দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৩ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ

অপমানের শতক বা শত বছর

নাহ মনে মনে এসব ভাবলেও নিজের শনি নিজে ডেকে না আনার ব্যাপারে প্রবল সতর্ক অবচেতনের বাধায় সে সবের কিছুই না বলে বরং দুপুত্রকে দু হাতে ধরে সামনে এগুতে এগুতে সবাই যাতে শুনতে পায় ওরকমভাবেই জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা দীপ্র, অভ্র তোমরা এই ড্রাগস নিয়ে জানলে কোত্থেকে? ড্রাগস কি রকম জিনিস তা কি জানো?
“কেন টিভির ফিল্ম থেকে!” একথা বলেই টুক করে অভ্র জানান দিল, আগে মুখ না খুললেও এ বিষয়ে সেও পিছিয়ে নেই ভাইয়ার থেকে।
হুম তা বুঝলাম। কিন্তু ড্রাগস জিনিসটাকে কেমন মনে হয় তোমাদের, তা তো বললে না।
“ভেরি ব্যাড এন্ড ইল্লিগ্যাল।”
“একদম বাজে। ওসব খারাপ মানুষেরা খায়। খেয়ে মারামারি করে”
দুই ভাইয়ের দ্বিভাষিক এই জবাব পেয়ে বললাম যে, আফিম হল ঐসব যাবতীয় অত্যন্ত খারাপ এবং ভয়ংকর জিনিসের বাবা মা। মানে এই আফিমের বীজ থেকেই নানা ভাবে তৈরি হয় ভয়ংকর সব নানান ড্রাগস। ঐসব ড্রাগস যারা খায় বা নেয় তারা নিজেরাও কিন্তু ড্রাগসের কারণে নানান কঠিন অসুখে ভুগে মরে যায়
“জানি, জানি” যুগপৎ জবাব দু’জনের!
“ড্রাগস নিয়ে ড্রাগস ডিলাররা নিজেরা যে মারামারি গোলাগুলি করে বা পুলিশের সাথে মারপিট করে সেটাই কি আফিম যুদ্ধ নাকি?” এবার দীপ্রর করা এই প্রশ্নে বুঝলাম, যে নাহ ফিল্মের কারণে ভালই জ্ঞান লাভ করেছে এ বিষয়ে ওরা। আর আমার সাথে যতো না ফিল্ম দেখে ওরা, তার চেয়ে ঢের বেশী দেখে ওদের মায়ের সাথে। অতএব তাত্ত্বিক দিক থেকে অবশ্যই বলা যায় যে, সিনেমার মাধ্যমে ওদের মায়ের সাথে বসেই পেয়েছে ওরা ড্রাগসের সবক। আর তা যদি বলিও তবে খুব একটা ভুল হবে না।
অতএব ভাবলাম একটু আগেই খাওয়া মুখ ঝামটার জবাব দেই এই মাত্র লাভ করা তাত্ত্বিক জ্ঞান দিয়ে, সাথে সাথেই মনের দ্বিতীয়জন বলল, কি দরকার নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার, বাছা? জানো না এ জগতে সকল সময় সকলের সকল কথা তো কানে তুলতে নেই। আর কানে গেলেও সব কিছু মনে নিতে নেই। আবার মনের অজান্তে মনে তা নিয়ে নিলেও জবাব দিতে নেই। আর সংসারে শান্তি রক্ষার জন্য স্ত্রীদের যে কোন কথারই জবাব দিতে নেই, তা কি তুমি জানো না?
“বাবা তাহলে কি চায়নিজ ড্রাগ ডিলার আর ব্রিটিশ ড্রাগ ডিলাররা যুদ্ধ হয়েছিল চায়নায়? সেটাই কি আফিম যুদ্ধ নাকি? “ সামনে এগুতে এগুতে আশেপাশে সাজিয়ে রাখা আফিম যুদ্ধের নানা ছবি, পেইন্টিং আর আফিম সেবনের যন্ত্রপাতি দেখতে দেখতে ফের কৌতূহল দীপ্রর-ঠিক ওইরকম না। যুদ্ধটা হয়েছিল চায়নিজ সম্রাটের সৈন্যবাহিনীর সাথে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, মানে যারা আমাদের দেশ দখল করে রেখেছিল, দুইশত বছর ধরে, সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশের কৃষকদের মেরে পিটিয়ে নীল চাষ করাতো যেমন, তেমনি আফিমও চাষ করাতো। তারপর সেই আফিম জাহাজ ভর্তি করে চায়নায় এনে বিক্রি করতো, এই ধরো আজ থেকে প্রায় দেড় দুইশ বছর আগে তো সেবার চায়নার সে সময়ের সম্রাট , ব্রিটিশদের সেই আফিম ভর্তি জাহাজ আটক করে, চায়নায় আফিম বিক্রি নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। তাতে ব্রিটিশ মহারানী ভিক্টোরিয়া মহা রেগে গিয়ে, তার নৌ বাহিনী পাঠিয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিল চায়নার সাথে! “এটা কেমন কথা? ব্রিটিশ রা তো খুব বাজে!” হাঁটা বাদ দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একই সঙ্গে অবাক ও তুমুল বিরক্ত দীপ্র ঘোষণা করে জিজ্ঞেস করল “আফিম যুদ্ধে কে জিতেছিল ?”
ব্রিটিশরা জিতেছিল।
“বাবা,বাবা এগুলো কি আফিম যুদ্ধের ছবি। ইটস হরিবল” একটু এগিয়ে থাকা অভ্র এসময়ে দেয়ালে লাগানো একটা পেইন্টিং এর সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করতেই সাথে সাথে ওর মা আর ফুপ্পিও সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে সেই ছবির দিকে নজর দিয়ে-“কি ভয়ংকর। এক্কেবারে ১৯৭১ যা করেছিল পাকিস্তানিরা আমাদের দেশে ঐ রকম মনে হচ্ছে “বলল হেলেন
“নাহ এসব দেখার দরকার নাই। চল চল এখান থেকে বেরিয়ে যাই তাড়াতাড়ি “বলেই অভ্রর হাত ধরে টেনে তাগাদা দিল লাজু-কিন্তু নাহ পুত্র নট নড়ন চড়ন হয়ে গভীরভাবে সে শিপ্লকর্মটি দেখতে দেখতে ফের জিজ্ঞাসা করল “বাবা এটা কি আফিম যুদ্ধের ছবি?”
কাছে গিয়ে স্তূপীকৃত মানুষের লাসের ছবিটির নীচের দিকটার প্লেটে লেখা পঠনযোগ্য অংশ পড়ে জানালাম ওদের যে এটা আফিম যুদ্ধের ছবি না। এটা হল নানজিং গণহত্যার ছবি। আর এটি চালিয়েছিল জাপানিজরা।
“কি বলছ? জাপানিজরা না কতো নম্র ভদ্র জাতি! এরা এমন করেছে এখানে?” অবিশ্বাসের ঘোষণা লাজুর কণ্ঠে
এখানে তো তাই লেখা আছে। আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আনবিক বোমা খাওয়ার আগে জাপানিরা তো ভয়ংকর ছিল। তারা যে হিটলারের সাথে হাত মিলিয়েছিল এ তো ঐতিহাসিক সত্য। আজ না হয় দেখছো তারা কথায় কথায়, নামাজের রুকু দেবার মতো করে বাও করে যে কাউকে। একসময় এই জাপানিজরা কি রকম হিংস্র আর ভয়ংকর ছিল, এটা চায়নিজরা আর কোরিয়ান জানে হাড়ে হাড়ে, যেমন আমরা জানি ঐ ফাকিস্তানি হানাদারদের-নাহ এই ছবিটা বেশিক্ষন সহ্য করা দেখছি আসলেই কষ্টকর। অতএব সবাইকে নিয়ে বা দিকে ঘুরে হল ঘরটার অন্য দিকে অল্পকিছু যে ভাস্কর্য গুলো আছে সেদিকে এগুতে এগুতে পুত্রদের বললাম, বুঝেছ ১৮৪০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৫০ সালের আগ পর্যন্ত ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান এইসব দেশ চায়নাকে আক্রমণ করে তাদের কে মেরে কেটে , জোর জবরদস্তি করে ব্যাবসার নামে যে লুটতরাজ চালিয়েছিল চায়নায়, শেই সময়টাকে চায়নিজরা বলে “সেঞ্চুরি অব হিউমিলিয়েশন” অর্থাৎ “অপমানের শতক বা শত বছর”। মিউজিয়মের এই ঘরটা হল সেই সময়ের নানান কিছু দিয়ে সাজানো । আচ্ছা বলো তো এরা এসব জিনিষ এভাবে সাজিয়ে রেখেছে কেন?
“যারা ঘুরতে আসে সবাই এই মিউজিয়াম, তারা যেন জানতে পারে, বুঝতে পারে সে জন্য রেখেছে” -হ্যাঁ তা ঠিক। তবে এখানে কি খুব বেশী বিদেশী দেখেছ? চায়নিজরাই তো ঘুরছে বেশী। আর ঐ যে দেখ, ঐ পাশটায় ঐ বাচ্চা গুলোর মাঝে দাঁড়িয়ে যে চায়নিজ মহিলা কিছু বলছেন হাত পা নাড়িয়ে, নানান কিছু দেখিয়ে, উনি হয়তো ওদের টিচার। উনি বাচ্চাদের বোঝাচ্ছেন কেমন ছিল চায়নার আগেকার অবস্থা। দীপ্রর উত্তরের জবাবে এ কথা ক’টি বলতে বলতে দেখলাম ছোটপুত্র বলছে না কিছুই। মুখ বেশ থমথমে! এইমাত্র যা কিছু বললাম, তারও কিছু কানে গেছে কি না ওর কে জানে ? বিরস বদনে এক মনে চুপচাপ ভাবছে কিছু সে -কি অভ্র বাবা? ভাবছ কি তুমি? কিছু বলছ না কেন?
“আমার খুব খারাপ লাগছে বাবা! জাপানিজ ওয়ার টু ব্যাড!” একরাশ হতাশা ঝরে পড়ল ছোটপুত্রের কণ্ঠ থেকে
বুঝলাম টিভিতে নিয়মিত জাপানিজ কার্টুন দেখে দেখে, জাপানি খাবার সুশি সাসিমির ভক্ত হয়ে ওঠা অভ্র বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে মনে, জাপানিজদের এহেন নৃশংসতার জাজ্বল্যমান প্রমাণের মুখোমুখি হয়ে। অতএব ওর মন ভাল করার জন্য ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম -শোন বাবা, একসময় কেউ খারাপ থাকলে পরে ভুল বুঝতে পেরে, সে যে ভাল হতে পারবে না, তা তো না। এসবই অনেক আগের কথা। জাপানিজরা কিন্তু এখন খুবই ভদ্র আর নিরীহ জাতিই না শুধু ও অত্যন্ত বুদ্ধিমানও। এসব বলতে বলতে চায়নিজদের অপমানের শত বছরের এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য এগুতে শুরু করলাম ওপাশের দরজার দিকে।
“আচ্ছা আমাদের যাদুঘরে কি ১৯৭১ নিয়ে এরকম কিছু আছে?” পেছন থেকে প্রশ্ন এলো লাজুর-থমকে গেলাম এ প্রশ্নে। কারণ ব্যাপারটি নিয়ে কোন ধারনা নেই। কবে যে শেষ গিয়েছি শাহবাগস্থ আমাদের যাদুঘরে সেটাই মনে করতে পারলাম না। যদিও আব্বার হাত ধরে প্রথম গিয়েছিলাম শৈশবে জাতীয় যাদুঘরে, তারপর শেষ গিয়েছিলাম সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে। আর গিয়েছিলাম সে সময়ে আমাদের দেশের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রানিদের যে সব মমি রাখা আছে তা দেখার জন্য, পরীক্ষায় পাশের প্রয়োজনে যে ফিল্ডওয়ার্ক করতে হয়, সেই শর্ত পূরণ করার জন্য। তবে হ্যাঁ তারপরও গিয়েছি অনেকবারই সেখানে, তবে যাদুঘর অংশে নয় সেটির মিলনায়তন অংশে, নানা অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য। নাহ এবার দেশে ফিরে গিয়ে অচিরেই যেতে হবে সেখানে শুধু যাদুঘর অংশটি দেখতেই।
দ্রুত এসব ভাবতে ভাবতে বললাম , তা তো জানি না। অবশ্য ১৯৭৫ এর পর সরকারিভাবে যেভাবে আমাদের ইতিহাস বিকৃত করা শুরু হয়েছিল তাতে মনে হয় না ওখানে ওরকম কিছু আছে। দেখছ না পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণের স্থানটির মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থানকেও বানিয়ে দেয়া হয়েছিল শিশুপার্ক, আছে যা এখনও! তবে কপাল ভাল যে আমাদের কিছু সাহসি বেসরকারি মানুষের উদ্যোগে গড়ে উঠা মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরটি আছে। ওখানে ১৯৭১ এ হানাদারদের হাতে নৃশংস ভাবে নিহত মানুষের অনেক মাথার খুলি, হাড়গোড় এসবওতো আছে।
“তুমি আবার রাজনীতি টেনে আনছ কেন এর ভেতরে” উষ্মা ঝরে পড়ল লাজুর কণ্ঠে -রাজনীতি টেনে আনলাম কোথায়? যা ঘটেছে তা-ই তো বললাম। আর তা যদি রাজনীতিও হয় তাও কি বলতে মানা নাকি?
এইমাত্র বলা আমার এই কথাগুলোর উত্তর এলো নীরবতায়। অতএব ও নিয়ে কথা আর না বাড়াই। মনে পড়ল দীপ্রর বয়স যখন বছর তিনেক, তখন ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে, তবে অভ্রকে নিয়ে গিয়েছিলাম কি না তা মনে পড়ছে না। অবশ্য ওর ঐ বয়সটায় তো পেশাগত কারনে নিজেই ছিলাম পরবাসী। অবশ্য আমি না নিয়ে যেতে পারলেও, হেলেন নিয়ে যেতে পারে ওখানে। ওদের ফুপ্পি তো নানা সময়ে নানা জায়গায় নিয়ে যায় দুজনকে। আচ্ছা ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করাই যাক না অভ্র তুমি কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে গিয়েছিলে?
“হ্যাঁ , হ্যাঁ নিয়ে গিয়েছি তো ওদের। মনে নাই মনু, পিকাসো?” ভাইপোদের আদর করে ডাকা নামে ডেকে কথা ক”টি বলে নিশ্চিত করলো হেলেন। তাহলে তো তোমরা দেখেছোই কি করেছিল পাকিস্তানি হানাদারেরা আমাদের উপর। আর শোন জাপানিরা এখানে যেভাবে যত মানুষ মেরেছিল, তার চেয়ে ঢের বেশী মানুষ মেরেছিল হানাদারেরা ৭১ এ আমাদের দেশে। নান জিং এ জাপানিজরা সম্ভবত দুই থেকে তিন লাখ চায়নিজদের মেরেছিল, আর হানাদারেরা মেরেছিল তিরিশ লক্ষ বাঙালি, বুঝেছ? ছেলেদের হাত ধরে চায়নিজদের অপমানের শত বছর পেরুতে পেরুতে বললাম ফের
“বাট দ্যাট পেইন্টিং ইজ হরিবল।“ অনুচ্চ কণ্ঠে বলল ফের অভ্র – বোঝা গেল ঐ পেইন্টিংটা একটা জোর ধাক্কা দিয়েছে, পরিবারের কনিষ্ঠ এই সদস্যের ছোট্ট মনে! কে এঁকেছে ছবিটা? আসলে চায়নিজ নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে যে ঝক্কি পোহাতে হয়, তা এড়ানোর জন্য ঐ ছবির নীচে লিখে রাখা, যাবতীয় বিবরণ পড়লেও আঁকিয়ের নামটি চোখে পড়েছে বলে মনে পড়লো না। আর যদি পড়েও থাকি নামটি , তবে এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না! দেখে আসব নাকি নামটা ফের?
নাহ, এগিয়ে গেছিই যখন সামনে এখন আর পিছু হটায় কাজ নেই। নাম জানি আর না জানি, সেই মহান শিল্পী যে তাঁর শিল্পকর্ম দিয়ে ভিনদেশি এক ছোট্ট শিশুর মনে তুমুল আলোড়ন তুলতে পেরেছেন, তিনি তা জানুন আর না জানুন তাতেই ত তাঁর শিল্পীজীবন সার্থক! শিল্পী তাঁর শিল্প দিয়ে এভাবেই তো অতিক্রম করে যান সমাজের আর বাকী সবাইকে, এমনকি বেঁচে থাকেন কাল থেকে কালান্তরে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানবিক দিক বিবেচনায়
পরবর্তী নিবন্ধঅদ্বৈত মল্লবর্মণ: অদ্বৈত জীবনের প্রতিবেদন