দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২৫ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

চোখে চোখে চোখ পড়লে
কন্সিয়ার্জ কন্যার সাথে এ মুহূর্তে গভীর আলোচনায় মগ্ন দলনেতার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সেই নিজে আর তার পুরো দলটা চায়নিজ হওয়ার পরও, তারাও আমার মতই বেইজিং এ আগন্তুক ; যারা সম্ভবত নাকি এলো এই প্রথম এখানে। এছাড়া আমার মাথায় বেইজিং এর কোন কোন চুলায় ঢু মারব আগামী দুই দিন তার এক্কেবারে পোক্ত পরিকল্পনা না হলেও মোটামুটি ধারণা আছে, অথচ এই দলনেতা আর তার দলের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এ নিয়ে ছিটেফোঁটা ভাবনাও ছিল না তাদের কার মাথায় বা মনে। অবশ্য দলনেতারই যদি না থাকে পরিকল্পনা,তবে অন্য কারো তা থাকবে এমন মনে করাটাও ঠিক না। আবার এও ঠিক যে, যদি দলের মধ্যে তেমন কেউ থাকেও, যার মাথায় এ ব্যাপারে খুব পরিষ্কার, সেও এ অবস্থায় কিছুই যে বলবে না, তা তো জেনেছিলাম আগেই, সিঙ্গাপুরে করছিলাম যখন বছরখানেক প্রবাসী জীবন যাপন দাপ্তরিক প্রয়োজনে। হ্যাঁ এই উপমহাদেশের প্রচলিত সংষ্কৃতির মতোই চায়নিজরাও মুরুব্বি হউক আর বস হউক, তার সামনে পারতপক্ষে মুখ খুলতে চায় না বা খোলে না।
থাক সে প্রসঙ্গ। এই এখন দলনেতা প্রতিবারই কন্সিয়ার্জ কন্যার সাথে কথা বলার পর, যেভাবে দলের সাথে সবিস্তারে আলাপ করছে, তাতে মনে হচ্ছে বেশ কিছুটা সময় নেবে এরা। যার মানে হল, অপেক্ষা করতে হবে আমার। ভাবলাম তাই, যাই তাহলে বাইরে একটা চক্কর মেরে আসি ছেলেদের নিয়ে এই ফাঁকে। দুই হাত দুজনকে ধরে রাখায়, সহজেই টের পাচ্ছি ঐ গাড়িগুলো দেখার ব্যাপারে তাদের টগবগ উত্তেজনা। কিন্তু সাথে সাথেই মনে হল, আসলে জানিই না তো ঠিক কতোক্ষণ আগে থেকে এই দলনেতা তার দলকে নিয়ে কন্সিয়ার্জ কন্যার সহায়তায় করছে তাদের বেইজিং ভ্রমণ পরিকল্পনা। এখানে কতোক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে তা তো নির্ভর করবে, এখন দলনেতা কি তার ভ্রমণ পরিকল্পনা বিষয়ক আলোচনার একদম শুরুতে, নাকি মাঝামাঝি, নাকি আছেন এক্কেবারে শেষদিকে তার উপর। আর এমুহূর্তে যদি লাইন ছেড়ে চলে যাই তবে হয়তো দেখা যাবে যে, তার পরপরই এদের কাজ শেষ হয়ে গেছে, আর আমার অবর্তমানে লবিতে বসে থাকা অন্য যারা নাকি ভিড় দেখে আসছে না এখানে এমুহূর্তে, তারা এসে দাঁড়িয়ে গেল লাইনে; আর ফিরে আসার পর আমার জায়গা হল সেই লাইনের একদম শেষে। যেরকম হয়েছে নানান সময় নানান জায়গার লাইনে। অতএব দাঁড়িয়েছি যখন একবার, কাজ শেষ না করে নড়ছি না আর এবেলা। মনে মনে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে, দীপ্র অভ্রকে মুক্তি দিয়ে বললাম তারা যেন লবির কোন একটা সোফা দখল করে বসে।
এদিকে আমার হাতমুক্ত হতেই দু ভাই লবির দিকে না দৌড়ে, দিল ফের প্রতিযোগিতামূলক ভৌ দৌড় হোটেলের সেই ঘূর্ণায়মান বৃত্তাকার গেইটের দিকে। সাথে সাথেই সহনীয় মাত্রায় গলা উঁচু করে ডেকে নিবৃত করতে চাইলাম ওদের, কিন্তু ততক্ষণে দেখলাম দুজনেই ঢুকে পড়েছে সেই বৃত্তাকার গেইটের পেটের ভেতরে। রাগ আর বিরক্তি দুটোই চেপে বসলো ওদের এই কাণ্ডে। অতএব আবারো ভাবলাম , যাই লাইন ছেড়ে গিয়ে ধরে নিয়ে আসি ওদের।
নাহ তা আর করতে হল না, কারণ ওই চিন্তার সাথে সাথেই দেখা গেল দু ভাই হাসতে হাসতে বেরুলো ঐ গেইটের পেট থেকে। বেরিয়েই দীপ্র বলল, “আমরা কিন্তু বাইরে যাইনি বাবা। শুধু এই গেইটার ভেতরে ঢুকে ওটার সাথে একটু ঘুরে দেখলাম”-ওরা কথার জবাবে একটু মাথা ঝাঁকাতেই , দুজেনই পেছন ঘুরে শুরু করলো তাদের লবিভিযান। অতএব ওদের গতিবিধির উপর নজর রাখতে রাখতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম লবিটার আশপাশ যতোটা চোখে পড়ছে এখন। এসময়ই কন্সিয়ার্জ ডেস্কের পাশে পাশাপাশি দুটো ডেস্কে বসে থাকা দুই চায়নাকন্যাকে দেখতে পেলাম। এদের পোশাক আর ডেস্ক দেখে সহজেই বোঝা যায় এরা হোটেলের কেউ নয় বরং হলো কোন ট্রাভেল এজেন্সির লোক, যাদের কাজ হোটেলবাসিদের নানান ধরনের ট্যুরের ব্যবস্থা করে দেয়া। ওদের পোশাকের রং আর ডিজাইন বলছে যে দু জন তারা দুটি ভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধি।
চায়নিজদের বা জীববিদ্যার ভাষায় যাকে বলে মঙ্গোলিয়ান রেইস, তাদের চোখ যে রকম হয়, তাতে অনেকবারই ভেবেছি এরা কি চোখে চোখে কথা বলতে পারে বা বলে? আর কেউ না হউক অন্তত প্রেমিক প্রেমিকাদের তো চোখে চোখে কথা বলার দরকার পরে। তা কিভাবে করে এরা। বা এই রেইসের কোন তরুণতরুণীর প্রেমের সূত্রপাত হয় কি চোখাচোখির মাধ্যমে হয় যেমন আমাদের? চোখ বিষয়ক পুরানো সেই ভাবনাটি যখন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায় এসময়ই চোখাচোখি হয়ে গেল ট্রাভেল ডেস্কের সুবেশী দুই কন্যার একজনের সাথে। এসব ক্ষেত্রে চোখে চোখে চোখ পড়লে কথা তো বলতেই হয়, সেজন্যই মনে হল কন্যার চোখ বলে উঠল ‘হাই’!
সাথে সাথে ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠলো তার। একই সাথে মাথা নাড়িয়ে আহবান করলো সে যেতে তার টেবিলে। বেশ হকচকিয়ে গেলাম। মনে হল ধরা পড়ে গেলাম বুঝি, ছাদের রোদে প্রতিবেশি খালাম্মার শুকাতে দেওয়া আচার চুরি করে খেতে গিয়ে, তারই কিশোরী কন্যার কাছে! বড়ই অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। দ্রুত সেই অস্বস্তি কাটাতে, হাত তুলে তাকে হাই বলে, হাসি হাসি মুখ করে ইশারায় বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে কন্সিয়ার্জ কন্যা যদি আমাকে কোন সমাধান না দিতে পারে, তবে অবশ্যই নেব আমি কন্যা তোমারি শরণ।
‘গুড ইভিনিং মিস্টার। ওয়েলকাম তু লিজেন্ত বেইজিং। মাই নেম ইজ ইনা, মে আই হেল্প ইউ?’ একটু উঁচু আর তীক্ষ্ণ স্বরের এই কথা কানে ঢুকতেই এসময়, শব্দের উৎসের দিকে চোখ ঘুরে যেতেই দেখি, সামনে দাঁড়ানো সেই দলনেতা সরে গেছে ততোক্ষণে বা পাশে, তার দলের কাছে। যার কারণে কন্সিয়ার্জ কন্যা মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, এমনি এক সময়ে যখন আমি বলছিলাম চোখে চোখে আর শরীরী ভাষায় ভাবের আদান প্রদান করছিলাম ঐ ট্রাভেলডেস্ক কন্যার সাথে। আবারো ধরা পড়ে যাওয়ার দশার ঘোরে পড়লাম। বাস বা ট্রেন ভ্রমণে কোন কিশোর বা তরুণ অনতিদূরের সিটের অপরিচিত সহযাত্রী কিশোরীর সাথে চোখে চোখে কথা বলতে গিয়ে, পাশে বসে থাকা কিশোরীর মায়ের কটমট চোখের শেন্যদৃষ্টির পাল্লায় পড়লে তার যে দশা হয়, এই মাত্র আমারো হল সেই দশা!
অস্বস্তিকর সেই দশা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তড়িঘড়ি সামনে এগুতে এগুতে বললাম, হাই মিস রিনা।
“আই এম মিস ইনা । ই ই ই না না না। নত লিনা” বেশ উঁচু গলায় হাসি মুখে বললো ফের কন্সিয়ার্জ কন্যা।
হঠাৎ অই ধরা পড়ার কারণেই হয়তো ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার চেনা চায়নিজদের, ‘র’ কে ‘ল’ নাকি ‘ই’ উচ্চারণ করতে শুনেছিলাম আগে যার কারণেই ভুলটা হল। আর তাই কন্সিয়ার্জ কন্যা দ্বিতীয়বার একবার স্বাভাবিক টানে আরেকবার বিলম্বিত লয়ে নাম বলে বুঝিয়ে দিল, যে তার নাম ইনা। সাথে সে নিজে যে ‘র’ কে ‘ল’ উচ্চারণ করে তাও বোঝা গেল। দু পা সামনে এগিয়ে ছিপ ছিপে গড়নের লম্বাটে মুখের চটপটে আর হাসি খুশি কন্সিয়ার্জ কন্যাকে চোখজরীপ করতে করতে এক্কেবারে কাছে গিয়ে বললাম ওকে ওকে, সরি , আন্ডারস্ট্যান্ড ইউ আর ইনা।
‘ইয়েস ইউ আল লাইত’ বলতে বলতে তার ট্রেনিংগত কারণে হউক আর স্বভাবগত কারণেই হউক, ডেস্ক থেকে বেইজিং শহরের একটা বড় ম্যাপের ভাজ খুলে ওটাকে কাউন্টারের উপর ছড়িয়ে বিছাতে বিছাতে, বেশ পরিষ্কার ইংরেজিতে বললো যে, বেইজিং শহর বা তার আশে পাশের যে কোন জায়গা ভ্রমণ করার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য সে একপায়ে খাড়া। অতএব আমার আর অন্য কোন কিছু চিন্তা করার দরকার নাই মোটেও। সেই করে দেবে আমার সব মুশকিল আসান। আর কারো কাছে যদি যেতেই হয়, তা হলে সে নিজেই আমাকে বলে দেবে যেতে হবে কোথায়, কার কাছে। বলল সে একথা বেশ জোরের সাথেই।
বুঝলাম না, এ কথাটিতে এতো জর দেয়ার কারণ কি স্রেফ নারীদের স্বভাবজাত ঈর্ষা ? আমি যে তারই সামনে, অদূরে বসে থাকা ট্রাভেলডেস্ক কন্যার নারীর সাথে চোখাচোখি হয়ে যাবার পর, কথা বলছিলাম ইশারায়, সেজন্যই কি অম্ন জোরের সাথে বলল ও কথাটা। নাকি জোরের সাথে ওকথা বলে সে নিশ্চিত করলো যে, সেই এখানকার হর্তাকর্তা। এখানে যা কিছুই হবে, হতে হবে তারই ইচ্ছেমতো। দুটোই হতে পারে সত্য। কারণ অভিজ্ঞতায় জানি চায়নিজরা এরকমই হয়। মানে তাদের যে দায়িত্ব, সেটিতে অন্য কারো ফোপর দালালি মোটেও সহ্য করে না। অবশ্য চায়নিজ নারীরা অন্য নারীদের প্রতি বংগললনাদের মতোই ঈর্ষা পোষণ করে কি না সেটা এখনও নিশ্চিত নই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিকাহ রেজিস্ট্রি প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধআমার আদর্শ আমার মেন্টর