দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৯ জুন, ২০২২ at ১১:১৬ পূর্বাহ্ণ

চাপহীনতার নিদারুণ চাপ-১

কিন্তু না তাও তো ঠিক না। ত্রয়ী শব্দে তৈরি অঘটনঘটনপটিয়সীতে চমৎকার ছন্দ থাকলেও, অঘটন শব্দটাতো ঋণাত্মক। অঘটন কে কি কেউ ভাল চোখে দেখেছে কভু? তবে আজকালকার ঐ ডিসরাপ্টিভ ইনোভশেন যা করছে, কেউ মানুক তা আর না মানুক, আখেরে কিন্তু তাতে তাই ই হচ্ছে। মানে ঘটছে অঘটন। আজকালকার এইসব নানান আবিষ্কার প্রতিনিয়তই যা করছে, তাতে তো পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, কারো পৌষমাস আর কারো সর্বনাশ অবস্থাই দাঁড়াচ্ছে! যেই ই নতুন টেকনোলজি বা ধ্যানধারনা নিয়ে জয় করতে পারছে ভোক্তাদের, তার জন্য তো তা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যাকে বলে পোয়াবারো অবস্থা। ফলে রাতারাতি হচ্ছে সে/তারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। আর যারা ছিল একসময়ে আগের টেকনলজি ও ধ্যানধারনা নিয়ে বাজারে দোর্দণ্ড প্রতাপে, খাচ্ছে মার তারা বেঘোরে। এমনকি তারা বুঝতেও পারছে না ঘুণাক্ষরেও আসছে কোন দিক থেকে সেই আন্ধাইরা প্রাণহরা মাইর!

এই যেমন বছর কয়েক আগেই নোকিয়া বা ব্ল্যাকবেরি নামের কোম্পানি দুটো, কী রাজটাই না করছিল সারা বিশ্বজুড়ে! কিন্তু হঠাৎ করেই যে তারা মুখোমুখি হবে সেই আন্ধাইরা মাইরের, তাও কিনা অ্যাপল নামের কম্পিউটার কোম্পানির ছোঁয়াযন্ত্রের কাছে, ঘুণাক্ষরে মনে হয় ভাবেনি তারা। এই জিনিস যে তাদের শুধু মেরেই ফেলবে না জানে, একই সাথে ঠুকে দেবে এক্কেবারে শেষ পেরেকটিও তাদের কফিনে এটাও সম্ভবত ছিল তাদের কল্পনাতীত। ছোয়াযন্ত্রের আবিষ্কারের টেকনলজি শুধু যে ফোনসেট কোম্পানিরই বারোটা বাজিয়েছে তা তো নয়। তার কাছে বেহুদাই বেঘোরে মার খেয়েছে ক্যামেরা কোম্পানি, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি এমনকি টেলিভিশন কোম্পানিও। সেদিক থেকে তো এ আবিষ্কার কে অঘটনঘটনপটিয়সী না বলে আর উপায় কী? যদিও পুঁজিবাদের তীব্র প্রতিযোগিতা না বলা উচিৎ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অবস্থায়, এ ঘটে আসছে সেই শিল্পবিপ্লবের শুরু থেকে না হলেও বলা চলে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের কাল থেকেই, তবে তখনো কোনো কোম্পানি এখনকার মতো এমন আচমকা আন্ধাইরা মাইর খেত না। তখনকার আবিষ্কারগুলোও কী তবে ছিল না এমন যুগান্তকারী অঘটনঘটনপটিয়সী।

নাহ থাক তোলা ঐ অনুবাদ বিষয়ক চিন্তা। আমার মতো আদার ব্যাপারীর কাজ নয় ওটা। এমনিতেই এসব যাদের কাজ, সেই বাংলা একাডেমির বিশেষজ্ঞরাই যখন, নানাসময়ে দু একটা বানান নিয়ে একটু আধটু ঘষামাজা শুরু করেন, তখনই তো দেখি সহস্র লক্ষ কণ্ঠ আজকাল তাদের মুণ্ডুপাত করে নিজেরাই একেকজন দিগগজ ব্যাকরণ আর বানান পণ্ডিত হয়ে যায়। সে জায়গায় আমি কোন জায়গার কোন হরিদাস পাল। থাকুক ওসব তবে তোলা বিশেষজ্ঞদের জন্যই।
বরং আশার কথা হল এই যে, বেশ অগ্রগতি হয়েছে লাইনের মধ্যে আমার অবস্থানের এরই মধ্যে ভাবতে ভাবতে, ফের লাইনটির নড়াচড়ার গতির সাথে তাল মিলিয়ে সামনে এগুতে এগুতে বকের মতো মাথা উঁচু টান করে দেখলাম যখন সামনে আছে মাত্র চারজন বড়ই আশ্বস্ত হলাম! জানি না পার হয়েছে এরই মধ্যে কতো মিনিট। এ বরং ভালই হল চিন্তার ডুবসাতারে থাকায় অপেক্ষার বিরক্তিটা ঝাপটে ধরার ফুরসৎ পায়নি তেমন।

“বাবা! বাবা! এতো দেরী করছ কেন? তোমরা আসছ না কেন? ওহ এখনো খাবারই নিতে পারো নি! ভাইয়া কোথায়? ”

ম্যাক আউটলেটের সপ্তম আসমান মানে উপরের তলায় ক্ষুধা নিয়ে অধির অপেক্ষায় থাকা অভ্র অতিষ্ঠ হয়ে নীচে নেমে এই লাইনে আমাকে খুঁজে পেয়ে জানান দিল তার তুমুল হতাশা।

আর বেশিক্ষণ না বাবা। কপালগুণে এই মুহূর্তেই ফের এগুতে পারলাম আরেক মানুষ, কারণ তখনি সামনের জন এগুলো সামনে। তাকে অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে ছোটপুত্রকে চাঙ্গা করার জন্য বললাম, এই তো তুমি আসতে না আসতেই আরেকটু এগুতে পারলাম। তুমি এই ফাঁকে বরং ভাইয়াকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসো এইখানে। তুমি আসাতে ভাল হয়েছে, খাবারের ট্রেগুলো তিনজনে মিলে নিয়ে যেতে পারবো।

‘ওহ অভ্র তুমি চলে আসছো? চলো চলো তোমাকে একটা মজার জিনিষ দেখাই!’ এখানকার এই ভিড়ে এতোক্ষণ দীপ্র কোথায় ছিল তা না জানলেও, মাটিফুঁড়ে এমুহূর্তে সে হাজির হয়ে অভ্রকে হাত ধরে টেনে পেছনে ফেলে আসা সেই ছোঁয়াপর্দা গুলো মানে কাউন্টারে না গিয়েও যেগুলো দিয়ে খাবারের অর্ডার করে দামও মিটিয়ে ফেলা যায়, সেই দিকে নিয়ে যেতে উদ্ধত হতেই; উৎসাহ দিয়ে বললাম ঠিক আছে অভ্রকে ওটা দেখিয়ে দুজনেই চলে এস তাড়াতাড়ি। আর বেশিক্ষণ লাগবে না আমাদের খাবার পেতে।

আমার কথায় একদিকে যেমন দীপ্রর উৎসাহ গেল বেড়ে, অন্যদিকে অভ্রও ক্ষণিকের জন্য ক্ষুধা ভুলে উৎসুক হয়ে উঠল, কী এমন জিনিস ওটা তা দেখতে যেটা ভাইয়া দেখে ফেলল এরই মধ্যে, যা সে মিস করেছে। তড়িঘড়ি দুজনে নিষ্ক্রান্ত হতেই মনে হল, যাক এতে অন্তত অপেক্ষার যেই যন্ত্রণা, তা থেকে এই দুই ক্ষুধার্ত শিশুর কিছুক্ষণের জন্যে হলেও মিলল নিষ্কৃতি।

ম্যাককাউন্টার ক্রেতাপিছু গড়ে তিন মিনিট করে সময় নিলেও এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে কমপক্ষে মিনিট ছয় বা সাত, কারণ আমি আছি এখন কাউন্টার থেকে দেড় মানুষ দূরে, যার একজন এ মুহূর্তে সামনে দাঁড়িয়ে, আরেকজন কাউন্টারে অর্ডার দেয়া শেষে দাম মিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার খাবার নেবার অপেক্ষায়। এমতাবস্থায়ও ধারে কাছেও, এমন কি পেছন ফিরে ঐ ছোঁয়া পর্দাগুলোর কাছেও পুত্রদের টিকিটিরও দেখা না পেয়ে কেন যেন স্থান কাল পাত্র ভুলে সবাইকে সচকিত করে, একটু উঁচু গলাতেই ডাক দিয়েই, সামলালাম নিজেকে দ্রুত। এদিকে লাইন ছেড়ে তাদের খুঁজতে গিয়ে আবার লাইনের লেজে দাঁড়ানোর মানেও হয় না। আবার যতোটা গলা উঁচু করে ডাকলাম একটু আগে তারচেয়ে গলা বেশী উঁচু করে ডাকাটাও মোটেও শোভন হয় না, এই বিদেশের মাটিতে অচেনা লোকের ভিড়ে।

এদিকে ঠিক সামনের জন তখন এগিয়েছে কাউন্টারে, যার মানে হল অচিরেই ডাক পড়বে আমারও। বিরক্তির ব্যারোমিটারে চাপ বাড়লেও, তা উপেক্ষা করার জন্য, ভ্রু কুঁচকে কাউন্টারের উপরে লাগানো মেনু গুলো দেখছি যখন একমনে ঠিক তখনি পুত্রদ্বয় পাশে দাঁড়াতেই কোথায় ছিলে তোমারা? বলে স্বরে কিছুটা বিরক্তি উগড়ে দিতেই, দীপ্র জানাল যে এরই মধ্যে ওরা রেস্ট রুম খুঁজে তা থেকে মাতৃআজ্ঞা মতো হাত ধুয়ে এসেছে।

লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুতুল ঘরের বাবা
পরবর্তী নিবন্ধস্বাধীনতা, উন্নয়ন ও নারীর অগ্রগতি