দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত

| শুক্রবার , ১৫ জুলাই, ২০২২ at ৮:১৪ পূর্বাহ্ণ

শ্রীলঙ্কার জনরোষ : চোখ খুলে দিক সবার

শ্রীলঙ্কা ছেড়ে মালদ্বীপে পালালেন গোতাবায়া রাজাপাকসে। দেশটিতে ৭৩ বছর বয়সী এই রাজনীতিক স্ত্রী ও এক দেহরক্ষীসহ চারজন যাত্রীকে নিয়ে সামরিক বিমান অ্যান্তোনভ-৩২ মঙ্গলবার মধ্যরাতে বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
এর আগে বিমানবন্দরে অভিবাসন কর্মকর্তাদের বাধার মুখে আকাশপথে বিদেশ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর সমুদ্রপথে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেন গোটাবায়া। বিমানবন্দরের অভিবাসন কর্মকর্তারা গোতাবায়ার পাসপোর্টে সিল মারতে রাজি না হওয়ায় মঙ্গলবার এই দ্বীপরাষ্ট্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য নৌবাহিনীর টহল নৌযান ব্যবহারের চেষ্টা করেন তিনি। খবর এএফপির।
শ্রীলঙ্কা একটি সমৃদ্ধ দেশ এবং সেখানকার মানুষজন সবাই শিক্ষিত এটাই আমরা জানি। শিক্ষিত মানুষজনের মনোভাব আর তাদের জীবনবোধ বুঝতে না পারার মাশুল যে এতো বড় হতে পারে সেটা কি রাজাপাকসের পরিবার টের পেয়েছিল? পায়নি। আর পায়নি বলেই আজ তাদের এমন বেহাল দশা। ইতিহাসের নিয়ম হচ্ছে যারা তাকে রক্তাক্ত করে বা তার ওপর অবিচার করে ইতিহাসও তাকে ছেড়ে কথা বলে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এ এই সত্যটা মানুষ ভুলে যায়। বিশেষত: দম্ভ আত্মঅহংকার আর তোষামোদীতে নিমজ্জিত শাসকেরা তা টের পায় না। যখন পায় তখন অনেক দেরী হয়ে যায়। এই রাজাপাকসে কিন্তু তাদের হিরো। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে: ‘আশির দশকের গোড়ার দিকে শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ-সম্পর্কিত মৃত্যুর সংখ্যা আনুমানিক ৭০ থেকে ৮০ হাজার। এছাড়াও গৃহযুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে আরো কয়েক হাজার। স্বাধীনতার পর ভারত মহাসাগরের এই ছোট্ট দ্বীপ দেশটির অবস্থা তৎকালীন সময়ে ছিল অশান্ত। লিবারেশন টাইগার অব তামিল ইলাম (এলটিটিই) বা তামিল টাইগার নামে পরিচিত বিচ্ছন্নতাবাদী সংগঠনটি তাদের নানা তাণ্ডবে আতঙ্কে রাখতো শ্রীলঙ্কার সরকারসহ জনগণকে। সেসময় এলটিটিই বিশ্বের সবচেয়ে পরিশীলিত এবং শক্তভাবে সংগঠিত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির একটিতে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭০ এর দশকে সংগঠনটি বেশ কয়েকটি গেরিলা হামলা চালায়। ১৯৮৩ সালে তারা ১৩ সৈন্যকে হত্যা করলে পাল্টা আক্রমণে যায় শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী। তখন থেকে সরকার এবং এলটিটিইর মধ্যে বড় আকারের সহিংসতা শুরু হয়’।
পরবর্তীতে সিংহলিজ প্রধান শ্রীলঙ্কা তামিলদের সন্ত্রাস অথবা স্বাধীনতা স্পৃহা যাই বলি না কেন তার অবসান ঘটায়। এই অবসান ঘটানোর আগেও নানা কাহিনি টানাপোড়েন আছে। ভারতের সাথে সম্পর্কের ওঠানামার কারণ ও জাফনার বিরোধীদের ভারতের সহায়তা। অবশেষে রাজীব গান্ধীকে সুইসাইড বোমারু নারী দিয়ে হত্যা করানোর পর ভারত আস্তে আস্তে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করতে শুরু করে। একসময় এই গোতাপাকসের পরিবারের নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কান নামে পরিচিত সংখ্যাগুরু সিংহলিজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে একসময় সিংহলিরা ভালোবেসে ‘টারমিনেটর’ বলত। তামিলদের বিদ্রোহকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে গোতা এই ভালোবাসা পেয়েছিলেন। কিন্তু এক যুগ পর সেই টারমিনেটরকে চোরের মতো লুকিয়ে প্রাসাদ ছেড়ে পালাতে হলো। তার আগে মাহিন্দা ও বাছিলকেও তাড়িয়েছে জনতার চাপ। একে ইতিহাসের ট্র্যাজেডি বলা হবে নাকি প্রহসন; সে বিষয়ে বিতর্ক চলছে এখন দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় বিতর্কের পাশাপাশি নতুন প্রশ্নও উঠেছে সামনের রাজনৈতিক প্রশাসন কী আদল নেবে? ডলার ও জ্বালানি কোথা থেকে আসবে? কখন আসবে? তাড়ানোর মতো আর কোনো টার্গেট কি আছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। নানা সমীকরণে ক্লান্ত জনগণ বা সে দেশের মানুষ পরিত্রাণ চায়। একসময় সাঁ সাঁ করে রাস্তাঘাটের উন্নতি বড় বড় দালানকোঠার আধিপত্য আর কলম্বোর রাস্তা জুড়ে বাহারি গাড়ির বহর দেখে মনে হয়েছিল চীনের সহায়তা আর ভারত বিরোধিতায় শ্রীলঙ্কা এগিয়ে গেছে অনেক দূর। কিন্তু তলে তলে যে সর্বনাশের বীজ বোনা হচ্ছিল সেটার যাই হোক জনগণ টের পায় নি। এখন তা উপমহাদেশসহ এশিয়া এমন কি প্রশান্ত পাড়েও বাস্তব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রশান্ত সাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো খুব জনপ্রিয় বা পরিচিত না বলে আমরা হয়তো জানি না। এখানকার সলোমন আইল্যান্ড, ফিজি, পাপুয়া নিউগিনি এসব দেশেও চলছে চীনের আধিপত্য আর সহায়তা। সমপ্রতি সরকার পরিবর্তনের পর আমাদের অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যালবেনিজি এই দেশগুলো সফর করে এলেন। এ লেখা যখন লিখছি খবরে দেখলাম আমেরিকাও এতো দূর এসে পড়েছে তাদের মাল মশলা সাহায্য দানের ভেতর দিয়ে দেশগুলোতে নিজেদের জায়গা করে নিতে। ভবিষ্যতে কি হবে বলা মুশকিল কিন্তু সব দেশ ও জাতি শ্রীলঙ্কা থেকে লেসন বা পাঠ না নিলে সময় ছেড়ে কথা বলবে না।
যে কথাটা পরিষ্কার করে বলা দরকার একক কোনো শক্তি বা দেশের ওপর নির্ভরতা কমাতেই হবে। দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে এই তত্ত্বের বাইরে পা ফেললেই বিপদ। মিডিয়া বলছে, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে মহাশক্তিমান হিসাবে খ্যাত হয়েছিলেন। সেই খ্যাতির পিছনে ছিল দেশের উত্তরাঞ্চলে তামিল প্রতিরোধ ধ্বংস করতে তাঁর দাদা, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের সেনাপতির ভূমিকায় গোতাবায়ার নির্মম অভিযান, যে অভিযান তার ভয়াবহ অমানবিকতার কারণে দুনিয়া জুড়ে নিন্দিত হয়, কিন্তু সংখ্যাগুরু সিংহলি বৌদ্ধ সমাজের বিপুল সমর্থন পায়। ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর জয়ের পিছনে এই ইতিহাসের বড় অবদান ছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হয় সেই বছরের এপ্রিলে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হানার ঘটনা দেশের মানুষ সন্ত্রাস দমনের জন্য শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট চেয়েছিলেন। তিন বছরের মধ্যে অজস্র জনকণ্ঠে ‘ভাগো গোতা, ভাগো’ ধ্বনির তাড়নায় তাঁকে পালাতে হয়েছে, তার কারণ, চূড়ান্ত আর্থিক বিপর্যয়, বুকের ছাতি, বাহুর পেশি বা বোমারু বিমান দিয়ে যে বিপর্যয় রোধ করা যায় না।
এই বাস্তবতা মনে করিয়ে দেয় শাসন বা ক্ষমতা চিরস্থায়ী কিছু না। আমরা শিল্প সংস্কৃতি এমন কি কবিতাতেও এমন সব রাজাদের উল্লেখ পাই যারা নন্দিত বন্দিত বা পূজ্য হবার পরও পালাতে বাধ্য হতেন। এমন কবিতাও আমরা পড়েছি যে রাজা ঈশ্বরতুল্য ছিলেন তাকে জুতার মালা গলায় ঝুলিয়ে বিদায় দিয়েছে জনগণ। তবু ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নিতে চায় না। একতা এমন ব্যাপার থাকে যখন তোষামোদি আর স্তাবকতা রাজা বা দেশ শাসককে ক্রমশ: জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অনেক ভালো হৃদয়বান এবং দেশপ্রেমিকও তখন আর বাস্তবতা জানতে পারেন না। বা জানতে দেয়া হয় না। আর এই ফাঁকে দেশের বারোটা বাজার পাশাপাশি নিজের অস্তিত্বও টালমাটাল হয়ে দাঁড়ায়। এ থেকে মুক্তির পথ একটাই মানুষের ভাষা বোঝা। মানুষকে জানা। যেমনটা খলিফা ওমরের গল্প আমরা পড়েছি। যেমনটা ভারতবর্ষের রাজাদের কেউ কেউ করতেন। মানুষের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে না পারলে চাকচিক্য আর সাময়িক উন্নয়নে শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় রাখা কঠিন। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর জান নিয়ে পালানোর উদাহরণ সবার চোখ খুলে দিক। সময় তাই চায় এখন।
লেখক : সিডনি প্রবাসী প্রাবন্ধিক, কবি ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধঅপূর্ব