দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৪ অক্টোবর, ২০২০ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ

ফিরে চল মাটির টানে
হ্যাঁ বাবা, আমরা সম্ভবত এসেই পড়েছি। একটু পরেই হয়তো প্লেন নামতে শুরু করবে নীচে। দেখিতো তো তোমার সিট বেল্ট বাঁধা আছে কি না, অভ্রের প্রশ্নের জবাব দিয়ে পাশ ফিরতেই বললো-“না না দেখতে হবে না, আমি বেল্ট বেঁধেই রেখেছি। সিটে বসে বাঁধার পর খুলিনি তো ওটা”। বুঝলাম পাইলট হওয়ার বাসনায় ইতিমধ্যে আমাদের ঘরের প্লেন আর এয়ারলাইন্স বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা সদস্যটি, চায়নিজ এয়ারলাইন্সগুলোর সেফটি রেকর্ড সম্পর্কে যতই ওয়াকিবহাল হোক না কেন, তা নিয়ে অতি আত্মবিশ্বাসের বশবর্তী হয়নি সে। তাই কানমিং এর মেঘলা আকাশে উড়াল দেবার আগে সিটে বসে যে বেল্ট বেঁধেছিল, বাড়তি সতর্কতা হিসাবে সেটি সে আর খোলেনি। আশ্বস্ত হয়ে তাই নজর দিলাম আইলের ওপারে।
ওদিকে তাকিয়ে সবাইকে সিট বেল্ট বাঁধার তাড়া দিতেই, ত্রয়ী কণ্ঠে ধ্বনিত হল সেই একই জিজ্ঞাসা; একটু আগে যা ঘুম ঘুম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিল অভ্র, মানে আমরা চলে এসেছি কি না বেইজিংএ।
ত্রয়ীকণ্ঠে বেজে উঠা প্রশ্নের উত্তরে এককন্ঠ হ্যাঁ বোধক জবাব দিতেই, ছোঁয়াযন্ত্রে খেলায় মগ্ন দীপ্র মুখ তুলে “ওয়াও” বলেই, ফের মনোযোগ নিবদ্ধ করলো ছোয়াযন্ত্রের পর্দাতেই। লাজু ও হেলেন নড়েচড়ে নিজ নিজ সিট বেল্ট বাঁধতে ব্যস্ত হতেই, ভাবলাম কি ব্যাপার? ওরা কি ধরেই নিয়েছে নাকি যে এই চায়নার যাবতীয় কথাই তাদের অবোধ্যই হবে ! তাই কি কানই দেয় নি নাকি ওরা ক্যাপ্টেন সাহেবের চিংলিশ ঘোষণায়?
“সিত বেলত প্লিজ” “সিত বেলত প্লিজ” চি চি করে বলতে বলতে ততক্ষণে আইল ধরে সামনে থেকে বিমানবালা চায়না কন্যা এগিয়ে আসতেই, মনে হল নাহ এতো শুধু এখানেই হচ্ছে আর এখনই হচ্ছে শুধু আমাদের বেলায়, তা তো নয়। মানে ঐ যে বলছিলাম প্লেনের ক্যাপ্টেন ঘোষণা দেবার পরও, সব জায়গায় সব ফ্লাইটেই অবস্থা একই হয় ! অর্থাৎ ক্যাপ্টেনের ঘোষণার পরও অনেকেই তা উপেক্ষা করে বা কানে না তুলে বসে থাকে। ফলে ঐ ঘোষণার পর পরই ব্যাপারাটি সরেজমিনে তদারকিতে নেমে পড়তে হয় বিমানবালা আর কেবিনক্রুদের সবজায়গাতেই আর সবসময়েই । যার মানে দাঁড়ায় আমাদের কথ্য ভাষায় যেটাকে আমরা বলি, বকাউল্লাহ বকে যায় আর শোনাউল্লাহ শুনছে কি না তাও নিশ্চিত নয়। আর শুনলেও তা কার্যে পরিণত যে করে না অনেকেই সেটা নিশ্চিত।
সে যাক, বেশ দ্রুতই দু দিক থেকে দুই চায়নাকন্যা সকলের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করে, সামনে গিয়ে এয়ারক্রাফটের দরজার কাছের দেয়ালে লাগানো তাদের যার যার নির্ধারিত আসন খুলে নিয়ে নিজেরাও বেল্ট বেঁধে মুখোমুখি বসে পড়তেই, সেইজন যিনি নাকি বসেছেন যাত্রীদের দিকে মুখ করে, তার চোখেচোখে চোখ পড়লো আমার। তাতে ঐ চায়নবালার চোখ পিট পিট করে মনে হলো কিছু বললো বুঝি! অবশ্য চোখে চোখে চোখ আসলেই পড়েছে, নাকি ওটা নিতান্তই চোখের ভুল, তা অবশ্য নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। কারণ ছোটবেলা থেকেই তো ক্ষীণদৃষ্টি সহচর আমার। অতো দূর থেকে চায়নিজ ব্র্যান্ডের ছোট চোখের ভাষা আমার দৃষ্টিগোচর হওয়ার মতো শক্তিশালী রাডার তো নয় আমার চশমাসমৃদ্ধ চোখ। তারপরও মনে মনে প্রমাদ গুনে চোখ ফিরিয়ে নিলাম দ্রুতই, আইলের ওপাশ থেকে সম্ভাব্য আর অনিবার্য আক্রমণের আশংকায়! স্ত্রীর উপস্থিতিতে কোন স্বামীর চোখ, ভিন্ন কোন রমণীর চোখে চোখ পড়ার মতো ভয়ংকর অপরাধ যতই অনিচ্ছায় ঘটে থাকুক না কেন, আর হোক না সে চোখ যতই ছোট চায়নিজ ব্র্যান্ডের কিসসু যায় আসে না তাতে। স্ত্রীর এজলাসে অপরাধি স্বামীর ঐ রকম গুরুতর অপরাধের ক্ষমা নেই কোন, সহজে। অতএব নিজ নিরাপত্তার জোর তাগিদে, চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে লাজু কে দেখে বুঝতে চাইলাম ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে কিনা। দেখলাম যখন, ব্যস্ত ও তখনো নিজের হাতব্যাগের ভেতর থেকে কিছু একটা খুঁজে বের করা নিয়ে, বাঁচলাম হাফ ছেড়ে। অর্থাৎ চোর না হয়েও অবস্থা আমার সারাক্ষণই দেখছি পুলিশ পুলিশই। ব্যাপার কি তাহলে এই যে, কারো আশেপাশে সারাক্ষণই যদি পুলিশ থাকে তবে সে যদি সাধু সন্ত শ্রেণিরও কেউ হয়, তারপরও কি তার চোর চোর মন হয় নাকি? এসময় এমত ভাবনার মধ্যেই শরীরে কেমন যেন একটা শিহরন বা টান অনুভব করলাম। এরকম অন্য কারো হয় কিনা জানি না, তবে আমার হয় সবসময়ই। আর তা হল মাধ্যাকর্ষণের টানের বিপরীতে উড়তে থাকা প্লেন ল্যান্ডিংয়ের প্রস্তুতি হিসাবে যে মুহূর্তে নিজেকে সপে দেয় মাধ্যাকর্ষণের দিকে , তখনই শরীরের কেমন যেন একটা ভিন্ন রকমের অনুভূতি নিজেরই অজান্তে নিজেকে জানান দেয়, যে যাচ্ছি ফিরে যাবতীয় অসঙ্গতিপূর্ণ প্রিয় মাটির গ্রহটির, মাটিরই দিকে ফের। অর্থাৎ মন আমার তখন যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন , শরীর এসময় ঠিকই গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠে গান ‘ফিরে চল মাটির টানে’। অতএব সে টানের টানে চোখ ফেললাম জানালার ওপাশে, বোঝার জন্য কি অবস্থা বেইজিং এর আকাশের। কিন্তু নাহ গতকাল দুপুর থেকেই কানমিং এর আকাশের যে মুখ ভার করা চেহারা দেখেছিলাম, জানালা দিয়ে যতটুকু দেখা গেলো এখন আকাশের আভাস, তাতে মনে হল বেইজিংএর আকাশেরও মন ভাল নেই। ওদিকে অভ্র নিবিষ্ট মনে চোখ রেখে আছে জানালার বাইরে। বুঝলাম, এ মুহূর্তে যতটুকু পারা যায় ও নিশ্চয়ই বুঝতে চাইছে বা দেখতে চাইছে, এই প্লেনটির ল্যান্ডিংপূর্ব আয়োজন থেকে শুরু করে ল্যান্ডিং এর মুহূর্তটি। যদিও নিশ্চিত নই জানালা দিয়ে তার কতোটাই বা বুঝতে পারবেও। তবে হ্যাঁ, ল্যান্ডিং ঠিক মতো না দেখতে পেলেও ল্যান্ডিং এর আগে থেকেই এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকা নানা এয়ারক্রাফট দেখার সুযোগও যে অভ্র ছাড়তে চাইবে না, সেটাও জানা কথা। অতএব ওর এই গভীর মনোযোগে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকার অর্থ সহজে বোধগম্য।
মিনিট পনের বা বিশের মধ্যে, প্লেনের ল্যান্ডিং এর প্রতি অভ্রর সম্ভাব্য নিবিষ্ট মনোযোগের প্রতি সম্মান রাখার জন্যই হোক, আর চায়নিজ পাইলটের দক্ষতার কারণেই হোক, প্লেনের সাথে সাথে সকলেই আমরা অবশেষে মাটির টানে মাটিতেই ফিরিলাম কোন রকম ঝাকুনির ঝক্কি ছাড়াই। অতপর রানওয়েতে গড়াতে গড়াতে প্লেন গিয়ে বোর্ডিং ব্রিজে লাগতেই, আশপাশ আর সামনে পেছনের নানান সিট থেকে উড়ে উড়ে আসা খুটখাট, খস খস ইত্যাদি নানা শব্দ জানান দিলো, প্লেনের যাত্রীদের দ্রুত মাটির পৃথিবীতে নেমে পড়ার উসখুস আকাঙ্ক্ষার খবরটি। অতএব নামার প্রস্তুতি নিলাম দ্রুত আমরাও। পিকিং মানবের দেশের সম্ভাব্য ঠাণ্ডার কথা মনে রেখে, প্লেন থেকে নামার আগে যার যার হাতব্যাগ, পিঠব্যাগ কিম্বা হাতে বহন করা অতিরিক্ত গরম কাপড় চাপাতে বললেও কেউ তেমন গা করলো না তা। অগত্যা নিজে নিজের গরম কাপড় পরে নিয়ে, অভ্র দীপ্রকেও পরিয়ে দিয়ে, বোর্ডিং ব্রিজে পা রেখেই ধাক্কা খেলাম নিজেই প্রথমে।
না সেই ধাক্কা, শরীরের উপর লাগা বেইজিং এর ঠাণ্ডার ঝাপটা নয়। ধাক্কাটা হলো মানসিক। আসলে মনে মনে যে বেইজিং শহরের ছবি আঁকা হয়ে গেছে ইতোমধ্যে, তার ছিটেফোটা জৌলুসও নেই বোর্ডিং ব্রিজটিতে। জানি সকলেই না হলেও অনেকেই বলতে পারেন, এ আবার কেমন কথা হলো? শহরের জৌলুস কি বোর্ডিং ব্রিজে থাকে নাকি? কথা সত্য, আবার সত্য নয়ও তা। এ পর্যন্ত নানান দেশের ভ্রমণ অভিজ্ঞতাই দেখেছি, আমাদের দেশের নানানজন নিজেদের গ্রামের বাড়ির ঢোকার রাস্তার মুখে সুদৃশ্য গেইট, মসজিদ এসব বানিয়ে যেমন, তাদের বাড়ির বিত্ত বৈভব বা ঐতিহ্যের প্রকাশ করতে চান বাইরের লোকদের কাছে; হোক না ভেতরে তাদের ঘরবাড়ির অবস্থা যতই, উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট, তেমনি এয়ারপোর্টের জাঁকজমকেই নানান শহর বা দেশ, ভ্রমণকারীদের কাছে তুলে ধরতে চায় তাদের শান শওকতের ব্যাপারটি।
আর এয়ারপোর্টের ঐ জাঁকের শুরুটা হয় বোর্ডিং ব্রিজ থেকেই; বোর্ডিং ব্রিজের মেঝেতে সাঁটানো কার্পেট আর তার দুপাশের দেয়ালের সাজ সজ্জায়। এছাড়া আজকাল যেহেতু ঐ দেয়ালগুলোর সাজ সজ্জার দায়িত্ব নিয়ে হাসিমুখে উপরন্তু মনিকাঞ্চনের যোগে, নেয় বড় বড় নানা কোম্পানি, যারা বিশেষত পারফিউম, ব্যাগ, ঘড়ি ইত্যাদি সব নানান বিলাসদ্রব্যের কারবার করে থাকে, সেহেতু জমক ঠমকের কমতি থাকে না, বোর্ডিং ব্রিজেরও। সজ্জিত হয়ে উঠে বোর্ডিং ব্রিজের দেয়াল, ঐসব কোম্পানির পণ্যের দৃষ্টিনন্দন, নানান বিজ্ঞাপনের বাহারে। এমনকি যেমন আমাদের ঢাকা শহরে নামকরা সব ব্র্যান্ডের পারফিউমের নির্ভরযোগ্য কোন দোকান না থাকলেও, ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বোর্ডিং ব্রিজের দেয়াল কিন্তু শোভিত হয়ে আছে ওইরকম একটি পারফিউম ব্র্যান্ডের দখলেই, মনে পড়লো।
বোর্ডিং ব্রিজ পেরিয়ে মূল এয়ারপোর্টের আগমনী লাউঞ্জে পা দিতেই বুঝলাম আসলেই, বোর্ডিং ব্রিজ ইজ দ্য ইনডেঙ অব এয়ারপোর্ট। চারিদিকে কেমন যেন একটা ম্যাড়ম্যাড়ে ভাব গোটা লাউঞ্জে। কোথায় একটু আগে ছেড়ে আসা কানমিং এয়ারপোর্ট! আর কোথায় হলো এই বেইজিং এয়ারপোর্ট! সেটাই বা কেন বলছি? যা দেখছি অবস্থা এই এয়ারপোর্টের তাতে তো এটা আমাদের কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছেও দাঁড়াতে পারবে না! ঘটনা কি? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শহর বেইজিং এর এয়ারপোর্টের এ অবস্থা কেন? এ ব্যাপারটা দলের বাকীরা খেয়াল করেছে কি না এখনো জানি না! তবে দীপ্র অভ্র যে ব্যাপারটাতে আমার মতো একই রকম না হলেও ধাক্কা যে একটা খেয়েছে, বুঝতে পারছি তাদের দেহভঙ্গি আর হতাশ চেহারা দেখে। মুখে যদিও বলছে না ওরা কিছুই এখনো। নাকি খেয়েছে তারা আরো জোর ধাক্কা, ফলে অবস্থা এখন তাদের, অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর নাকি? এরকম ভাবতে ভাবতে ওদের দিকে তাকাতেই -অভ্র স্বভাবমতো জিজ্ঞেস করলো “বাবা হোয়াই দিস এয়ারপোর্ট লুঙ পুওর”? সাথে সাথে দীপ্রও যোগ করলো “এটাকে তো এয়ারপোর্টই মনে হচ্ছে না বাবা, এরকম কেন এটা? বেইজিং তো এদের ক্যাপিটেল সিটি তাই না?”
“আরে তাইতো এতক্ষণ বুঝতে পারছিলাম না, কেন যেন কিরকম কিরকম লাগছিল। এরকম ফকিরা অবস্থা কেন এটার” শোনা গেল হেলেনের গলাও। “হুম কোন দোকানপাঠও নাই। দেয়াল গুলোর রং কেমন যেন অনেক পুরানো পুরানো মনে হচ্ছে “ যোগ করলো লাজুও। এদিকে বোর্ডিং ব্রিজে পা রেখে নিজে প্রাথমিক ধাক্কাটা খেয়ে যাওয়ায়, গোটা আবহটি ঘিরে আমার হতাশ লাগলেও, অবাক আর হচ্ছি না আমি ততো, যতোটা হচ্ছে এখন লাজু আর হেলেন বা দীপ্র অভ্র। চোখ আমার বরং ওসব উপেক্ষা করে, খুঁজে বেড়াতে লাগলো মলিন দেয়ালে লাগানো নানান দিকনির্দেশক সাইন গুলোর দিকে; যার মধ্য থেকে এ মুহূর্তে দুচোখ ব্যস্ত খোঁজায় ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকনির্দেশক সাইন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নের বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধক্রসফায়ার থেমেছে বটে শেষ নয়