দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৭ নভেম্বর, ২০২১ at ৭:১৭ পূর্বাহ্ণ

রইল বাকী এক
“কি ব্যাপার, এখানে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে এই হল দেখতে কতো সময় লাগবে, তা চিন্তা করে দেখেছ? না কি সারাদিন এর ভেতরেই থাকবে ঠিক করেছ?” কিছুটা পা টেনে টেনে পেছন থেকে এসে পাশে দাঁড়িয়ে লাজু জিজ্ঞেস করতেই, অকবি অদার্শনিক আমার মনের ভেতরের একটু আগের সৌন্দর্য বিষয়ক কাব্যিক নাকি দার্শনিক ভাবনা লেজ তুলে পালাল! থতমত খেয়ে তাইতো তাইতো বলে এগুতে লাগলাম করিডোর ধরে গ্রেটহলের গভীরতায়।
সামনে এগুতে এগুতে দেখছি ইতিমধ্যেই পুত্রদের গতিরুদ্ধ হয়ে গেছে। কারণ বিশাল ঐ ছবিটার একদম কাছে যাওয়ার কোন উপায় নেই, যেহেতু ছবিটার সামনের জায়গাটুকুকে ছবির কাছ থেকে পাঁচ ছয় ফুট আগেই ঘিরে রাখা হয়েছে কোমড় সমান উঁচু চকচকে পিতলের স্ট্যান্ডের মাথায় লাগানো লাল প্লাস্টিকের ফিতা দিয়ে। সেই ফিতা ঘেঁষে ছবির বা দিকটায় চিত্রার্পিতের মতো কালো লং কোট গায়ে দাঁড়িয়ে আছে এক চায়না সুন্দর। যদিও ওদের কারোর দেহভঙ্গিতেই ঐ লালফিতা ব্যারিকেড অতিক্রম করার কোন ইচ্ছা ফুটে উঠতে দেখছি না, তারপরও কেন জানি একটু গলা উঁচিয়ে এই সুবিশাল হল ঘরের শুনশান নিরবতা ভঙ্গ করে অনুচ্চ কণ্ঠে সাবধান করলাম যাতে ঐ কাজ তারা ঘুণাক্ষরেও না করে। জবাবে হাত নেড়ে দীপ্র আর হেলেন নিশ্চিত করল সে কাজ তারা করতে যাচ্ছে না। অতঃপর ওরা ব্যস্ত হয়ে পড়লো ফের যখন ছবি তোলাতুলিতে, একদৃষ্টিতে বিশাল ঐ ছবিটির দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করে স্ত্রীর পায়ের সাথে পা মিলিয়ে এগুতে এগুতে ভাবছি, আচ্ছা এই এত্তোবড় ছবিটা কি পেন্সিল স্কেচ নাকি? এ বিশাল রুমের করিডোরের মেঝে পাতা লাল কার্পেটের রঙয়ে লালাকার, নানান দরজার নকশায় আর মাথার উপরে ঝুলতে থাকা চমৎকার সব ঝাড়বাতি গুলোতে সোনালি রঙ্গয়ের ছড়াছড়ি থাকলেও ছবিটাতে সাদা আর কালো ভিন্ন অন্য কোন রং চোখে পড়ছে না। এ কারণেই কি শুধু সাদা কালো হওয়ার পরও ছবিটাকে ওরকম নজরকাড়া মনে হচ্ছে। যে দৃশ্য আঁকা ছবিটাতে তাতে মনে হয় ওইখানে দূরে নানান উচ্চতার পাথুরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু পাহাড় বা পর্বতশৃংগ, যে গুলো নাকি আবার আবছা করে ঢেকে রেখেছে হালকা কুয়াশা। বড় জীবন্ত মনে হচ্ছে ছবিটা। এরও নানান সব বিষয়ের মতো এ বিষয়েও জ্ঞান আমার লবডঙ্কা হওয়ায় ঠাহর করতে পারছি না, এটা কি পেন্সিল স্কেচ, নাকি জলরং নাকি তেল রঙয়ের ছবি।
ওদের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি যখন দুজনে, হেলেন তখন ব্যস্ত অভ্র দীপ্রকে ঐ চায়নাকন্যার দুপাশে দাঁড় করিয়ে, ব্যাক গ্রাউন্ডে সেই ছবিটা রেখে ছবি তোলায়। একবার ভাবলাম নিষেধ করি। কারো অনুমতি না নিয়ে ছবি তোলার ব্যাপারে চায়নিজদের মনোভাব কেমন, তা তো জানি না। ছবি তুলতে গিয়ে ফের কোন আবার ঝঞ্ঝাট হয় কী না, কে জানে? তার উপর এ মহিলা হলেন পুলিশ, মানে এই গ্রেটহলের নিরাপত্তারক্ষী । কি দরকার গায়ে পড়ে পুলিশ গোত্রের কারো সাথে কোন কিছুই করার। ঐ যে কথা আছে না আমাদের দেশে যে;, বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা, পুলিশে ছত্রিশ। চায়নায় এসে সে ঘা কতোতে দাঁড়িয়েছে, তা তো জানি না। সাথে সাথেই মনে হল, অনুমতি নিতে গেলে সেটাই বা কিভাবে বলবে ওরা;। তারচে বরং দেখি না কি হয়।
নাহ! হেলেনের ঐ ছবি তোলাতুলি নিয়ে কোন রা শব্দ তো করলোই না ঐ চায়নিজ মহিলা পুলিশ, এমনকি করলো না সামান্য নড়াচড়াও। মসৃণ হালকা হলদেটে রঙ্গয়ের তার মুখের দিকে একটানা গভীর দৃষ্টি ফেলে দেখতে পেলাম না সেখানে কোনরকম ভাবান্তরও। এমনকি নড়ছে না তার চোখের পাতাও। অবশ্য ঐ চমৎকার কমনীয় মুখশ্রীর মধ্যে চোখের উপস্থিতি ততোটা বাঙময় নয় যতোটা হয় আমাদের উপমাহদেশিয় রমণীদের ক্ষেত্রে। তবে তাতে তার সৌন্দর্যে কোন ঘাটতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না । ব্যাপার কি, গ্রেটহল কর্তৃপক্ষ কি তবে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় জেতা কোন চায়না কন্যাকেই ইচ্ছে করেই দাঁড় করিয়ে রেখেছে নাকি এই গ্রেটহলের ঢোকার মুখেই, যাতে দর্শনার্থীদের মানে পুরুষ দর্শনার্থীদের মন ভাল হয়ে যায়!
ঘাড়ের পেছন দিকটায় এ সময় একটা শিরশিরে অনুভূতি জানিয়ে দিল, ঠিক পেছনেই ঘাড়ের উপরে নিঃশ্বাস ফেলছে লাজু। ষষ্ঠইন্দ্রিয়কে তুমুল কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম মনে মনে, আমাকে এইভাবে ভয়াবহ বিপদ থেকে ঠিক সময়ে বাঁচিয়ে দেবার জন্য। কিছুটা পিছিয়ে থাকার জন্যই ওর চোখে পড়েনি আমার চোখের গতিবিধি বা ঐ রূপসী চায়না কন্যার রূপের ঝলকে চেহারায় যে ফুটে উঠেছে আমার মুগ্ধতার ভাব।
নিজেকে সামলে ঘটনা দ্রুত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার মানসে, লাজুর কাছ থেকে তার ফোনটা নিয়ে ওকে বললাম হেলেনসহ তারা চারজনও যেন ঐ চায়নাকন্যার আশে পাশে দাঁড়ায়, তবে কোনরকম লাইন ধরে না বরং ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কারো পাশে কিম্বা কোন কিছুর কাছে লাইন ধরে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে ওরকম ছবি যে আমি ভাল তুলতে পারি না, তা বহুল প্রমানিত সত্য। ওই রকম ছবিগুলো নিজেরও দেখতে ভাল লাগে না। ওগুলোর দিকে তাকালে গোটা ছবির আবহটাকেই কেমন যেন অপ্রাকৃতিক আর আরোপিত আরোপিত মনে হয়।
ছবি তোলা শেষে চায়নিজ পুলিশ সুন্দরীর পেছনের বা দিকের দরজা দিয়ে যে লাল কার্পেটে মোড়া করিডোরটা ভেতরের দিকে চলে গেছে কোথাও, তা ধরে সবাইকে নিয়ে এগুতে এগুতে মনে হল, আচ্ছা এ হলটা দেখতে আসলেই কতোটা সময় লাগবে? সময় হাতে থাকলেও কি যাওয়া যাবে সবগুলো রুমে? নাহ এ নিয়ে তো আগে থেকে কোন পরিকল্পনা ছিল না। এই কিছুক্ষন আগে হোটেল থেকে রওয়ানা দেওয়ার সময়ও তো ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি যে, তিয়েন আন মেন স্কয়ারে এসে, গাইড কাম শোফার লি খাঁর তাড়ায় এভাবে তড়িঘড়ি করে ঢুকে পড়তে হবে এই গ্রেটহলে! না আসলে তাও না, লি খাঁর তাড়া ছাড়াও গাড়ি থেকে নেমে তুমুল হিমে সবার নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ায় যখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিলাম, তখন বরং লি খাঁর ঐ তাড়াটিকে বড় আশীর্বাদই মনে হয়েছিল। সেটি যে আসলেই বিরাট আশির্বাদ ছিল, এরই মধ্যে গ্রেটহলের ওম ওম গরমে সকলকে একটু আগের জুবুথুবু অবস্থা দ্রুত কাটিয়ে দ্রুত চনমনে হয়ে উঠতে দেখে সেটাই তো প্রমাণিত হল।
অতএব পরিকল্পনা থাকুক তোলা শিকায়। দেখি এই করিডোর আর রাস্তা নিয়ে যায় কোথায় ? সব জায়গা যে ইচ্ছে আর সময় থাকলেও দেখা যাবে না, তা তো বুঝে গেছি এরই মধ্যে। ঐ যে সামনে ডান দিকে চমৎকার একটা সোনালি কারুকাজে কারুকার্জময় বিশালকার দু পাটি বন্ধ কপাট দেখা যাচ্ছে, তাতে তো বোঝা যাচ্ছে ঐ ঘরটি যা ই হউক না কেন ওর ভেতরে এ মুহূর্তে প্রবেশাধিকার নেই। কি আছে ওতে আসলে ? কারণ ঐ ঘরে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রেনর জন্য শুধু দরজা বন্ধ করেই ক্ষান্ত হয় নি এরা। সেই নিষেধাজ্ঞা এরও সুনিশ্চিত করার জন্য দরজার সামনে পাতা একটা চেয়ারে, ঘাড় মাথা সোজা করে নিজের টান টান পিঠ, চেয়ারের খাড়া পিঠের সাথে লাগিয়ে বসে আছে কালো স্যুট পড়া এক পুরুষ চায়নিজ নিরাপত্তা কর্মী। তার সেই বসে থাকা দেখে ভাবনা এলো, কপাল ভাল যে আজ গ্রেট হলে কোন সরকারী অনুষ্ঠান ছিল না। তাহলে যে এর ত্রিসীমানায়ও ঘেষতে পারতাম না, কুনমিং এর হোটেলের সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তো বলতে পারি। আচ্ছা এই হিমে তাহলে আমাদের কি অবস্থা হতো খোলা তিয়েন আন মনে চত্বরে দাঁড়িয়ে?
অবশ্য সেই দুরবস্থার কথা আর কল্পনা করে লাভ নেই। হয়তো তখন আমরা কেউ গাড়ি থেকেই নামতাম না। কিম্বা স্বয়ং লি খাঁই আমাদের নিয়ে আসতো না এই এলাকায়, নিরাপত্তাজনিত নিষেধাজ্ঞার কারণে। অতএব থাকুক সে চিন্তা তোলা আপাতত। ঢাকা থেকে বের হবার আগে, অনলাইনে একটু আধটু যে ঘাটাঘাটি করেছিলাম তাতে যা জেনেছিলাম, তার থেকে যতোটা মনে পড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে এখানে আছে প্রায় ছোট বড় মিটিং, কনফারেন্স আর অফিস রুমসহ শতাধিক রুম। চায়নার প্রতিটি প্রদেশের জন্য আর বড় বড় মিউনিসিপ্যালিটির জন্য তো বটেই আরো আছে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল যেমন মঙ্গোলিয়া, তিব্বতের জন্যও আছে আলাদা আলাদা মিটিং রুম।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅসামপ্রাদায়িক আন্দোলনের সারথি মঈন উদ্দীন খান বাদল
পরবর্তী নিবন্ধসিআরবি ও একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মদহন