দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ

বালকবেলার হৃদয়মোহিনী
একেই বলে মনের খেয়াল। কিসের লেজ ধরে চলে যাবে সে কখন যে কোথায়; তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই । কোথায় এ সন্ধ্যায় বেইজিং জ্যামে আটকা পড়ে ভড়কে গিয়ে ভাবছিলাম কতোটা সময় নষ্ট হয় তা নিয়ে, সে চিন্তা পিছু ফেলে নানান মনকথনের লেজ ধরে সে কিনা নিয়ে গেল আমায় রুমানিয়ায়, এক্কেবারে নাদিয়া কোমানিচির কাছে!
পত্রিকায় জিমন্যাস্টের সংক্ষিপ্ত পোশাক পড়া, নাদিয়া কোমানিচির সাদাকালো আবছা ছবি দেখে, আর জিমনাস্টিকে তার পারফেক্ট স্কোর মানে দশে দশ পাওয়ার বিস্ময়কর ঘটনা ঘটিয়ে ১৯৭৬ সনের মন্ট্রিল অলিম্পিকে একাধিক স্বর্ণ জয় করার গল্প পড়ে, ঐ বয়সে প্রেম কি তা না বুঝলেও মন যেন কেমন কেমন করছিল তার জন্য, সে সময় । শুধুই তা নয়, এ খবর পড়ার আগে জিমনাস্টিকসের ব্যাপারে “জ” মূর্খ আমি কি না হয়ে উঠেছিলাম ফুটবলের পাশাপাশি জিমনাস্টিঙেরও ভক্ত ! নিজের বাড়িতে টেলিভিশন নাই, তাই তক্কে তক্কে থাকতাম অন্যের বাড়িতে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে খেলাধূলা বিষয়ক অনুষ্ঠান বা খবরের খেলাধুলা অংশে যদি দেখা যায় নাদিয়া কে। হোক না তা সাদা কালো টিভি । অবশ্য তখন সম্ভবত জানতামই না যে টেলিভিশনও হতে পারে রঙিন।
তো তখন এইভাবে নানান ফাঁকতালে নাদিয়া দর্শনে উদগ্রীব থাকলেও, তাকে নিয়ে একটা খটকাও ছিল মনে । না ওই খটকাটা আমাদের দুজনের মাঝের ভৌগোলিক দূরত্ব নিয়ে নয়। ছিল তা তার বয়স নিয়ে । দৈনিক পত্রিকা আর লুকিয়ে চুরিয়ে পড়া সাপ্তাহিক, বিচিত্রা , সন্ধানী , রোববার এর কোন একটার মাধ্যমে যখন জানতে পেরেছিলাম যে বয়সে সে আমার বড়, তাতেই খটকাটা লেগেছিল ! না ঠিক খটকা না, বলা উচিৎ মন খারাপ হয়েছিল । প্রেম ভালবাসা তো বুঝি না তখন, কিন্তু তারপরও কিভাবে যে সামাজিক নীরব নিয়ম থেকে দেখে দেখে বা শুনে শুনে বুঝে গিয়েছিলাম , কোন বালকের, কিশোরের বা ত্রুনের তার ভাল লাগার কন্যাটিকে তার চেয়ে বয়সে কম হতে হবে। আর যখন সেটা বুঝতে পেরেছিলাম, তখনই মনে হয়েছিল আরে দূর এটা কোন নিয়ম হল না কি ? ভাঙ্গতে হবে ঐ ফালতু নিয়ম। এরকম ফালতু কোন নিয়ম থাকা উচিৎ না!
অবশ্য সে সময় তো এটাও জানতাম না যে প্রেম নিয়ম মানে না। না কি বলা উচিৎ নিয়ম মানলে প্রেম হয় না। না শুধু ঐ সময়েই নয়, তার আগে পরে নানান সময়ে, এমন কি এখনও চেতনে অবচেতনে প্রচলিত নানান নিয়মকে আমার অপ্রয়োজনীয় বাতিল মনে হয়েছে এবং এখনও হয়। ফলে যতো না চেতনে তারচে ঢের বেশী আমি ভাঙ্গতে চাই বাতিল নিয়ম অবচেতনে; কিন্তু সচেতনভাবে আবার যেহেতু জানি নিয়ম ভাঙ্গার ভয়াবহ পরিণাম হতে পারে, নানান বাস্তব আর সামাজিক অদৃশ্য শিকলে নিষ্ঠুরভাবে আস্টেপৃস্টে বাঁধা পড়ে যাওয়া, সে ভয়ে বরং নিজে নিজেই পড়েছি আর পড়ি আজো বাঁধা নিয়মেরই শিকলে। অতএব না করেছি আমি কোন বিপ্লব, না হতে পেরেছি প্রেমিক! এরকম ভাবনায় চায়নার জ্যামে আটকা আমার বুক ছেড়ে বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘশ্বাস।
আরে এ আমি করছি কি! আমার এই দীর্ঘশ্বাসের শব্দটি আবার কারো, মানে বিশেষত লাজুর কানে যায় নি তো? থেমে থাকা বাস এসময় ধীর গতিতে সামনে এগুতে শুরু করতেই সম্বিৎ ফিরল এই আতঙ্ককে সহযাত্রী করেই! ঠিক পেছনের সিটেই তো বসে আছে লাজু! কতো বড় দুঃসাহস আমার! এর মধ্যেই কি না তারই চোখের সামনে বসে বসে দিব্যি ভাবছি বালকবয়সের আকাশ কুসুম রকমের ভাল লাগা রুমানিয়ার নাদিয়ার কথা, যার সাথে এ জীবনে কোনদিন আমার হয় নাইকো দেখা! কিন্তু তাতে কি? দীর্ঘশ্বাস যে ফেললাম সেটার মানে কি? যতোই বলি না কেন এ আমার বিপ্লবী হতে না পারার দীর্ঘশ্বাস, তা তো টিকবে না ধোপে মোটেও। বরং নির্ঘাত পড়বো তোপের মুখে, যদি এ মুহূর্তে লাজু টের পায় কি ভাবছিলাম মনে এতোক্ষণ! আর তার পরিণাম যে কি হতে পারে তা ভাবতে গিয়েও বাসের ওম ওম উষ্ণতার ভেতরেও, শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল শীতল স্রোত! তাতে অস্বস্তিতে উসখুস করতে লাগলাম।
সেই অস্বস্তি থেকে বাঁচার জন্য একটু উঠে দাঁড়িয়ে পাইলট সাহেবের সামনের উইন্ডশিল্ড ভেদ করে চোখদুটোকে হও আগুয়ান বলে এগিয়ে দিতেই, দেখলাম বাইরের ধোঁয়াশা রঙের রাস্তায় লম্বা লাইনে সারিবদ্ধ জোড়া লাল লাইট। আশার কথা একদম থেমে নেই লাইটগুলো। খুব ধীরগতিতে হলেও নড়ছে ওগুলো সামনের দিকে।
“কি ব্যাপার দাঁড়িয়েছ কেন?” লাজুর এরকম জিজ্ঞাসায়, চোরের মন পুলিশ পুলিশ কথাটার সার্থকতা প্রমাণ করে এক্কেবারে থতমত খেয়ে দ্রুত আসন নিতে নিতে, আমতা আমতা করে বললাম যে, রাস্তা দেখে বুঝতে চাইছিলাম আর কি যে কতো বড় জ্যাম!
বড় ফাঁড়া কাটল একটা, জবাবের পেছন পেছন আর কোন প্রশ্ন না আসায়, হাঁফ ছাড়লাম। যেন বা আর দু একটা প্রশ্ন আসলেই বুঝি পড়ে যেতাম ধরা। অতএব দ্রুত হৃদয়কে ফেরাতে চাইলাম বালকবেলার হৃদয়মোহিনীর কাছ থেকে। ভাবলাম আচ্ছা আজকাল তো চায়নিজ জিমন্যাস্টরা মেডেল জিতছে হরহামেশা অলিম্পিকে আর নানান সব বৈশ্বিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, কোথায় ছিল তখন তারা? মানে ঐ আমার বালক বেলায়। সে সময় শুধু জিমনাস্টিকস কেন, কোন খেলাধুলাতেই চায়নিজদের তেমন নাম ছিল না। একমাত্র ব্যতিক্রম হিসাবে জানতাম যে পিং পং বা টেবিল টেনিসেই তারা অপ্রতিরোধ্য। এছাড়া চায়নাকে চিনতাম তখন দুটো কারণে, এক. মহাপ্রাচীর আর দ্বিতীয়ত. আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ফাকি হানাদের অস্ত্র দিয়ে প্রত্যক্ষ সহযোগিতার করার কারণে, যা বলেছিলাম আগেও। অতএব ঐ সময় খেলাধুলাতেও বিশেষত অলিম্পিকে আমি জয় চাইতাম তখন রাশিয়ারই শুধু, তার কারণ যতটা না সমাজতন্ত্র তারচে ঢের বেশী হলো ঐ ১৯৭১ এ আমাদের দেশের ব্যাপারে তাদের ভূমিকা। ঐ সময় তো সমাজতন্ত্র বোঝারই বয়স হয়নি আমার।
আহা আমার বালক বেলার সেই সোনালি সময়গুলো আসলেই কি সোনালি ছিল? সেইসময়গুলো তো আমাদের কেটেছিল একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নাই নাই হাহাকার আর নানান অরাজকতার মধ্যে, অন্যদিকে সারা পৃথিবিতেও ওই সময় তেমনি সর্বক্ষণই বইছিল ঠাণ্ডাযুদ্ধের গরম হাওয়া; যেটি মাঝে মাঝে পরিণত হতো লু হাওয়ায়। যার বাতাস কি না লেগেছিল সে সময়কার ক্রীড়াঙ্গনেও। যার কারণে চলছিল তখন তথাকথিত সার্বজনীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অলিম্পিককে বয়কটের কালও। নানান দেশের বিশেষত আমেরিকা আর রাশিয়ান শিবিরের দেশগুলো পালা করে তৎকালীন দুই মোড়লের নেতৃত্বে অলিম্পিক বয়কট করতো। ব্যাপারটা এমন আমেরিকা বা আমেরিকান শিবিরের দেশে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক বয়কট করতো রাশিয়া আর তার শিবিরের দেশগুলো । আর উল্টো ঘটতো যদি খেলা হতো রাশিয়ায় বা সমাজতান্ত্রিক কোন দেশে।
তারপরও অলিম্পিকের সময় প্রতিদিন খবরের কাগজে গুনতাম পদক তালিকায় কে এগিয়ে আছে , বিশেষত আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে, যে বছর দু দেশই অংশগ্রহণ করতো অলিম্পিকে। ঐরকম অলিম্পিকের সময় কায়মনে চাইতাম রাশিয়াই জিতুক স্বর্ণ সংখ্যায়, কিন্তু তা না হলে অন্তত সমগ্র পদক সংখ্যায়। কিম্বা জিতুক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো, যদিও অলিম্পিকের খাতায় চায়না তখন কোন উজ্জ্বল নাম ছিল না। আর থাকলেও তাকে সমর্থন করতাম কি না সন্দেহ আছে বড়। সে যাক ঐ সময়ে বয়কটের কারণে ওই অলিম্পিক গুলো হয়ে উঠতো হয় একচেটিয়া রাশিয়া বা আমেরিকার আধিপত্যের। যার কারণে ব্যাপারটা পানসে লাগত। সেয়ানে সেয়ানে লড়াই না হলে কি জমে নাকি খেলা? এমন ভাবনার ভেতরে তখন হাত ঢুকিয়ে বসলো ‘খেলাধুলায় রাজনীতি নাই’, এরকম ফালতু বয়ানের প্রবক্তা বাংপাকিরা, যারা আর সব কিছুতে মুক্তকণ্ঠে নিজেদের পাকিস্তানি সমর্থক হিসাবে পরিচয় না দিতে পারার কারণে, ঐ বয়ান ছেড়ে পাকিস্তানকে ক্রিকেটে অন্ধভাবে সমর্থন করে। মনটা এক্কেবারে তিরিক্ষি হয়ে গেল এতে।
অতএব সে চিন্তা থেকে মুক্তি নেয়ার জন্য, এবার সিটে বসে থেকেই একটু মাথা উঁচু করে পাইলটের সামনের উইন্ডশিল্ডের বাইরে নজরে ফেলতেই আবারো চোখে পড়লো ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করা সামনের অজগর জ্যামটির দিকে। বাস ও এদিকে চলছে আমাদের শম্বুক গতিতে, অন্যদিকে বাইরে ধোঁয়াশাকে আরও অস্পষ্ট করে অন্ধকার নেমে আসছে তার চেয়ে ঢের দ্রুত গতিতে। পেছন ফিরে পুত্রদের দিকে তাকাতেই বুঝলাম, এরকম আধো অন্ধকারে জ্যামে আটকে শম্বুক গতিতে এগুনো বাসে বসে তাদের গাড়ি দেখার খেলা জমবে না ভেবে, ব্যস্ত আছে তারা তাদের হাতযন্ত্র নিয়েই।
আচ্ছা কানমিংয়ে জ্যামে পরে যেমন অনেক ভেবেও বুঝতে পারিনি আকারে এতো বড়দেশ হওয়ার পর আর ইদানীং ধনেসম্পদে ফুলে ফেঁপে ওঠা চায়নার রাস্তায় এরকম যাকে বলে কুত্তা জ্যামের কারণ, বুঝতে পারছি না তা এখনো। অর্থনৈতিক সক্ষমতার সাথে রাজনৈতিক স্থিরতা মিলিয়ে অবস্থা যা এখানে, তাতে তো তাদের পরিকল্পকদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করতে পারার পথে তো কোন বাধা ছিল না কখনো, নেই এখনও। আবার পরিকল্পক হিসাবে তাদেরকে যা তাও গণ্য করবে না চায়নার ঘোরতর নিন্দুকও। তাহলে কেন এরকম অবস্থা এখানে?
তবে কি ঘটনা এখানে তাহলে এরকম যে, সমাজতন্ত্র ছেড়ে পুঁজিবাদের পথে পা বাড়ানোর পর পর চায়নার জনসংখ্যার আকার, আর তার দক্ষ জনশক্তির কর্মকৌশল আর সৃষ্টিশীলতাকে লক্ষ করে আউটসোর্সিং যে ঢেউ এসেছে, তাতে এখানাকার সামগ্রিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির শনৈঃ শনৈঃ গতিবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে এখানকার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধির উল্লম্ফনটি হবে তা কি এদের অর্থনীতিবিদরা কেউ ভাবেননি নাকি? আর ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণের সাথে অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারনে চলমান জীবনে যে বাড়তি গতি সঞ্চারের প্রয়োজন হবে তাও কি ভাবেননি এখানকার সুশিলেরা? ফলে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা যে গতিতে বাড়বে তা কি ধরতে পারে নি নাকি এখানকার সড়ক পরিকল্পকরা? শুরুতে যাই হোক না কেন এখনো কি তারা; মানে ঐ পরিকল্পকরা বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা। এই যদি হয় চায়নার অবস্থা তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর অনিয়ম দুর্নীতিতে আকীর্ণ আমার দেশটির একই ব্যাপারের চূড়ান্ত অক্ষমতাটিকে দোষ দিয়ে আর লাভ কি ?
অবশ্য তার মানে এই নয় যে, আমাদের রাষ্ট্রে,সমাজে এমন কি পরিবারে পরিবারে গভিরভাবে প্রোথিত নীতিহীনতা, দুর্নীতি আর অদক্ষতাকে সমর্থন করছি। আমাদের নীতিনির্ধারকরা, পরিকল্পকরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্নীতিবাজ হলেও, তারা অদক্ষ তা আমি মানতে রাজি নই মোটেই। এছাড়া তাদের কাজ করতে হয় বিদেশী নানান মোড়লদের মনরক্ষা করে। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার যা ঘটে আমাদের দেশে তা হলো, পরিকল্পনার স্তর থেকে যখন কোন কাজ যায়, বাস্তবায়ন স্তরে তখনই বরং ঘটে নানান তোঘলকি কাণ্ড। হউক তা দুর্নীতির বা অদক্ষতার। যতোটা দেখেছি আর বুঝেছি আমাদের সমাজের, রাষ্ট্রের কলকব্জার হাল চাল তাতে এরকমই ধারণা হয়েছে আমার। সে জায়গায় দূর থেকে আবছাভাবে হলেও যতোটা জানি চায়নার ব্যাপারে, তাতে তো বুঝি যে এসব ঝামেলার বালাই নেই তাদের। কিন্তু তারপরও কেন এমন হবে তাদের ক্ষেত্রে ? তবে কি এটা হলো এখানকার পরিকল্পকদের যাকে বলে স্ট্রাটেজিক মায়োপিয়া?
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবেগ নয় -চাই মনুষ্যত্বের সাধনা
পরবর্তী নিবন্ধদশচক্রে ভগবান ভূত