিশ্বখ্যাত মহান শেখ হযরত মাওলানা আবু বকর ছিদ্দিকী (রহ.)। উভয় ভ্রাতা ফুরফুরাতে মাত্র ১ কি.মি ব্যবধানে শায়িত।
মোহসেনিয়া মাদ্‌রাসায় হযরত মাওলানা সুফি গোলাম সালমানী পাঠদান কালে স্বভাববশত ইসলামাবাদী পাঠদান না বুঝার ভান করে ওস্তাদকে বিরক্ত করতে থাকেন। হযরত মাওলানা সুফি গোলাম সালমানী যে একজন তরিকতের মহান শেখ, দরবেশ এ ধারণা মাওলানা ইসলামাবাদীর ছিল না। ওস্তাদের প্রতি তার আচরণ যে, অশুভ, বেয়াদবী পর্যায়ে তা তিনি পরে উপলদ্ধি করতে পারেন; অনুতপ্ত হন। ইসলামাবাদী আত্মজীবনীতে এর বিস্তারিত বর্ণনা দেন। এ দিন হতে উঠতি বয়সে তার মন মানসিকতা, চিন্তা চেতনায় এসে যায় পরিবর্তন। মহান ইমাম, অলি, দরবেশ, সুফিগণের প্রতি এসে যায় ভক্তি, শ্রদ্ধা।
হুগলি থেকে চট্টগ্রাম আসলে তিনি ১৮৯৫ সালে ২০ বছর বয়সে চট্টগ্রাম থেকে মাইজভান্ডার গমন করেন হযরত মাওলানা আহমদুল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.)’র দোয়া পেতে। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শরাবত উল্লাহকে সাথে নেন। তারা উভয়ে মাইজভান্ডারের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করেন। তখন দেশের নৌপথে হস্তচালিত নৌকা সাম্পান, স্থলপথে পায়ে হাঁটা। তখন ১৬ মাইল তথা শারীরিক সক্ষমতা ভেদে ২৪/২৫ কি.মি গমনের পর কোথাও রাত্রি যাপন করতে হত।
প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রাম থেকে নাজিরহাট ও দোহাজারী রেল লাইন চালু করে ১৯৩০ সালে। তারও আগে ১৯১৪ সালে মাওলানা এয়ার মুহাম্মদ হজ্বে গমন করেন। তিনি কাঠির হাট থেকে গরুর গাড়ি করে চট্টগ্রাম রওনা হন।
মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী হাটহাজারীর উত্তরে গিয়ে নাজিরহাটের নিকটে পৌঁছলে কারও না কারও বাড়ীতে রাত্রিযাপন করতে হচ্ছিল। রাস্তার নিকটের বাড়ী ঘরের মানুষ বিরক্ত এ রকম মুসাফিরের আশ্রয় দিতে দিতে। একাধিক ঘরে আশ্রয় না পেয়ে বড় রাস্তা থেকে ভিতরে গিয়ে এক সচ্ছল পরিবারের খালি কাচারি ঘরে ঢুকে পড়ে, উভয়ে এশারের নামাজ শুরু করে দেয়। দু’জনের জামাআতে বন্ধুর কেরাত ছিল সুমধুর। এতে আন্দর বাড়ীতে বাড়ীওয়ালার মন মানসিকতায় পরিবর্তন এসে যায়। তাদের জন্য রাতের খাবার সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করেন।
পরদিন বেলা ১০/১১ টার দিকে তারা উভয়ে মাইজভান্ডার পৌঁছতে সক্ষম হয়। তখন হযরত মাওলানা আহমদুল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.) আন্দর বাড়ীতে ছিলেন। অনেক লোক হযরত মাইজভান্ডারের মোলাকাত পেতে প্রতীক্ষায়রত। কিছুক্ষণের ব্যবধানে হযরত মাওলানা মাইজভান্ডারী আন্দর বাড়ী থেকে এসে বসলেন। এক এক জন থেকে নাম, বাড়ী কোথায় এসব কিছু জানতে চাচ্ছিলেন। এখানে অনেকে নানা প্রকার খাদ্য-দ্রব্য, ব্যবহার সামগ্রী হাদিয়া হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন। মাওলানা ইসলামাবাদী নিয়ে গেলেন ‘ওলা’ (সাদা চিনি মিশ্রিত দ্রব্য)। হযরত মাওলানা মাইজভান্ডারী (রহ.) একটি বাটিতে পানির মধ্যে ওলা ফেলে উপস্থিত সকলকে শরবত খাওয়ান। অতঃপর সামনে মাঠের দিকে হাঁটতে থাকেন। তাঁর নিকট সাক্ষাৎ তথা নানান হাজত প্রার্থী জানতে চাইতেন, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর কম দিতেন। মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী স্বভাববশত কয়েক বার করে জানতে চাইলেন জীবিকা নির্বাহের জন্য মুক্তারী (আইনপেশা) পরীক্ষা দেয়ার ইচ্ছা তার। এতে তিনি হযরত মাইজভান্ডারীর মতামত উপদেশ কামনা করেন। ইসলামাবাদীর বারে বারে আগ্রহের কারণে হযরত মাওলানা মাইজভান্ডারী কুরআন মাজীদের একটি আয়াত পড়লেন। এর অর্থ আল্লাহ পাকের উপর নির্ভর করা মানুষের কর্তব্য। আল্লাহ পাক যাকে ইচ্ছা করেন তাকে রিযিক দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা তার অবস্থার সচ্ছলতা দান করেন।
এতে মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী নিজে নিজে বুঝতে পারেন রিযিক তথা লোকের জীবিকা নির্বাহে সর্বময়কর্তা মহান আল্লাহ পাক। আল্লাহ পাকের উপর নির্ভর করে থাকা মানুষের কাজ।
বস্তুতঃ হযরত মাওলানা আহমদুল্লাহ মাইজভান্ডারী কলকাতা আলিয়া মাদ্‌রাসা থেকে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করা একজন মহান আলেম। সাথে সাথে একজন সুফি দরবেশ। তিনি ছিলেন শরীয়তের কঠোর পাবন্দ। হযরত মাওলানা আহমদুল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.) ১৮২৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৬ সালে ইন্তেকাল হলে মাইজভান্ডার দরবারে তিনি শায়িত হন। হযরত মাওলানা আহমদুল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.) এখানকার মধ্যমণি। তিনি এবং তাঁর পরবর্তী অলি দরবেশগণের উছিলায় অজপাড়া গ্রাম মাইজভান্ডার আজ দেশ পেরিয়ে বিশ্বে পরিচিত, আলোচিত নাম।
মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদীর ওস্তাদ হযরত মাওলানা সুফি গোলাম সালমানী (রহ.) পরবর্তীতে কলকাতা আলিয়া মাদ্‌রাসার হেড মাওলানা হন। তিনি তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ, আকাইদ, মানতিক, হেকমত, বালাগত বিশেষত আরবি ফার্সি ও ইসলামের ইতিহাসে বিশাল জ্ঞানের অধিকারী। তিনি ছিলেন সামশুল ওলামা তথা আলেম জগতের সূর্য। পবিত্র মক্কার আলেমেরা তাকে শায়খুল হিন্দ খেতাবে ভূষিত করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১২ সালে ইন্তেকাল করেন। হযরত মাওলানা সুফি গোলাম সালমানী (রহ.)’র অন্যতম খলিফা হলেন হযরত সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী। যিনি হুগলি জেলার বান্ডেলে শায়িত। তারই খলিফা হযরত সুুফি মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (আজমগড়ী হযরত) ভারতের উত্তর প্রদেশে শায়িত। চট্টগ্রাম অঞ্চলে গারাংগিয়া, চুনতী, হালিশহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শরীয়ত ভিত্তিক তরিকতে এ সিলসিলার ব্যাপকতা রয়েছে।
অপরদিকে মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী চট্টগ্রামের সন্তান হলেও ভারতবর্ষে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। চট্টগ্রাম তাকে নিয়ে গর্ব করে থাকে। উপরোক্ত তথ্যসমূহ তার আত্মজীবনী গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। ১৯৫০ সালের ২০ অক্টোবর মাওলানা ইসলামাবাদী ইন্তেকাল করলে চট্টগ্রাম কদম মোবারক মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে শায়িত করা হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানের বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম জেলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা পেল দিব্য দাশ