দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৮ মে, ২০২২ at ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

আছে আলো সুড়ঙ্গের ওপাশে

হ্যাঁ এই সুড়ঙ্গ পথে ক্রমশ বাড়তে থাকা ভিড়ের সাথে হাঁটতে গিয়ে গত কয়েক দিনের মধ্যে প্রথম বারের মতো মনে হল যে, আসলেই এসেছি এ গ্রহের বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশে! একসাথে এতো লোক একজায়গায় দেখিনি তো এর আগে গত ক’দিনে, দেখা যায় যা আমাদের দেশে অহরহ যে কোন জায়গায়। ঢাকার এমনকি খালি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কেউ, ‘লাগ, ভেল্কি লাগ’ বলে হঠাৎ জোরে হাক দিলেও তো নিমিষেই চারপাশে তার জমে যাক দু চার শো লোক। সে রকম জন সমাগমের ব্যাপার খুব একটা নজরে পড়েনি এখানে এ পর্যন্ত। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল শুধু কুনমিংয়ের দিয়াঞ্চি লেইকের পাড়। প্রথম যেদিন সকালে গিয়েছিলাম ওখানে সবাই মিলে, সেদিন সেই লেইকপাড় জুড়ে যেমন অনেক মানুষ দেখেছিলাম, তেমনি সেই মানুষ জনের মাথার উপরে উড়তে দেখেছিলাম অসংখ্য গাংচিল। আর আজ এই সুড়ঙ্গ পথে সবাইকে নিয়ে এগুতে এগুতে উঁকি মেরে সামনের মানুষদের মাথার উপর দিয়ে আরো সামনে চোখ ফেলতেই নজরে পড়ছে সামনের দিকে এগুতে থাকা অনেক অনেক চলন্ত মুণ্ডু ,তাতে মনে হল যেনোবা ইদ মৌসুমে সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালের ব্রিজের ভিড়ের অংশ হয়ে বুঝি হাঁটছি চাঁদপুরগামি লঞ্চ ধরার জন্য।
অবশ্য বাইরে ওরকম অসহনীয় হিমের ঝাপটা না থাকলে, এতো লোক এসে এই সুড়ঙ্গের পথ ধরত কী না তা কে জানে? সামনের দিকে তাকিয়ে সুড়ঙ্গের সাথে সাথে এক্ষনে এঁকেবেকে অগ্রসরমান দীর্ঘ এই মানব মিছিলটিকে দেখে মনে হল, ড্রাগনরাজ্যের কোন বিশাল ড্রাগন বুঝি বেরুতে চাচ্ছে তার গর্ত থেকে! নানান জনের গায়ে চড়ানো নানান রঙয়ের ভারি শীতবস্ত্রের কারণে, ড্রাগনের দীর্ঘ শরীরটিকে ছোপ ছোপ নানা রঙয়ে রাঙ্গানো মনে হচ্ছে। যে ড্রাগনের শরীরের অংশ হয়ে এগুচ্ছি আমরা পাঁচ বঙ্গসন্তান। এখানকার ওম ওম আরামে হাঁটতে হাঁটতে এ মুহূর্তে ভাবতেও পারছি না যে , যদি দেখা না পেতাম এই সুড়ঙ্গ পথের মুখ, কি করতাম তাহলে?

পারতাম কি সবাইকে নিয়ে বাইরের হাড়হিম না শুধু এক্কেবারে হাড় ছিদ্র করে বেড়িয়ে যাওয়া বাতাসের ঝাপটা খেতে খেতে এগিয়ে যেতে? অতএব কেউ যদি ইচ্ছা করে কখনো গর্তে ঢুকে যায়ও বা ভুলে কোন গর্তে পড়ে যায়ও, সেটিকে তো নেতিবাচক অর্থে নেয়া ঠিক না। বাইরের খোলা তিয়েন আন মেন প্রান্তরের তুলনায়, এই সুড়ঙ্গ তো এক্কেবারে স্বর্গসম!

“বাবা, এখান থেকে বেরুলে,বাইরে কি ম্যাক পাওয়া যাবে?” ডান পাশ থেকে কানে আসা অভ্রর এই অনুচ্চ প্রশ্ন পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলে যে পুত্রের আমার খিদে পেয়েছে।

তা তো জানি না ! তবে যদি পেয়ে যাই তা হলে কি আগে ওখানেই ঢুকতে চাও নাকি খেতে, জিজ্ঞেস করলাম : ‘হুম।’
ঠিক আছে আগে বেড়িয়ে দেখি এই টানেল থেকে। অভ্রকে আশ্বস্ত করে দিলাম ভাসিয়ে গা ফের যাকে বলে গড্ডালিকা প্রবাহে । তার মানে এগুতে থাকলাম ভিড়ের সাথেই, কারণ এর মধ্যে বার কয়েক আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে এবং বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম যে , যাচ্ছি কি না ঠিক দিকে। কিন্তু কোন ধরনের দিকচিহ্ন বা সাইন দেখতে না পেয়ে , সামনের লোকজন যেদিকে যাচ্ছে সেদিকটাতেই আছে গন্তব্য আমাদের, তা ধরে নিয়েই এগুতে লাগলাম। আপাতত আমার সবচেয়ে বড় স্বস্তি আর সাফল্যের ব্যাপার তো হল এই যে, সবাইকে বাঁচাতে পেরেছি বাইরের ঐ তীব্র হিম যন্ত্রনা থেকে।

এসময় ভিড়ের অংশ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবারও ক্ষনিকের জন্য থেমে পায়ের আঙ্‌গুলের উপর ভর করে সামনের চলমান মাথাগুলোর আরো সামনে কি আছে বোজার জন্য উঁকি দিতেই, সুড়ঙ্গের বাইরে দেখে আসা ধোঁয়াশায় মোড়ানো আবছা আলোর আভাস নজরে আসলেই, আওড়ালাম মনে মনে, নাহ আছে আলো সুড়ঙ্গের ওপাশে!

যদিও এই সুড়ঙ্গটি বৈদ্যুতিক আলোয় যথেষ্টরকমই আলোকিত, তারপরও বাইরের ঐ প্রাকৃতিক আলোর আভাস হউক না তা যতই ধোয়াশায় মোড়া তা চোখে পড়তেই বেশ পুলকিত বোধ হল। তাতে সাথে সাথেই নিজের সেই পুলক সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে জানিয়েও দিলাম যে, আর দেরী নয় খুব, অচিরেই দেখা হবে চেয়ারম্যান মাওয়ের সাথে, মানে তার সংরক্ষিত দেহের সাথে । অচিরেই বেরুবো আমরা এই সুড়ঙ্গ থেকে।

কিন্তু সুড়ঙ্গের বাইরে এসে পা রাখার পর, মনে মনে যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখা স্বত্বেও হিম হাওয়ার জোর একটা ধাক্কা মুখের খোলা অংশ আর দস্তানাহীন করতল আর আঙ্‌গুলে লাগতেই এক্কেবারে হকচকিয়ে গেলাম। আর তারপরপরই কী না যাকে বলে এক্কেবারে মাথার উপর ভেঙ্গে পড়লো গোটা আকাশ! ডানে বাঁয়ে সামনে তাকাতেই মনকে ঝাপটে ধরল তুমুল সন্দেহ , এসে পড়েছি কি তবে সবাইকে নিয়ে কোন এক ভিন্ন জায়গায়?

পাত্তা দিলাম না নিজ মনে হঠাত ঘাই দিয়ে উঠা সেই সন্দেহ কে। সেটিকে জোর করে মন থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে , তাকালাম বা দিকটায়। আমার ধারণা মতে মাওয়ের দেহ ধারণ করে থাকা সেই পুরানো চায়নিজ আদলে তৈরি লাল দালানটি থাকার কথা এই সুড়ঙ্গ পথের বা দিকেই । গোটা বা দিকটার আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে দেখেও সেই বিখ্যাত লাল দালানটির টিকিটিরও দেখা পেলাম না। এমনকি ঐ দালান তো নয়ই, অন্য কোন দু বা তিন তলা দালানও নজরে এলো না। মনে হচ্ছে কেউ যেন বুঝিবা ভোজাবাজির কেরামতিতে ঐ জায়গা থেকে এক্কেবারে হাওয়া করে দিয়েছে শত শত বৎসরের ঐতিহ্য ধরে রাখা সেই দালানটি। তার বদলে বাঁয়ে যা নজরে এলো, তা হলো এক তলা একটা লম্বা স্কুলঘর মার্কা স্থাপান, যেটিতে পর পর সারি সারি করে সাজানো আছে ছোট ছোট দোকান পাঠ। যার আবার বেশির ভাগেরই ঝাপ ফেলা। ডান দিকেও নজরে এলো ঐ একই দৃশ্য। আর নাক বরাবর সামনে দেখছি একটা অবারিত খোলা মাঠ। তবে নিশ্চিত এ মাঠ তিয়েন আন মেন স্কয়ারের মাঠ কিম্বা সেটির অংশও নয়। কিংকর্তব্যবিমুঢ় না কি হতচকিতভাবে দেখছি যে চোখের সামনে, তা হল মোটামুটি চৌকোনা ধরনের একটি মাঠ। যার তিন দিক ঘিরে আছে ছোট ছোট দোকানঘর। ফলে মনে হচ্ছে এসে পৌঁছেছি বুঝি কোন মার্কেটে। যদিও মার্কেটের বেশীর ভাগ দোকানদারই মনে হচ্ছে আছে এ মুহূর্তে ব্যবসা গুটানোর ধান্দায়। কিন্তু কি কারণে এই দুপুর বেলাতেই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার এই তোড়জোর ঠাহর করতে পারছি না তা! তবে বাতাসের তোড় যে বেড়েছে অনেক টের পেয়ে গেছি তা।

“কি ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছ কেন। যাবে না ঐ যে কোথায় যেতে চেয়েছিলে সেখানে? ওখানে গিয়ে একটু বসতে হবে। সারাক্ষণই তো হাঁটার উপর ছিলাম পা ব্যথা করছে “লাজুর এই কথার পিঠাপিঠি বলে উঠল হেলেনও- “ওহ দাদা! ঠাণ্ডা তো এখন আরো বেড়েছে মনে হয়। চল তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ি কোথাও। দাঁড়ানো যাচ্ছে এখানে।

দলের দুই মহাপরাক্রমশালির এই তাড়ায় কি বলব বুঝে উঠতে পারছি না। এমনিতেই তুমুল ঠাণ্ডার প্রাথমিক ধাক্কায় ভির্মি লেগে গিয়েছিল সমস্ত অস্তিত্বে, তার উপর যখন বুঝতে পারলাম এসে পৌঁছেছি ভুল জায়গায় তাতে এক্কেবারে বেকুব বনে গিয়েছিলাম। আর এ মুহূর্তে কী করণীয় তা নিয়ে মগজের ভেতরে নিজের সাথে নিজেই করছিলাম নানান জল্পনা কল্পনা। কারণ হাতে আছে অন্তত তিন তিনটা বিকল্প -প্রথমত, উল্টা ঘুরে ফিরে যেতে পারি সে সুড়ঙ্গে ফের, সেই লালঘরের সঠিক রাস্তার খোঁজে। তাতে এই ঠাণ্ডা থেকে বাঁচা গেলেও যে ঠিক ঠিক জায়গায় পৌঁছুতে পারব তার তো নিশ্চয়তা নেই। আবার পেছনের এই সুড়ঙ্গ মুখটি তো মনে হচ্ছে একমুখী, মানে এদিক দিয়ে শুধু নিষ্ক্রান্তই হওয়া যাবে। কারণ কাউকে তো এদিক দিয়ে ঐ সুড়ঙ্গে ঢুকতে দেখলাম না। অতএব বাদ গেল সে বিকল্প- যা আছে কপালে, একদম পড়িনি তো আর অকুল পাথারে। অতএব পিছাবো না হউক যা, যাবো সামনেই এগিয়ে । হতে পারে এটি দ্বিতীয় বিকল্প।
আর তৃতীয় বিকল্প হল, ফোন করে আমাদের শোফার লি খাঁ কে ডেকে এনে তার নির্দেশনায় পথ চলা।

একটু আগে দেয় দ্বৈত তাড়ার জবাবে কোন জবাব না দিলেও এরই মধ্যে অনিশ্চিতভাবে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি এমন একটা ভাবে, যেনবা হয়নি কিছুই । কিন্তু মনে মনে ইয়া নফসি ইয়া নফসি আওড়াতে আওড়াতে, জ্যাকেটের বুকের কাছে ভেতরের দিকের পকেটে রাখা হাতফোনটি বের করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যখন দেখলাম সকালের মতো ঐটি ভির্মি খেয়ে বন্ধ হয়ে যায়নি।

অতএব এমতাবস্থায় ঐ তৃতীয় বিকল্পকেই সম্ভাব্য উত্তম সিদ্ধান্ত ধরে নিয়ে লি খাঁ কে ফোন করতে গিয়েই মনে হল, আচ্ছা বলব কি তাকে?
কিভাবে ওকে বোঝাই যে আছি এ মুহূর্তে কোথায়? আজই সকালে হোটেলের আঙ্গিনায় তার সাথে দেখা হবার পর থেকে গ্রেট হল অবধি আসা পর্যন্ত, কথা আমি যাই বলেছি মুখে, তাকে তা বোঝানর জন্য তো হতে হয়েছিল নিজেকে বিশ্বখ্যাত মুকাভিনেতা পার্থ প্রতিম মজুমদারের অক্ষম সাগরেদ। তাতেও যখন কাজ হচ্ছিল না, তখন সেই ই তো ধরিয়ে দিয়েছিল আমার হাতে তার দোভাষী হাতফোন! যাতে ইংরেজি কিছু লিখলে সেটি তা সাথে সাথে চায়নিজে অনুবাদ করে দিচ্ছিল । এমতাবস্থায় শোফারকে এখন ফোন করে কি করে বুঝাই যে , একাকী নয় এক্কেবারে দলে বলে সকলকে লইয়ায় আমি পথ হারাইয়াছি। আর পথ হারাইয়া যে কোন অরন্যে আসিয়া পৌঁছাইয়াছি তাহাও জানি না। তদুপরি একদিকে আমিও নব কুমার নই, আর আশেপাশে কোন চায়নিজ কপালকুণ্ডলাকেও দেখিতেছি না, যে জিজ্ঞাসা করিবে “পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?”

অনিশ্চিত ভাবে হলেও দৃপ্তপদে সামনে এগুনো বজায় রেখে, একটু আগে যেই তৃতীয় বিকল্পটি বেছে নিয়েছিলাম অবলীলায় তা বাতিল করে, করলাম ফোন দ্রুত রিজেন্ট হোটেলের সেই কন্সিয়ার্জ কন্যা মিস রিনাকেই।

একবার, দু বার, তিন বার রিং বাজল ! কিন্তু ওপাশে ধরছে না মিস রিনা, তাতে বুকের থুক পুক যখন দুম দুমে পরিণত হতে যাচ্ছে তখনি চিকন সুরেলা গলায় ওপাশ থেকে ভেসে এলো -“ইয়েচ মিস্তার । হোয়াত কেন আই দু।”

আনন্দে আটখানা আমি বলতে যাচ্ছিলাম, বুঝিলে গো কপালকুন্ডলা, কপাল আমার পুড়িয়াছে। সকলকে লইয়া আমি পথ হারাইয়াছি ধোঁয়াশায় ঢাকা তিয়েন আন মেন স্কয়ার থেকে বেরিয়ে অজানা কোন জায়গায়।

নাহ, তা আর করলাম না। বরং খুব ধীরে সুস্থে মাথা ঠাণ্ডা করে আস্তে আস্তে একটি একটি করে ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করে বললাম যে এ মুহূর্তে আমি কোথায় আছি তা বুঝতে পারছি না।

লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বস্ত এক ভরসার জায়গা মা
পরবর্তী নিবন্ধরেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট মানবসেবায় অনন্য