দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৭ জানুয়ারি, ২০২১ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

কাঁচকলা বনাম থাম্বস আপ -২
হুটোপুটি করে পুত্রদ্বয় এরই মধ্যে আমার পেছন দিয়ে আমাকে পেরিয়ে চলে গেছে বাসের মাঝে, ভাবটা এরকম যে বাসে বুঝি একটাই সিট খালি আছে, অতএব দুজনেরই লক্ষ্য সেই একমাত্র খালি সিটটাই!
“ব্যাগ সুটকেসগুলো কি করবো, দাদা? এখানেই এগুলো ফেলে রেখেই উঠবো না কি?” তুমুল উদ্বেগমাখা প্রশ্ন ঠাণ্ডায় কাবু জুবুথুবু হেলেনের হ্যাঁ হ্যাঁ উঠে পর দুজনেই তোরা। কোন সমস্যা নাই, এখানে চোর থাকলেও এই মুহূর্তে ধারে কাছেও তো কোন কাকপক্ষিও নাই। আর আমি নামছি ওগুলোকে লাগেজ কেবিনে ঢোকানর ব্যবস্থা করতে, মাথা ঘুরিয়ে হেলেন আর লাজুর উদ্দেশ্যে বলেই, নীচে দরজার পাশে ফেলে আসা ট্রলি বোঝাই ব্যাগ সুটকেসগুলো দেখিয়ে হাত পা নাড়িয়ে, চোখ নাচিয়ে বাসপাইলটকে পরিষ্কার বাংলায় বললাম, চাচা ঐ ব্যাগগুলো তো ঢোকাতে হবে কেবিনে, এসিট্যান্ট কই আপনার?
ড্রাইভিং সিটে বসে থেকেই একটু কাত হয়ে, ড্রাইভিং সিট আর দরজার মাঝখানে চীনের মহাপ্রাচির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমার শরীরের পাশ দিয়ে বাইরেরটা যতোটা দেখা যায়, গলা বাড়িয়ে চাচা সেই দিকে নজর ফেলতেই ওগুলোর উপস্থিতির আভাস বুঝতে পেরেই, ড্রাইভিং সিটের সামনের ড্যাশবোর্ডের একটা বোতাম টিপে, চুং চাং শব্দতুলে হাসি মুখে ফের আমার চোখে চোখে রেখে দরজার দিকে ইশারা করলেন।
বুঝলাম বোতাম টিপে খুলে দিয়েছেন বাসের তলপেটে সামনের আর পেছনের চাকার মাঝামাঝি জায়গায় থাকা লাগেজ ক্যাবিন । এখন ওগুলো গিয়ে ঢোকাতে হবে আমাকেই। মানে চায়নার বাসে ইউরোপিয়ান হিজ হিজ হুজ হুজ স্টাইল। অতএব ঘুরে নামার উপক্রম করতেই দেখি ধীরে সুস্থে, একটু খুঁড়িয়ে উঠছে লাজু বাসে। তার আগেই অবশ্য শীতের ভয়ে নয় শুধু, এক্কেবারে শীতের সরাসরি মুখোমুখি আক্রমণে কাবু হেলেন, বাসে ঢুকে মাঝামাঝি জায়গায় জানালার পাশ দখল করে বসা দুই ভাইয়ের মধ্যে, দীপ্রর পাশে গ্যাঁট হয়ে বসে পড়েছিল।
লাজু উপরে উঠে যাওয়ার পর পরই নীচে নেমেই বাসের তলপেটের দিকে যেখানটায় লাগেজ ক্যাবিন সাধারণত থাকে , সেদিকটায় চোখ গেল প্রথমেই অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই। ঐটির ডালা উপরে উঠা অবস্থায়, মানে ক্যাবিন খোলা থাকাতে বুঝলাম পাইলটচাচার বোতাম কাজ করেছে। এখন ব্যাগ সুটকেস ওখানে দ্রুত ঢুকিয়ে নিজেরও সাত তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়া দরকার বাসের উষ্ণতায় । কিন্তু সমস্যা হলো, একা আমি তো একবারে দুটো বোঝাই ট্রলি ঠেলে নিয়ে যেতে পারবো না। ফের তাকালাম আশেপাশে, বাসের পাইলট চাচার কোন এসিস্ট্যান্ট কোথাও গিয়ে থাকলে, ফিরেছে কি না সে তা বোঝার জন্য।
নাহ সকলি গরল ভেল! নেই কেউ ওরকম আশেপাশে। অতএব দ্রুত আমার ট্রলিটা ঠেলে খোলা লাগেজ কেবিনের কাছে রেখে , ফিরে এলাম ফের হেলেন যে ট্রলিটা এনেছিল সেটা নিতে। অতপর দুটো ট্রলির মালামাল, আর প্রথম দুটো ক্যাবিনের ভেতরেটা দ্রুত একবার চোখজরীপ করে লেগে গেলাম বাসের তলপেটে ওগুলোকে চালান করায়।
মালামাল ঢোকাতে ঢোকাতে ভাবলাম, তার মানে কি? ইউরোপ আমেরিকার বাসের মতো, এই বাসটির সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ কি সবেধন নীলমণি পাইলট চাচারই নাকি? কোন কন্ডাক্টর ফন্ডাক্টর বা এসিট্যান্ট /হেল্পার নাই নাকি? তা বাবা বুঝলাম, যে বাসটি সম্পূর্ণ ইউরোপ আমেরিকায় তৈরি বাসগুলোর মতোই স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেটিক, তাতে একজন পাইলট দিয়েই এটি পরিচালনা করা সম্ভব । ইউরোপ আমেরিকায় না হয় জনসংখ্যা, বিশেষত কর্মক্ষম জনশক্তি কম থাকায় অর্থনীতির চাহিদা আর যোগানের সুত্র মেনে লোক খাটানোতে টঙ্কা গুনতে হয় ঢের; সে জন্যই না হয় তারা যাবতীয় কিছুর যান্ত্রিক সমাধান বের করেছে আধুনিক জীবনের নানান পর্যায়ে স্বয়ংক্রিয় সব যন্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে; কিন্তু চায়নার তা করতে হবে কেন ? দেশ হিসাবে এরাই তো হল গ্রহের সবচেয়ে বড় জনসংখ্যাটির মালিক। এছাড়া এদের জনশক্তির দাম কম বলেই তো, ইউরোপ আমেরিকার কোম্পানিগুলো তাদের কারখানা গুলোকে সব চালান করেছে এখানে।
অতএব শুধু একজন পাইলটের উপর সব দায়িত্ব না চাপিয়ে একজন সাহায্যকারি বা হেল্পার বাসে দিলে তো যাত্রীসেবার মানটি বেশ বাড়তো। এই যেমন, আমি এখন এতগুলো ব্যাগ সুটকেস একাকি ঢোকাতে গিয়ে গলদঘর্ম না ঠিক করে বললে, বলতে হয় গলদগরম হচ্ছি। (যে ঠান্ডায় আছি, তাতে শরীর থেকে ঘাম বেরুবার জো নেই। আর বেরুলেও তা চামড়া ফুঁড়ে উপরে উঠতেই বরফে পরিণত হওয়ার কথ), তাতে এমুহূর্তে আমার একটু নয় ঢের উপকার হত। আবার তাতে তো সরকারেরও লাভ হত, বাড়তি একটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারায়, কিন্তু করলো না কেন তা এরা?
বাহ! বাসের তলপেটে তো দেখছি ভালই জায়গা আছে! আমাদের সব ব্যাগ ঢোকানোর পরও, প্রথম লাগেজ ক্যাবিনটির পুরোটা ভর্তি করতে পারিনি। এখানে আরো ব্যাগ সুটকেস রাখার সুযোগ আছে , শেষ ব্যাগটি ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই, ঐ সুযোগ শব্দটির লেজ ধরে লাফ দিয়ে হাজির হলো মগজে দুটো শব্দ; ‘অপরচুনিটি কষ্ট।’
বুঝলাম যতই গলদগরম ব্যস্ত থাকি না কেন এতোক্ষণ নিজে, অবচেতন মন ঠিকই ব্যস্ত ছিল একজন সাহায্যকারি এই স্বয়ংক্রিয় বাসটিতে না থাকার অর্থনৈতিক কার্যকারণ নির্ণয়ে। তাতে ইতোমধ্যে সে একটা হাইপথেসিস দাঁড় করিয়েছে যে, এই স্বয়ংক্রিয় বাসটিতে একজন সাহায্যকারী দিলে হয়তোবা সেটির “অপরচুনিটি কষ্ট” বেশী হয়ে যাবে সরকারের জন্য, তার বদলে সেই পুরুষ বা মহিলাটিকে কোন কারখানায় কাজ করালে তাতে বোধকরি “রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট” বেশী হবে। আচ্ছা অর্থনীতি আর ফিন্যান্সের বহুল ব্যবহৃত এই শব্দগুলোর লাগসই বাংলা প্রতিশব্দ কি? আর এই বাসটাই বা কোথাকার তৈরি? এসময় বাসের বন্ধ গেটের সামনে এসে দাঁড়াতেই এই প্রশ্নযুগল মাথায় গোত্তা মারতে লাগলো।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনাকালীন চাকরিহারা অসহায় মানুষের নীরব আর্তনাদ
পরবর্তী নিবন্ধঅমলেন্দু বড়ুয়া : মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি