দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৯ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৫৮ পূর্বাহ্ণ

সে সন্ধ্যায় নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা মার্কা বোকামির জন্য যতোটা না বিরক্ত হয়েছিলাম নিজের উপর, তারও চেয়ে বেশী ভয়ে ছিলাম পাঠ্য বইয়ে মনোনিবেশ করার জন্য নির্ধারিত সময়ে লুকিয়ে “অপাঠ্য” বই পড়াজনিত আম্মার চোখে বিষম অপরাধ করার পর, সেই অপরাধ ঢাকার জন্য কী না আব্বা যেটিকে ভয়াবহ এবং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচনা করেন যে মিথ্যা বলাকে, উজবুক আমি কী না সেই অপরাধ করে বসেছিলাম! অবস্থা আমার ছিল দুই কূল হারানোর মতই! এমনিতে আম্মা নাকমুখ ডুবিয়ে আমার ‘অপাঠ্য বই’ পড়া বিষয়ক বদভ্যাসের কারণে যতোটা না যতোটা না তাঁর পুত্রের ভবিষ্যৎ সন্ত্রস্ত থাকতেন, সেই একই ব্যাপার নিয়ে আব্বা থাকতেন নির্লিপ্ত। বরং আব্বাই মাঝে মধ্যে গল্পের বই কিনে দিতেন। কিন্তু সে সন্ধ্যায় কি না তাকেও বিগড়ে দিইয়েছিলাম। ফলে পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই অন্যকোন বই পড়া না একদমই নিষিদ্ধ হয়ে যায় তা নিয়েই ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলাম!
কপাল ভাল অচিরেই সেই ধমক আর তর্জন গর্জন পর্ব শেষে, বইটি হাতে নিয়ে কয়েক পাতা উল্টে পাল্টে দেখে সে সন্ধ্যায় আব্বা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোথায় পেয়েছিলাম সেই বই?
একটু আগে মিথ্যা বলে ধরা পড়ে যাবার পরও ফের মিথ্যা বলে দিলাম অবলীলায়, কারণ তখনি মনে পড়েছিল আব্বারই কাছে শোনা সেই ভাল্লুক বিষয়ক গল্পটি; যে গল্পে বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুই বন্ধু হঠাত আগুয়ান এক ভাল্লুকের মুখোমুখি হতেই করিতকর্মা এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে ত্যাগ করে দ্রুত উঠে পড়েছিল গাছে ; ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” মত্রকে আপ্তবাক্য হিসাবে শিরোধার্য করে! যে গল্পের শেষে আবার আব্বাই আপ্তবাক্য হিসাবে বলেছিলেন যে “বিপদে বন্ধুর পরিচয় হয়’’। ওইসময় আব্বার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে সেই আপ্তবাক্যটিই রনি রিন করে বেজে উঠেছিল কানে।
অতএব নিজে যতই ছিলাম না কেন তাগ করা বন্দুকের মুখে, আর বন্ধু আমার যতোই থাকুক না অনুপস্থিত আশেপাশে, তারপরও সেমুহূর্তের সেই সঙ্গিন অবস্থায়ও যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা হল বন্ধুকে বাঁচানো। ভেবেছিলাম নিজে যতোই বিপদে পড়ে থাকি না কেন বোকামির কারণে, সেই বিপদে বন্ধুকে আবার টেনে আনি কেন? ফলে যে বন্ধু তার বড় ভাইয়ের টেবিল থেকে লুকিয়ে বইটি এনেহাতে তুলে দিয়েছিল তার নাম না বলে, বলেছিলাম যে লাইব্রেরী থেকে এনেছি। আর এই লাইব্রেরী হলো সেই লাইব্রেরী যা নাকি আমরা গুটিকয় বালক মিলে মহাউৎসাহে গড়েছিলাম পাড়ায়, নিজেদের সংগ্রহের বই দিয়েই।
কপাল ভাল সেই দ্বিতীয় মিথ্যাটি আর ধরা পড়েনি! সেই জবাব শুনে ততোক্ষণে কিছুটা শান্ত হয়ে পড়া আব্বা নরম গলায় বলেছিলেন, “দেখ এসব বই হল বড়দের বই। এখন এটা তুই পড়ে কিছু বুঝবি না। বড় হয়ে পড়িস।”
আচ্ছা বাবা বলো না “বুর্জোয়া মানে কি?’” একটু আগে করা নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে অসহিসষ্ণু দীপ্রর ফের করা এই প্রশ্ন চকিতে ফিরিয়ে আনলো আমাকে সেই শৈশব থেকে, যেখানে পুত্র হিসাবে অপরাধ করে নিজে অধোবদনে দাঁড়িয়েছিলাম এতোক্ষণ আব্বার সামনে। আর ফিরে এসেই কি না বদলে গেল সেই ভূমিকা নিজের। এখন আমি পিতার পাশে পাশে এই হাড়হিম করা দুমড়ে মুচড়ে দেয়া ঠাণ্ডাতেও অধোবদন না বরং কৌতূহলে উৎসুক পুত্র হাঁটছে পাশে পাশে মাথা উঁচু করেই।
দ্রুত তাই হড়বড় করে বললাম যে, মানে বুর্জোয়া হল তারা, যারা যে কোন সমাজের একদম গরিব মানুষও না, আবার চূড়ান্ত ধনী মানুষও না, ঐ রকম মানুষেরা।
“তাহলে কি তুমি বুর্জোয়া?” মুখ খুলল অভ্র! একই সাথে দীপ্র বলল, “তাহলে কি তারা মিডল ক্লাস”? ‘কি ব্যাপার কোনদিকে যাচ্ছ তোমরা? আমাদের ব্যাগগুলো নিতে হবে না ? না কি ওগুলো সারাদিনের জন্যই ওখানে রাখতে হবে ?’
মাতা পুত্ররা মিলে করা এরকম ত্রিমুখী প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে, মনে পড়লো আরে হ্যাঁ তাইতো, ব্যাগগুলো তো নিতে হবে , যা নাকি ভুলেই গিয়েছিলাম! এতে কিছুটা অপ্রস্তুতও হয়ে পড়লাম দিককানা আমি এই ভেবে যে , আচ্ছা সেই ঘরটা তাহলে কোনদিকে? এ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে কি তা ঠাহর করতে পারবো? আর না পারলে সে কথাই বা কাকে জিজ্ঞেস করবো? এখানে তো কোন জনমনিষ্যির দেখা নাই আশেপাশে। ভরসা তো সেই লি খাঁ ই। ফোনে ডেকে আনব নাকি তাকে?
সাথে সাথে মনের দ্বিতীয় জন বলে উঠলো, না ক্ষণে ক্ষণে এভাবে লি খাঁ কে সমন জারী করার কোন দরকার নেই। বরং দাঁড়িয়ে একটু জরীপ করো, আমার তো মনে হচ্ছে ঐ ডান দিকটায় এগিয়ে গেলেই পাওয়া যাবে সেই ঘরটা।
ফলে নিজের ভেতরের সেই দ্বিতীয় আমির ডাকে সাড়া দিয়ে সপুত্রক দাঁড়িয়ে, পেছন ফিরে একটু বোঝার চেষ্টা করলাম যে, আসলেই কথাটা ঠিক কি না। মানে ঐ ডান দিকেই এগুবো কি না। হাড়হিম করা এই ঠাণ্ডার ধোঁয়াশা ভেদ করে সামনে চোখ যেতেই মনে হল, কথা ঠিকই। ঐ ডান দিকেই হবে সেই ঘরটা। নিশ্চিত হবার জন্য তারপরও দীপ্র কে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা তোমার কি মনে হচ্ছে বলোতো ? এই গ্রেট হলে ঐ ডান পাশের করিডোর দিয়েই কি ঢুকেছিলাম না কি? আর টিকিট ঘরটাও ঐ দিকটাতেই নাকি?
“দাড়াও বাবা একটু ভাল করে দেখে নেই”, বেশ বিজ্ঞের মতো জবাব দীপ্রর।
তবে বেশিক্ষন সময় নিল না চীনের বেইজিং শহরের এই খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে, চিনেই হউক আর না চিনেই হউক, কিম্বা বুঝেই হউক আর না বুঝেই হউক, ছোট ভাইয়ের সামনে গুরুদায়িত্ব পাওয়া দীপ্র বেশ গম্ভীরভাবে জানাল, নিশ্চিত সে, সেই ব্যাগঘরটা ডান দিকে এগুলেই পাওয়া যাবে।
দ্বিরুক্তি না করে তাই ডানে দিকে ঘুরে পিছু হাঁটা ধরতেই, ‘পিছনে আবার কোথায় ফিরে যাচ্ছি আমরা এই ঠাণ্ডায়? আবারো ঢুকব নাকি ঐ গ্রেট হলে?” তুমুল হতাশায় বলে উঠল হেলেন।
নাহ ওখানে আবার ফের যাব কেন? কিন্তু আমাদের ব্যাগ গুলো তো নিতে হবে। এগুতে এগুতে জবাব দিতেই ‘তাহলে তো ঐ ভেতর দিয়েই তো যেতে পারতাম, এই ঠাণ্ডায় এখানে না বের হয়ে।’ শীতকাতুরে হেলেনের প্রকাশ করল তার উষ্মা।
কানে গেলেও সব কথাই শুনতে নেই। বা শুনলেও তার জবাব দিতে নেই, এ আপ্তবাক্য মনে হওয়ার পরও কোনটাকেই পাত্তা না দিয়ে, ব্যাগঘরের সম্ভাব্য দিকে এগুতে এগুতে বললাম, এখানটায় না আসলে গ্রেট হলে চেহারা দেখাই তো বাদ রয়ে যেত । আর এই ঠাণ্ডাতেই তো ঘুরতে হবে আগামী দু দিনও। আগামীকাল তো যাবো বিখ্যাত গ্রেটওয়াল দেখতে। আর সেটা তো শহরের বাইরে। ঢাকা থেকে যেমন শহরের বাইরের দিকে গেলে ঠাণ্ডার প্রকোপ বাড়ে শীতকালে, এখানেও হয়তো তাই হবে। অতএব আজ সেই প্র্যাক্টিস হয়ে যাক না কেন?
‘বাবা, তোমার এই গ্লোভস এ কাজ হচ্ছে না’। নিজের গ্লোভস হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় আমার গ্লোভসের শরণ নেয়া তার ছোট্ট হাত দুটো প্রবল নাড়াতে নাড়াতে অভ্র ককিয়ে উঠতেই, দেখলাম, ঢল ঢল করছে গ্লোভস দুটো ওর ছোট্ট করতল জুড়ে! বুঝলাম এ কারনেই হাতমোজার সেই ঢলঢলে ফাঁক গলে ঢুকে পড়ছে হিম হড়হড় করে ওকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বললাম, হাত দুটো জ্যাকেটের পকেটে যেন ঢুকিয়ে হাঁটে। এছাড়া তো আর কোন নিদান নেই এই সমস্যার। সাথে সবাইকে বললাম সবাই যেন যতোটা পারে, জোরে হাঁটে। তাতে ঠাণ্ডা কম কামড় বসাতে পারবে তিন চার স্তরের গরম জামাকাপড় ভেদ করে শরীরে।
কাজ হল এতে। দাঁতমুখ খিঁচে মনে হল বেশ জোরেই হাঁটা শুরু হল সবারই, যদিও পায়ের ব্যাথার কারনে লাজুর গতি কিছুটা মন্থর, তবে তারপরও অন্যান্য সময়ের তুলনায় ঢের জোরেই হাঁটছে ও এমুহূর্তে। মনে হচ্ছে ঠাণ্ডায় বুঝি তার ব্যাথার বোধও বুঝি অসাড় হয়ে গেছে!
এতোক্ষন কি কারণে খেয়াল করিনি যে জানি না, তবে এ মুহূর্তে ঠিকই নিজের মোজাবিহীন করতলের হাড়ে টের পেলাম কড়মড়ে ব্যথা, আছে যা নাঙ্গা এখন পুত্রদ্বয়ের কাঁধে। দ্রুত ওদের জ্যাকেটের পকেট বদ্ধ হাতের কনুয়ের ফাঁক দিয়ে নিজ হাত ঢুকিয়ে নিজ জ্যাকেটের পকেটে করতলদুটো ঢুকিয়ে দিয়ে বাপ বেটা তিনজন পাশাপাশি মানব শিকল তৈরি করে দ্রুত পা ফেলে এগুতে শুরু করলাম।
এদিকে মড়ার উপর খাড়ার ঘা এর মতো তিয়েন আন মেন স্কয়ারের দিকে বয়ে আসা হীমতর হাওয়া সমস্ত অস্তিত্ব জমিয়ে দেবার যোগাড় করলেও, সেটিকে দেখছি মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না মন। যেনবা তার গায়ে লাগছে না এর সামান্যতমও আঁচড়। অতএব ঘুরছে মন তার নিজ খেয়ালে নানান দিকে। ফলে মনে হল আচ্ছা একটু আগে দীপ্রর প্রশ্নের জবাবে হড়বড় করে একটা তালগোল পাকানো উত্তর যে দিলাম বুর্জোয়া বিষয়ে, তা কি ঠিক হল? সামাজিকবিজ্ঞান, অর্থনীতি বা রাজনীতি বিষয়ে বিশেষ ভাবে অজ্ঞ আমার এর বেশী তো জানাও নেই!
আর ছোটবেলা থেকে শুরু করে তরুণ বয়স পর্যন্ত চারপাশ থেকে বুর্জোয়া শব্দটি যে স্বরে আর সুরে উচ্চারিত হতে শুনেছি, তাতে অভ্রর প্রশ্ন মোতাবেক নিজেকে বুর্জোয়া ভাবতে বড়ই কষ্ট হচ্ছে। তার পরও যদি আসলেই বুর্জোয়া হই, তবে কোন ধরনের বুর্জোয়া আমি? পাতি বুর্জোয়া? নাকি লুম্পেন বুর্জোয়া? নাকি পাতিলুম্পেন বুর্জোয়া? হ্যাঁ এইসব বাজে বিশেষণ যুক্ত বুর্জোয়াদের কথাও তো শুনেছি। সেগুলো তো আরো নিকৃষ্টভাবেই উচ্চারিত হতে শুনেছি! অতএব এর কোণটারই তো ভাল কোন মানে মনে ধরছে না নিজেরই!
যদিও একটু আগে করা অভ্র বা দীপ্রর সম্পূরক প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়নি, স্ত্রী আজ্ঞার দ্রুত তথাস্তু বলে সাড়া দিতে গিয়ে। জিজ্ঞেস করব না কি এখন যে, কি ভাবছে অভ্র বুর্জোয়া শব্দটি নিয়ে?
এ ভেবে মুখ খুলতে যাব যখন তখনই মনে হল, আচ্ছা দীপ্র যে জিজ্ঞেস করল আমরা মিডল ক্লাস কি না, সেটাই বা সে কিভাবে জিজ্ঞেস করল? ও কি তাহলে জানে যে মিডল ক্লাস কি? আর জানলেই বা জানল তা কোত্থেকে? আমাদের শৈশবে তারুণ্যে, যখন যুবকেরা তরুণেরা লাল পতাকাতলে গিয়ে সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতও দলে দলে, তখনি না এই সব শব্দ প্রবল উচ্চারিত হত দিকে দিকে। এখন তো ঐ সব শব্দ চলে গেছে যাদুঘরে। আজ তো চারিদিকে উচ্চারিত হয় নানা জঙ্গীশব্দ। তাহলে জানল সে তা কোত্থেকে এই অনুচ্চারিত শব্দটি? ও কি তাহলে এখনকার উচ্চারিত নানা জঙ্গি শব্দও শিখে গেছে নাকি? যদি তা হয়, তাহলে তো বড়ই চিন্তার কথা!
আচ্ছা আমি নিজেই বা কিভাবে জেনে গিয়েছিলাম ছোট বেলায় নানা নিষিদ্ধ শব্দ আর তার মানে ? যার কারনে ঐসব শব্দ কখনোই ভুলেও উচ্চারণ করতাম মুরুব্বিদের সামনে। অশ্লীল হিসাবে বিবেচিত নরনারীর জৈবিক চাহিদা আর সে প্রসূত ক্রিয়াকর্ম বিষয়ক ঐ সব শব্দের মানে তো কেউ না শিখিয়ে দিলেও, আশপাশ থেকে সে সব শব্দ তুলে নিজে নিজেই কি করে যেন দাড় করিয়ে ফেলেছিলাম ওগুলোর মানে। করেছিলাম তা কিভাবে, তা না জানলেও সে শব্দ যে শিখে গিয়েছিলাম এটা তো ঠিক? এখনও নিশ্চয় আমার পুত্ররা ঐ সব শব্দ আর ক্রিয়াকর্মের খবর পেয়ে যায় আরো অনায়াসে, কারণ যুগটা তো এখন ডিজিটাল।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের শক্তি আত্মবিশ্বাস নিউজিল্যান্ডের সবুজ উইকেট
পরবর্তী নিবন্ধরোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের পাশে আছে তুরস্ক