দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১০ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

একজোড়া গ্লোভস বনাম একপাটি পাম্প সু

গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া পায়ের নীচের কংক্রিটে পা ফেলিয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইবার অবকাশও পাইলাম না, হুড়মুড় করে ডানদিক থেকে উড়ে আসা যাকে বলে হাড়হিম করা বাতাসের ঝাপটায়, শরীরের কোথাও তিন, কোথাও বা চার, কোথাও বা পাঁচ স্তরের গরম কাপড়ে মোড়া শরীর তো শরীর, সাথে মগজে চলতে থাকা মিস ইনা বিষয়ক চিন্তাও এক্কেবারে জমে বরফ হয়ে গেল!
সাথে সাথেই লক্ষ লক্ষ নাকি মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে নিজের কোটি কোটি কোষের জীনে অমোচনীয়ভাবে খোদাই হয়ে থাকা, প্রাণির অন্যতম প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া সুতীব্র চিৎকারে সাইরেন বাজিয়ে তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে ঘোষণা করে দিল ‘চাচা আপন প্রান বাঁচা’! তাতে ফের গাড়িতে উঠে পড়ার তীব্র ইচ্ছা জাগল, যেটিকে নাকি ঠেকিয়ে দিলেন কী না আমাদের কিশোর কবি সুকান্ত। সেই কবে পড়েছিলাম মনে নাই, এই মুহূর্তে মগজে কে যেন দামামা বাজিয়ে বলে উঠল ‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মার ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
নাহ যেই চায়নাকে হারিয়েছি ১৯৭১, সেই চায়নায় বাঙালির পরাজয় হতে পারে না, তাও আবার আমার হাত ধরে । আসলে হয়েছে কি, মনে মনে যতই প্রস্তুতি থাকুক না কেন বেইজিং হিমের; গত সন্ধ্যার আর আজ সকালে হোটেলের সামনে থেকে গাড়িতে উঠার সময়ে অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে , মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না এ মুহূর্তে ঠাণ্ডার এহেন মারণ কামড়ের! এছাড়া শরীরে উপর্যুপরি জড়ানো গরম কাপড়ের সক্ষমতার উপর নিভর্রতাও তো ছিলই। কিন্তু একটু আগে গাড়ি থেকে নেমে বাইরে পা রেখে দাঁড়াতেই অবস্থা হয়েছে তেমন, হয়েছিল যেমন সেই দুর্বল দেহকাঠামোর প্রেমিক কিশোরের মতন; যে নাকি অনেকদিনের সাধনায় পটিয়ে পাটিয়ে তার কিশোরীকে লুকিয়ে চুরিয়ে প্রথম চুমুটি খাওয়ার মুহূর্তেই; যার গালে এসে পড়েছে কিশোরীর শরীরচর্চাবিদ ব্যায়ামবীর ভাইয়ের বিরাশী সিক্কার থাপ্পড়। কিছুকাল আগ পর্যন্ত তিয়েন আন মেন নিয়ে আমার যে রোমান্টিক ভাবনা ছিল , সে ভাবনা এভাবেই মার খেয়ে গেল প্রথমেই এখানে পা রাখতেই।
তবে সে থাপ্পড়ে চোখে মুখে প্রথমে সর্ষে ফুল দেখলেও, দ্রুতই তা সামলে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে উঠতেই, উচ্চতর প্রানির আরেক প্রতিক্রিয়া; সন্তান ও পরিবার বাৎসল্য মাথা চাড়া দিয়ে উঠল মনের ভেতরে। অতএব দ্রুত হাত নেড়ে জানালার ওপাশে গাড়ীর ভেতরে বসে থাকা সবাইকে বললাম, নেমো না কেউ এক্ষুণি। বলেই তাকালাম ফের ডান দিকে , যেদিক থেকে এসেছিল সেই বিরাশী সিক্কার থাপ্পড়টা। ঘন ধোঁয়াশায় ঢাকা একটা খাঁ খাঁ কংক্রিট প্রান্তর নজর পড়ল , যার ওপাশে বেশ দূরে আবছাভাবে একটা দালানকে দাঁড়িয়ে ঝিমুতে দেখলাম। এরই মধ্যে জমে যাওয়া দুই হাতের আঙ্‌গুল থেকে শুরু করে তালু পেরিয়ে কব্জি পর্যন্ত কেমন যেন একটা ব্যাথা অনুভব হতেই, বুঝলাম দস্তানা পড়তে ভুলে গিয়েছিলাম নামার আগে । দ্রুত জ্যাকেটের নানান পকেটে খোঁজাখুঁজি করে তাদের হদিশ পেতেই, গলিয়ে দিলাম হাত তাতে । কিন্তু তেমন কোন লাভ হল বলে, মনে হল না তাতে।
অতএব বেশ অনিশ্চিতভাবেই চি চি করে ডাকলাম লি খাঁ, লি খাঁ।
নাহ দেখলাম যে শব্দগুলো জমে বরফ হয়ে টুক করে পড়ে যায়নি নীচের কংক্রিটে এই ঠাণ্ডায়। ঠিকই কানে গেছে ওগুলো লি খাঁর। তড়িঘড়ি করে শে গাড়ীর ওপাশ থেকে এসে সামনে দাঁড়াতেই নিশ্চিন্ত হলাম। এ মুহূর্তে তার নিরাবেগ নিরুদ্বেগ চায়নিজ চেহারায় আবছাভাবে কিছুটা হতভম্বভাব দেখা গেল মনে হল। বিড়বিড় করে সে প্রথমে আওড়াল ‘গ্লেত হল।’ তারপর বলল “তিয়েন আ মে”
আরে বাবা বুঝেছি তো, অতি দ্রুতই নিয়ে এসেছ তুমি জায়গামতোই। এটুকু কথা বাংলায় বলে, অতপর হাত পা তুমুল নাড়বার সাথে জিজ্ঞেস করলাম -পার্কিং? হয়্যার? উত্তরে সে -“তিকিত” বলে তারে সেই “গ্লেত হলের” টিকিট কাউন্টারের দিকে দেখাল -হায়রে “আমি গাই কি , আর আমার সারিন্দায় বাজায় কি?” এ তো দেখছি মহামুশকিল। তাও এরকম বেমক্কায় ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে যদি তাকে সামান্য বিষয় বোঝাতে এতো দিগদারী হয় তাহলে চলবে কি করে? আমি আসলে তাকে জিজ্ঞেস করে বুঝতে চাইছিলাম যে, গাড়িটা সে কোথায় পার্কিং করবে? কারণ ধারে কাছেই যদি পার্কিং করতে পারে, তবে খুব ভাল হয়। তখন এই গাড়িটাকে, যাকে বলে পর্বতারোহীরা পর্বতারোহণের শুরুতেই যেমন তাদের উর্ধযাত্রা পথে কোন বেইজ ক্যাম্প থেকে রওয়ানা হবে তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখে, যাতে তাদের দুর্গম উর্ধযাত্রায় কোন সমস্যার মুখোমুখি হলে যেখানে তারা ফিরে আসতে পারেন বা যেখান থেকে পান তারা ব্যাকআপ সাপোর্ট, আমাদের আজকের এই হিমযাত্রা সমতল পথে হলেও, এখানেও আমি গাড়িটিকে বানাতে চাইছি সেই রকম বেইজ ক্যাম্প। যাতে দলের কেউ এই ঠাণ্ডায় বাইরে বেশীক্ষণ থাকতে অপারগ হলে, নিতে পারে আশ্রয় গাড়ীর ভেতরের উষ্ণতায় সহজে।
এসময় মনে হল এমনিতে স্বাভাবিক তাপমাত্রার পরিবেশে টেলিগ্রাফিক ঢঙ্গয়ে ইংরেজি বলে, লি খাঁর সাথে বাৎচিত চালানো গেলেও, কিন্তু এই ঠাণ্ডায় আমার দাঁত যখন ঠক ঠক করছে অবিরত আর জমে আছে ঠোঁট, তখন সেই টেলিগ্রাফিকভাবে বলা শব্দ গুলিই কি ঠিক ঠিক বেরুচ্ছে মুখ থেকে, যে কথা বললেই , লি খাঁ তা বুঝে যাবে সহজেই? এই তো জিজ্ঞেস করলাম তাকে পার্কিংয়ের খবর, জবাবে সে কী না দিল গ্রেট হলে ঢোকার টিকিটের খবর। অবশ্য এই খবরটি গুরুত্বপুর্ন , কারন আমি এমনটা মনে করিনি যে এখানে কোথাও আবার টিকিট কেটে ঢুকতে হবে।
তখনই মাথায় এলো, আরে লি খাঁর সেই দোভাষী মোবাইলটা বের করলেই আমাদের বাৎচিত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়! সাথে সাথেই লি খাঁ কে হাতের ইশারার সাথে মুখেও বললাম যে আরে চান্দু তোমার সেই করিতকর্মা মোবাইল দোভাষ থাকতে, এই ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে কোন সুখে করছি যাকে বলে মুখামুখি ধবস্তাধস্তি! নিয়ে আস তারে আমাদের দুজনের মাঝখানে, রচিত হউক বংগচায়না সেতু তবে এইক্ষণে।
কথা সে শেষ হতেই লি খাঁ ঘুরে হাঁটা দিতেই, ভাবলাম কি বুঝল বেটা কে জানে? বললাম তাকে নিয়ে আসেন লি চাচা আপনার দোভাষ মোবাইল, আর সে কি না দিল ঘুরে হাঁটা। এ তো দেখি আসলেই বোঝার উপর শাকের আটি না, এক্কেবারে কুনমিংয়ের সেই স্টোন ফরেস্ট থেকে আনা একটা আস্ত পাথরের চাই এনে বসিয়ে দিয়েছে মাথায় মিস ইনা! নাহ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে মিস ইনা নামের সেই চীনা কন্যার সাথে। ফিরে নেই আগে হোটেলে। ভাবতে ভাবতে নিজেরই অজান্তে লি খাঁর পথ অনুসরণ করে গাড়ীর ওপাশ মানে ড্রাইভিং সিটের দিকে হাঁটা ধরতেই, ইতোমধ্যেই দেখি হাসি মুখে লি খাঁ এগিয়ে ধরেছেন সেই মোবাইল দোভাষ।
হাঁফ ছেড়ে বেঁচে, সেটা হাতে নিতে নিতে হৃদয়ংগম করলাম যে, আসলে সে ওটা গাড়িতে ফেলে এসেছিল। আর আমি যে মোবাইল চেয়েছি তা সে বুঝেছে, যার কারণে ঘুরে হাঁটা দিয়েছিল গাড়ীর ওপাশটার দিকে মানে ড্রাইভিং সিটের দিকে।
এই চায়নিজ মোবাইল দোভাষ কে হাতে নিয়ে আরেকটা কারনে ভাল লাগল, তা হল গাড়ীর হিটারের সামনের শিকায় এতক্ষণ ঝুলতে থাকা, তার গা টা এখনো গরম। টের পেলাম তা অতি ভয়ে ভয়ে দস্তানার ভেতর থেকে হাত টেনে বের করে ওটার গায়ে হাত ছোঁয়াতেই। ঐ দস্তানা হাতে পড়ে এটিতে এখনকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাৎচিত সম্পর্কিত লেখালেখি করতে গিয়ে কোন ঝক্কিতে পড়তে চাই নি আর কি। আর দস্তানা পড়েও যে খুব একটা লাভ হয়নি তা বলেছিই আগে। ওটা হাতে পড়া থাকলেও সারাক্ষণই মনে হচ্ছিল এটা পড়লেই কি আর না পড়লেই কি? এই হিমে এ তো কোন কাজেই লাগছে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআর কত সাদিয়া এভাবেই চলে যাবে
পরবর্তী নিবন্ধবদিউল আলম চৌধুরী : এক প্রতিবাদী পুরুষের প্রতিকৃতি