নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেল

লিটন কুমার চৌধুরী | বুধবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২৩ at ৯:৩৬ পূর্বাহ্ণ

তোমরা নিশ্চয়ই জানো মানব কল্যাণে বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্বে পাঁচটি বিষয়ের উপর নোবেল পুরস্কার প্রদান প্রচলিত আছে। বিষয়গুলো হলো পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তি। ১৯০১ সাল থেকে উল্লেখিত পাচঁটি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু হয়। তবে সুইডেনের “ষ্টেট ব্যাংক” প্রবর্তন করেন নোবেলের নামে “নোবেল পুরস্কার”। তারা দেন অর্থনীতির উপর অবদান রাখার ক্ষেত্রে।

আমরা যেই পুরস্কারের কথা বলছি এবং যার নামে এই পুরস্কার তিনিই হলেন ক্ষনজন্মা আবিস্কারক ও অনন্য দানবীর আলফ্রেড নোবেল । পুরো নাম আলফ্রেড বার্নার্ড নোবেল। কেউ কেউ তাকে নোবেল বা আলফ্রেড নামে ডাকতেন। নোবেল সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৮৩৩ সালে ২১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইমানুয়েল নোবেল ছিলেন একজন স্বপ্রতিষ্ঠিত প্রকৌশলী, উদ্ভাবক এবং উদ্যোক্তা। যিনি প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া খুব একটা করতে পারেননি। তার মা অন্ড্রিয়েট আলসেল ছিলেন গৃহিনী। তার বাবা চেয়েছিলেন তার তিন ছেলের মধ্যে সবাই প্রকৌশলীতে শিক্ষালাভ করে ফ্যাক্টরীতে জয়েন করুক। কিন্তু নোবেল ছিলেন তিনভাই থেকে ব্যাতিক্রম। “সাহিত্য ও বিজ্ঞান” গবেষণায় নোবেলের অনুরাগ ছিল বেশী । তাই তিনি বাধা দেননি। বরং জ্ঞানের দিগন্তকে প্রসারিত করার জন্য তিনি নোবেলকে দুইবছরের জন্য সুইডেন থেকে জার্মানী, ফ্রান্স ও আমেরিকায় পাঠান।

উল্লেখ্য যে ১৬ বছর বয়সে আলফ্রেড নোবেল একজন লেখক হবেন বলে ঠিক করেন। গৃহশিক্ষকের কাছে শেক্সপিয়ার পড়ে তিনি সাহিত্যের প্রেমে পড়ে যান, অন্যদিকে শেলীর কবিতায় মুগ্ধ হয়ে কবিতা লেখা শুরু করেন। এর মাঝে নোবেল তার বাবার ব্যবসার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। সেই সময়েই তিনি নিউইয়র্ক ও প্যারিস ঘোরার সুযোগ পেলেন। বেশিরভাগ সময়ই কাটাতেন রাসায়নিক গবেষণাগার আর ফ্যাক্টরিতে। ১৮৫২ সালে তিনি রাশিয়ায় ফিরে আসেন। স্বাস্থ্য সমস্যা এবং আর্থিক সংকটে রাশিয়া ফিরে নোবেল পুরোদমে ব্যবসায় মন দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তার স্বাস্থ্য ততদিনে বেশ খারাপ। ঘন ঘন রোগে ভুগে কিশোর নোবেল ব্যবসায় খারাপ করেন। আলফ্রেড নোবেলের বয়স যখন ২৫ তখন রাশিয়ান সরকারের ক্রিমিয়ার যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় সরকার অস্ত্রের অর্থমূল্য পরিশোধ করেননি। তখন তার বাবার ব্যবসা খুব খারাপের দিকে চলে যায়। তাছাড়া ইমানুয়েল তখনকার শক্তিশালী একপ্রকার বিস্ফোরক “নাইট্টোগ্লিসারিন” আবিষ্কারের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে ১৮৬৩ সালে রাশিয়ায় অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ছোট একটি শিল্প কারখানায় নিজের ল্যাবরেটরী স্থাপন করেন। এখানে তিনি হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের মাধ্যমে শরীর সুস্থ না থাকলেও দৈনিক ১৮ ঘন্টা কাজ করতেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি “নাইট্টোগ্লিসারিন ” এর বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হন।

১৮৬৪ সালে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ছোট ভাই এমিলি, আরও একজন সহকর্মী, ঝাড়ুদারসহ ৫ জন মারা যায়। যারা তার গবেষণার কাজে সাহায্য করতো। আলফ্রেড এতে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অধিক পরিমান নাইট্টোগ্লিসারিনের বিস্ফোরণ জন্য গবেষণা শুরু করেন এবং সফলও হন। ছোটভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকেই আলফ্রেড কিভাবে অধিক পরিমাণ বিস্ফোরক সহজে এবং অব্যর্থভাবে বিস্ফোরিত করা যায় সে বিষয়ে গবেষণা করছিলেন। অবশেষে তিনি আবিস্কার করলেন তার বিখ্যাত ব্লাস্টিং ক্যাপ ডেটোনেটোর। তার এই ক্যাপ আবিস্কারের পর প্রায় ৫০ বছর কোনোরকম পরিবর্তন ছাড়াই ব্যবহৃত হয় ।

১৮৬৩ সালে আলফ্রেড নাইট্টোগ্লিসারিনের সাথে কাঠ কয়লার মতো আরও কিছু গুড়ো মিশিয়ে একপ্রকার অধিক শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল বিস্ফোরক তৈরি করেন। ১৮৬৪ সালে তিনি তার এই নতুন বিস্ফোরকের সুইডিশ প্যাটেন্ট এর জন্য আবেদন করেন। তবে কিছু দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার জন্য তার এই আবেদন মঞ্জুর হচ্ছিল না। এরপর তিনি আবার গবেষণায় ফিরে যান। তিনি নাইট্টোগ্লিারিনকে একপ্রকার শোষক পদার্থ দিয়ে শোষণ করিয়ে নেন। পদার্থগুলো হচ্ছে কিসেলগার, করাতের কাঠের গুড়ো, সিলিকেট ইত্যাদি। এরপর এই বিস্ফোরককে কাগজে মুড়ে তৈরী করেন ডিনামাইট। তিনি গ্রীক শব্দ “ডিনামিস” থেকে ইংরেজি প্রতিশব্দ ডিনামাইট শব্দটি নেন, যার অর্থ শক্তি। এই ডিনামাইট শান্তিপূর্ণকাজে ব্যবহৃত হবে বলেই তিনি মনে করতেন। ১৮৭৩ সালে নোবেল প্যারিসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার বাসনা প্রকাশ করেন। দুবছর পর তিনি “গ্যালিগনাইট” নামক একপ্রকার বিস্ফোরক আবিস্কার করেন। এই গ্যালিগনাইট ছিল ডিনামাইটের চেয়ে অধিক শক্তিশালী, স্থিতিশীল, নিরাপদ ও পানির নিচেও বিস্ফোরণযোগ্য। ১৮৮৭ সালে নোবেল নাইট্টোসেলুলোজ এবং নাইট্টোগ্লিসারিনের মিশ্রনে তৈরী করেন বুলেট এবং কামানের শেলে ব্যবহারের জন্য প্রোপ্যালেন্ট,যার নাম “ব্যালিস্টিট”। ফরাসি মিলিটারী এই ব্যালিস্টিট এর প্রতি কোনো আগ্রহ না দেখালে তিনি ইতালির মিলিটারীর কাছে লাইসেন্স করিয়ে নেন । এতে ফরাসি সরকার তার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা, গবেষণাগারে অভিযান, এবং অনেক সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করে। এতে দুঃখ পেয়ে আলফ্রেড ফ্রান্স ত্যাগ করে ইতালিতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

আলফ্র্রেড নোবেল তার বিস্ফোরক তথা ডিনামাইট থেকে যতই উপার্জন করছিলেন ততই মর্মপীড়ায় ভুগতে শুরু করেন। তিনি বুঝতে পারেন তার মৃত্যুর পর মানুষ তাকে ঘৃণাভরে স্মরণ করবে। তাই সবকিছু ভেবে এবং ডিনামাইট আবিস্কারকে পাপ হিসেবে মনে করে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে, ভবিষ্যতের পৃথিবীকে সুন্দর করতে তিনি এক অভাবনীয় কাজ করে রেখে যান। তিনি তার বিশাল পরিমাণ বিত্তবৈভব সব মানবকল্যাণে কাজ করা ব্যক্তিদের পুরস্কার প্রদানের জন্য রেখে যান। তিনি নিজের ৯৪ ভাগ সম্পত্তি দিয়ে পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য, শান্তি এই ৫টি বিষয়ে বৈশ্বিকভাবে সেরা ব্যাক্তিদের পুরস্কার প্রদানের জন্য ফান্ড গঠন করেন। ১৯০১ সালে তার মৃত্যুর ৫ বছর পর প্রথমবারের মতো নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। যা এখনো অব্যাহত আছে।

জীবনের অন্তিম সময়ে নোবেল হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগেছেন। ১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর ৬৩ বছর বয়সে এই মহান বিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন। স্টকহোমের উত্তরাঞ্চলীয় সমাধিক্ষেত্রে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রজাপতি
পরবর্তী নিবন্ধউত্তর জেলা কৃষক লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা