দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ১২ আগস্ট, ২০২২ at ৭:০৭ পূর্বাহ্ণ

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ আই এম এফের কাছে ঋণ সহায়তা চেয়েছে। এর মানে বাংলাদেশকে এখন কিছু শর্ত মানতে হবে। এবং তা সহজ কিছু হবে না। আজ ১০/৮ এর খবরে দেখলাম পরিকল্পন মন্ত্রী বলেছেন টাকার অভাবে অনেক কিছু করা যাচ্ছে না। তিনি স্পষ্টভাষী। কিছুদিন আগে তাঁর সাথে একটি টক শোতে যুক্ত হবার কারণে জানি তিনি রাখঢাক করেন না। ভদ্র মানুষ। এই সত্যগুলো এখন দুয়ারে কড়া নাড়ছে। তারপরও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এখনও ভালো। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে বলে যারা হা হুতাশ করছেন তাদের বলি, সারা দুনিয়ায় এখন বেহাল দশা চলছে। সিডনিতে বাজারে আগুন। ডলারে দাম হাঁকার পরিমান শুনলে চোখ কপালে উঠবে। ফুল কপি বেগুন টমেটো থেকে পালং শাক বা সবজীর দাম এমন কেউ হাত দিতে পারছে না। খাবার টেবিলে কেবল মাংস দিয়ে কি চলে? তেলের বাজারও চড়া। সমপ্রতি জ্বালানির দাম বাড়লেও এখন কমছে। সব মিলিয়ে অবস্থা বেগতিক। ফাস্ট ফুডের এই সমাজে সেখানেও জ্বলছে আগুন। এই হাল বাংলাদেশে আছড়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এর সাথে রাজনীতি মিশিয়ে অবস্থা শোচনীয় করে তোলা অন্যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত অগ্রসরমান দেশ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি অনেকদিন ধরেই টালমাটাল। সমপ্রতি খবর বেরিয়েছে, বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করতে পেরে দেশটি নিজেকে ঋণখেলাপি ঘোষণা করেছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননে সরকার নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। গভীর সংকট হাতছানি দিচ্ছে এ অঞ্চলের আরেক দেশ নেপালকেও। ভারতে জিনিসের দাম আকাশ ছোঁয়া। এর মানে এই না যে বাংলাদেশেও দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু গ্লোবাল এফেক্ট বা প্রতিক্রিয়া এড়ানো যাবে না। মুশকিল হচ্ছে বাংলাদেশে তথ্যের অসঙ্গতি আর মন্ত্রীদের বক্তব্য। তাঁরা একেক সময় একেক কথা বলেন। বাড়তি কথা বলেন। যার দরকার নেই। এতে বিভ্রান্তির জন্ম হয়। আমরা এসব দেশে দেখছি মন্ত্রী বা আমলারা সহজে মুখ খোলেন না। তাঁরা অনুমোদিত বক্তব্য বাদে মন্তব্য করেন না। কিন্তু যে কোনো দরকারে হাজির থাকেন। তাঁদের এই জবাবদিহিতা মূলক সতর্ক আচরণ মানুষের মনে স্বস্তি যোগায়। মানুষ ভাবে বিপদে কেউ একজন আছে।
হুজুগে কথা বলে লাভ হবে না। বরং যুক্তি তর্ক দিয়ে বুঝতে হবে কেন কি হচ্ছে। করোনো মহামারির প্রকোপ ঠেকাতে ২০১৯ সালের শেষ হতে ২০২১ সালের শুরুর কয়েক মাস পর্যন্ত দেশে দেশে লকডাউন ও নানা বিধিনিষেধের কারণে স্থবির হয়ে পরেছিলো বিশ্ব অর্থনীতি। মহামারির ওই ভয়াবহ সময়ে বিধিনিষেধের কারণে এক দেশের সাথে অন্য দেশের সীমানা ও বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় আমদানি নির্ভর দেশগুলোতে দেখা দেয় খাদ্য ঘাটতি। এছাড়াও পরিবহন সংকটের কারণে রপ্তানি কারক দেশগুলোতে বেড়ে যায় পণ্য পরিবহন খরচ। অন্যদিকে শ্রমিক সংকটের কারণে হ্রাস পায় পণ্যের উৎপাদন। এসব মিলিয়ে লাগামহীন ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে পণ্যের মূল্য। করোনার মহামারির ধকল কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বুনছিলো ঠিক সেই সময়টাতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। একদিকে রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারক রাষ্ট্র। অন্যদিকে ইউক্রেন বিশ্বের অন্যতম খাদ্য শস্য উৎপাদন ও রপ্তানিকারক রাষ্ট্র। চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে উভয় দেশের রপ্তানি কার্যক্রমই প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে বিশ্ব জ্বালানি এবং খাদ্য নিরাপত্তায় পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। যার কারণে বিশ্বে অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি এখন লাগামহীন। জ্বালানি ও খাদ্য মূল্য বৃদ্ধির সাথে অন্যান্য সকল পণ্যের পরিবহন ও উৎপাদন খরচ জড়িত বিধায় অন্যান্য পণ্যের মূল্যও লাফিয়ে বাড়ছে।
এই বাস্তবতা কি আমাদের দেশ এড়াতে পারে? এটা সত্য বাংলাদেশ এর দায়ভার নেবে না। কারণ আমরা তা তৈরী করতে বা এমন পরিবেশ হবার ব্যাপারে ভূমিকা রাখি নি। কিন্তু বদ বা মন্দ বিষয়ের নিয়ম এমনই। কথায় বলে: একে নষ্ট করে দশে কষ্ট পায়। যুদ্ধ আর করোনা একসাথে হবে এটা কেউ স্বপ্নেও ভাবে নি। অতিমারী করোনা দুনিয়া স্তব্ধ করে দেয়ার পরও যে রাশিয়া ইউক্রনে হামলা করবে এটা যেমন ভাবা যায় নি তেমনি এই যুদ্ধে ন্যাটো বা আমেরিকা যে এমন নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে সেটা কি কেউ জানতো? আমেরিকা রাশিয়ার সাধারণ মানুষরা কি ভালো আছেন? আমরা অষ্ট্রেলিয়ার মতো সম্পদশালী কম জনসংখ্যার একটা দেশে থেকেও দেখছি কি টালমাটাল হাল। তাই বাংলাদেশে বহু মানুষের রাগ আর হতাশার কারণ বুঝি না। আপনাকে বুঝতে হবে জলবায়ুর মতো বিষয়ও এখানে বড় বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী বন্যা, খরা ও ঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাহত হচ্ছে শস্য উৎপাদন প্রক্রিয়া। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে খাদ্য সংকট। খাদ্যের চাহিদা চেয়ে জোগান কম থাকায় বাড়ছে পণ্যের মূল্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবীর অন্যতম খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী রাষ্ট্র ভারতে প্রায় ৩০ শতাংশ খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এর ভুক্তভোগী প্রশান্ত পাড়ের দেশ। বন্যার কারণে ব্রিসবেনে ফলমূল শস্য ভেসে যাওয়ায় বাজারে কোনো কিছুতে হাত দেয়া অসম্ভব। কবে এটা নর্মাল হবে কেউ জানে না। জলবায়ুর কথা বলছিলাম।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাত কমে গিয়ে খরা বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্যশস্য উৎপাদন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ফলে খাদ্য সংকটে আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া, কেনিয়া এবং সোমালিয়ায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। ভয়াবহ খরার ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে এই অঞ্চলে ক্রমেই বাড়ছে ক্ষুধা মৃত্যুর হার। সমপ্রতি আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম এবং সেভ দ্য চিলড্রেন কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে, ইথিওপিয়া, কেনিয়া এবং সোমালিয়ায় ক্ষুধার কারণে প্রতি ৪৮ সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে।
সে অবস্থান থেকে বাংলাদেশ কোন পর্যায়ে বা কি ভাবে মোকাবেলা করছে তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। সরকারের আন্তরিকতা বা দায়িত্বের কমতি নেই। কিন্তু একা সরকারের কাজ নয় এটা। মানুষের ভেতর সহনশীলতা আর কৃচ্ছতা সাধনের দরকার। এ কথা শেখ হাসিনা সরাসরি বলেন। যারা মনে করে সরকার প্রধান কেন এমন বলেন তাদের জানা উচিৎ যেসব দেশের গণতন্ত্র বা শাসন বিচার দেখে আমরা প্রলুব্ধ হই বা তেমন হবার কথা বলি তাদের শাসকেরা কি এভাবে বলেন না? বরং তাঁদের অনেকেই কঠোর ভাষায় এগুলো বলেন। পার্থক্য একটাই আমাদের আমলারা বলেন কিন্তু নিজেরা বিলাসিতা করেন। এই জায়গাতে তাদের সাবধানতা আর পরিমিতিবোধ এখন প্রয়োজনীয়।
অর্থনীতির সাধারণ সূত্র জানলেই বোঝা সম্ভব কেন দেশে এমন দাম বাড়ছে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বৃদ্ধি। আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি। দেশীয় পণ্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি। ফলে এ সমস্যা একদিনে শেষ হবে না। মানুষের দুর্ভোগ বা অভাব যাবে না রাতারাতি। সমগ্র বিশ্বই এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় মনোনিবেশ করছে। এটা গ্লোবাল সমস্যা। তাই বাংলাদেশের মানুষকে উত্তেজিত না করে রাজনীতি যদি নিজের দায়িত্ব পালন করে তবেই সহজ হবে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা। মনে রাখা দরকার ঊর্ধ্বমুখিতারও চাপ আছে। সে চাপ হজম করেই মানুষকে সামনে যেতে হয়।
লেখক : সিডনি প্রবাসী প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধবাস-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষ চালকের মৃত্যু, আহত ২