দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২৬ জুন, ২০২২ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

চাপহীনতার নিদারুণ চাপ -২

জোঁকের মুখে লবণ দিয়ে দেয়ার মতো পুত্রের এই উত্তরে কোন রা করলাম না আর। একদিকে মাতৃ আজ্ঞা পালনের জন্য তো তাদের কিছু বলাই উচিৎ না। দ্বিতীয়ত নিজেদের কাজ নিজে থেকেই কিছুটা এগিয়ে রেখে তো ভালই করেছে ওরা, কারণ খাবার নিয়ে উপরে ওঠার সাথে সাথেই যে মায়ের কাছ থেকে যে এ হুকুম আসতো তা তো নিশ্চিত। তৃতীয়ত এই ফাঁকে অতীব জরুরি সেই ঘরটির ঠিকানার যে তারা হদিস করে রাখল, আখেরে তা তো সবারই কাজে লাগবে।
এরই মধ্যে আমার পালা আসতেই, কাউন্টারের দিকে এগুতেই, পিছু পিছু আসতে আসতে অনুচ্চ কণ্ঠে দীপ্র জানাল তার সেই অতিরিক্ত অর্ডারের কথা, মানে বিগ ম্যাকে যেন এঙট্রা চিজ এন্ড মেয়নেজ দিতে বলি, আর দুজনের জন্য যেন নেয়া হয় দুটো বাড়তি ফেঞ্চফ্রাই ও এক্সট্রা লার্জ ড্রিংক্স।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে পুত্রদের আশ্বস্ত করে, হ্যালো বলে হাসি মুখে কাউন্টারে দাঁড়াতেই, কাউন্টারবয়ের চেহারায় আবছা একটু হাসি দেখা গেলেও তার দেহভঙ্গিমায় মনে হল, বেচারা ঘাবড়ে গেছে। তবে সে কি মঙ্গোলিয়ান রাজ্যে হঠাৎ এক বা দুইজন নয় এক্কেবারে তিন তিনটি বঙ্গমূর্তির চেহারায় দেখে ঘাবড়ালো? নাকি নিজ মাতৃভাষা বাদ দিয়ে এক্ষুণি তাকে কথা কইতে হবে বিজাতীয় ভাষায় আশংকায় দমে গেল সে? এ বিত্তান্তের হদিস করতে না পেরে, খুব ধীরে সুস্থে এক এক করে শব্দ উচ্চারণ করে তারে ইংরেজিতেই জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি ভাতিজা ইংরেজি বোঝ?

উত্তরে ফের একচিলতে হাসি দেখা গেলেও, হাত দেখছি তার নিশপিশ তার সামনে কাউন্টারের উপরে শুয়ে থাকা অর্ডার টেকিং কাম ক্যাশ মেশিনের উপর, দ্রুত কাজ শুরুর করার জন্য।

নাহ কথা বাড়ানোর ঝামেলায় গিয়ে আর লাভ নেই, যতই হউক না সে একালের চায়নিজ, ইংরেজি সে রপ্ত করতে পারেনি। অতএব সামনে কাউন্টারে আমাদের দিকে মুখ করে চিত হয়ে শুয়ে থাকা মেনু কার্ডের ছবি দেখিয়ে, প্রথমে আমাদের প্রাপ্তবয়স্কদের সোজাসাপটা অর্ডার দেয়ার জন্য, হাতের আঙ্গুলে তিন দেখাবার সাথে সাথে, ঐ মেশিনের ছোট্ট পর্দা যেটি আছে এদিকে মুখ ফিরিয়ে, তাতে সবুজ রঙয়ে জ্বলে উঠা লেখা গুলো দেখে নিশ্চিত হয়ে, স্বস্তি পেলাম।

এই মাত্র করা তিনজনের অর্ডার একদম ঠিক ঠিক নিতে পেরেছে দেখে হাসিমুখে তাকে ইংরেজি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাহবা দিয়ে, পুত্রদের বিগম্যাকের সাথের বাড়তি অর্ডার গুলো করার সাহস পেয়ে, একই পদ্ধতি অনুসরণ করে অর্ডার করতে গিয়ে বুঝলাম পড়েছি এক্কেবারে খাস চায়নিজের পাল্লায়। কিছুতেই বিগ ম্যাকের ভেতরে এক্সট্রা চিজ আর মেয়নেজ দেয়ার ব্যাপারটা বোঝাতে পারছি না! অন্যদিকে তার উসখুস অস্বস্তি দেখে আন্দাজ করি বেচারা ম্যাকের নিয়মানুযায়ি ঘড়ির কাঁটা ধরে কাস্টমার সার্ভ করার যে পারফর্মেন্স টার্গেট আছে ঘাড়ে তার, তা নিয়ে বড়ই বেচাইন হয়ে পড়েছে। এদিকে আমাদের এই সামান্য খটমটের ফাঁদে পরে যে সামান্যতম বিলম্ব হচ্ছে তাতে পেছনের লাইনেও যে অচিরেই বিরক্তির সংক্রমন ঘটবে, আন্দাজ করে তা পুত্রদের বললাম, বাবা ঐ এক্সট্রা চিজ আর মেয়নেজ তো বোঝাতে পারছি না। থাক না, বাদ ওটা। দেখি এক্সট্রা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর এক্সট্রা লার্জ ড্রিংক্স বোঝাতে পারি কি না।

সাথে সাথেই ‘ঠিক আছে বাবা’ বলে দীপ্র আশ্বস্ত করতেই পনির মেয়নেজ বিষয়ক ধস্তাধস্তিতে খ্যান্ত দিয়ে, ছবি দেখানোর সাথে আঙ্গুলে দুই দেখিয়ে ওদের দুটো বিগ ম্যাকের অর্ডার দিতেই তড়িৎ দেখা গেল তা মেশিনের পর্দায়। এতে আবারো তাকে বুড়ো আঙ্গুলে ইংরেজি বাহবা দিতেই, তার মুখের স্বস্তির চেনা হাসিটির দেখা মিলল। কিন্তু নাহ! ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের ছবি, আর বড় সাইজের ড্রিংঙের গেলাস দেখিয়ে বিগ ম্যাক মিলের সাথে অতিরিক্ত সে দুটোর অর্ডার করতেই, অস্বস্তি দেখা গেল চেহারায় তার ফের!

নাহ, এবার আর ছাড়ব না হাল সহজে। হয়, হউক বিরক্ত পেছনের লোকজন। এরকম আকাট চায়নিজ রেখেছে কেন ম্যাক এই এখানকার শপিং এলাকায়, যেখানে কম হলেও বিদেশীদের আনাগোনা আছে। অতএব দেরী যদি কিছু হয়ও ভাষা বিভ্রাটের কারণে, তবে তার দায় তো আমার না!

কপাল ভালো রবার্ট ব্রুসের মতো, ১৭ বার চেষ্টা করতে গিয়ে লাইনের লোকজনের ব্যক্ত অব্যক্ত অভিশাপ বা গালাগালের মুখোমুখি হতে হয়নি। নিজের মূকাভিনয়ের তৃতীয় চেষ্টাতেই সফলকাম হইতেই, দু পক্ষের মুখেই হাসি ফুটল। অতপর দাম মিটিয়ে দেবার পর সে যখন গেল পেছনের রেক থেকে আমাদের খাবার তুলে ট্রে তে সাজিয়ে আনার জন্য, প্রায়শই যে ভাবনাটা আসে মনে, টুক করে মাথা তুলল সেটি –

আচ্ছা ডিজিটাল যুগে এই যে সব কিছু তাড়াতাড়ি নিষ্পন্ন করে ফেলার যে তাড়া সবার, তাতে লাভটা কী? নিমিষেই অনকে কিছু করতে ফেলার পারার কারণে কি আগের চেয়ে এখন কি বেশী অবসর সময় পেয়েছে মানুষ? তা তো মনে হয় না। ঘড়ির সেকেন্ডের নয় এক্কেবারে ন্যানোসেকেন্ডের কাঁটায় জীবন তুলে দেবার পরও বরং মনে হচ্ছে, নেই কারো কোনো তিলার্ধ অবসর! সারাক্ষণই অদৃশ্য একটা চাপ নিয়ে ঘুরছি আমরা। ফলে কালেভদ্রে যখন চাপহীন কিছুটা অবসরের মুখোমুখি হয় কেউ, সেটাকেই অসহ্য অসহনীয় মনে হয়। মানে নিতে পারি না আমরা সেই চাপহীনতার চাপ। তাহলে দিন শেষে লাভটা হলো কী, এতে আমাদের? গোটা মানবসমাজের? সামান্য অবসরের চাপহীনতার নিদারুণ চাপেই তো দেখি হাঁসফাঁস করে সবে!

লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাদকাসক্তি প্রতিরোধে চাই সামাজিক সচেতনতা
পরবর্তী নিবন্ধমানুষের জীবনে মূল্যবোধ ও কীর্তি