দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীকের গল্প

আমি সিডনিতে অভিবাসন নিয়ে এসেছি ১৯৯৬ সালে। আসার পর এই মানুষটির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু তিন হাজার কিলোমিটার দূরে পার্থ শহরে উড়ে যাবার মতো ডলার ছিলো না পকেটে। ছিলো না গাড়ী। ফলে টেলিফোন ই ভরসা। কিন্তু ততোদিনে তিনি শেষ শয্যায়। তার ওপর প্রচন্ড অভিমানে বাংলাদেশের জন্য অপার ভালোবাসার পর ও কোন বাঙালির সাথে সহজে কথা বলতে চান না। যে দেশের জন্য তিনি জানবাজী রেখে লড়েছিলেন তার যে কোন পতনে তিনি বিচলিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। অনেক কষ্ট করে মাত্র একবার কথা বলতে পেরেছিলাম। আসুন আজ সে ভদ্রলোকের সাথে পরিচিত হই। ভদ্রলোকের নাম আপনি না-ই জানতে পারেন তবে জানে দেশ, দেশের রক্তমাখা মাটি, বৃক্ষ, ফুল, অগণন তারকারাজি।
তার কোনো দায় ছিল না বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। তিনি ছিলেন বিখ্যাত জুতা কোম্পানি বাটার সিইও। পুরো নাম উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড। তখন বাটা একাই একশ। সত্তর সালে ঢাকায় পোস্টিং পাওয়া মানুষটির রক্তে ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ। তিনি জন্মেছিলেন আমস্টার্ডামে। এই ডাচ মানুষটিকে যৌবনের শুরুতেই পড়তে হয়েছিল নাৎসীদের কবলে। তাদের কুখ্যাত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে দুঃসহ সময় কাটানোর সময় ও পরে তিনি শিখে নিয়েছিলেন গেরিলা যুদ্ধের কৌশল।
বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান। আমি সবে হাইস্কুলের উঁচু ক্লাসের দিকে পা বাড়াচ্ছিলাম। আমার পরিষ্কার মনে আছে কী নির্যাতন আর বিভীষিকাময় ছিল দিনগুলি। আজ আপনারা সব বেমালুম ভুলে গেছেন। আজ প্রজন্মের পর প্রজন্ম বোঝেই না কেমন ছিল মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তান প্রেম আর ধর্মীয় চেতনার নামে সামপ্রদায়িকতা আঙুল ফুলে কলাগাছের সমাজে ভুলে বসে আছে দেশ মুক্ত হয়েছিল কীভাবে, আর না হলে পাঠান-পাঞ্জাবির পা মুছে নত থাকতে হতো।
বাটা সু কোম্পানির মতো বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়াতে তার পশ্চিম পাকিস্তানে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ ছিল। এই সুবিধার কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারক মহলে অনুপ্রবেশ করার এবং বাংলাদেশের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করার। তিনি প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসের ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সখ্য গড়ে তোলেন। সেই সুবাদে শুরু হয় তার ঢাকা সেনানিবাসে অবাধ যাতায়াত। এতে তিনি পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হতে থাকলেন আরো বেশি সংখ্যক সিনিয়র সেনা অফিসারদের সাথে। এর এক পর্যায়ে লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি, অ্যাডভাইজার সিভিল অ্যাফেয়ার্স মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ আরো অনেক সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে তার হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। নিয়াজির ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার তাকে ‘সম্মানিত অতিথি’ হিসাবে সম্মানিত করে। এই সুযোগে তিনি সব ধরনের ‘নিরাপত্তা ছাড়পত্র’ সংগ্রহ করেন। এতে করে সেনানিবাসে যখন-তখন যত্রতত্র যাতায়াতে তার আর কোনো অসুবিধা থাকল না। তিনি প্রায়ই সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তানিদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা শুরু করলেন। এ সকল সংগৃহীত সংবাদ তিনি গোপনে প্রেরণ করতেন ২নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে।
তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা কমান্ডো হিসেবে স্বীয় অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে স্বয়ং ২নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা শাখার সক্রিয় সদস্যরূপে অকুতোভয় ওডারল্যান্ড বাটা কারখানা প্রাঙ্গণসহ টঙ্গীর কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতেন। কমান্ডো হিসাবে তিনি ছিলেন অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। এক পর্যায়ে তিনি নিজেই জীবন বিপন্ন করে যুদ্ধে নেমে পড়তেন। তিনি বাঙালি যোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করতে থাকেন। তার পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়। মেজর হায়দারের দেয়া এক সনদপত্রের সূত্রে জানা যায় যে, ওডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধে গণযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, নগদ অর্থ, চিকিৎসা সামগ্রী, গরম কাপড় এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস নির্যাতন ও গণহত্যার আলোকচিত্র তুলে গোপনে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন তথ্যমাধ্যমে পাঠাতে শুরু করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন। এ বিষয়ে তিনি নিজেই লিখেছেন, ইউরোপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলো আমি ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে সেসব জানানো উচিত। ইউরোপে ফেলে আসা যুদ্ধস্মৃতির ২৯ বছর পর ১৯৭১ সালে টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে আবার তিনি সাক্ষাৎ পেলেন নাৎসি বাহিনীর। টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা নৃশংস হত্যাকাণ্ড, বীভৎস মরণযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে তিনি ব্যথিত হন। তাই ওডারল্যান্ড ছবি তোলা রেখে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধকালে তিনি প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সে সময় তিনি ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনের গোপন সহযোগিতা পেতেন। ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং পূর্বতন কর্মস্থলে যোগ দেন। তিনি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যান।
এই মানুষটি যুদ্ধের শুরুতেই টের পেয়েছিলেন ববর্র পাকিস্তানি সৈন্যরা কী করতে যাচ্ছে। প্রভাব ও কৌশল খাটিয়ে তখনকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পাক বাহিনীর বড় কর্তাদের বিশ্বাসভাজন হবার ভান করে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন খবর জানিয়ে দিতেন। যখন বুঝলেন যুদ্ধ ছাড়া বাঙালির কোনো পথ খোলা নাই নিজেই নেমে পড়েছিলেন মাঠে। গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে সংগঠিত করার পাশাপাশি হাতে অস্ত্র তুলে নেয়া এই মানুষটি পাকিদের হাতে মরলে অবাক হবার কিছু থাকত না। এমনকি তার কৌশল ধরা পড়ে গেলেও জান হারাতেন। অথচ কি আশ্চর্য বিশাল বিশাল দালান-কোঠা, গদী, ক্ষমতা, বিত্ত, পদ-পদবী পাওয়া কেউ তাকে মনে রাখে না। চেনেও না।
সিডনি বসবাসের শুরুতে না ছিল প্রচুর অর্থ না তেমন কোনো যোগাযোগ। তবু তার ফোন নাম্বার জোগাড় করে কথা বলতে চেষ্টা করেছিলাম। কিছুতেই ফোন ধরবেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যা বিশেষত তাজউদ্দীন আহমদসহ চার নেতা হত্যার পর তিনি বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ ছিলেন। ঢাকা ছেড়ে চলেও আসেন কিছুদিন পর। সরকারি আমন্ত্রণেও যাননি। গুরুতর অসুস্থ শয্যাশায়ী মানুষটি বাংলাদেশের কথা শুনলেই স্পর্শকাতর হয়ে উঠতেন। তখন তার আবেগী হওয়া বারণ। তবু বারবার চেষ্টা করার পর তার স্ত্রীর মন গলে যাওয়ায় কয়েক মিনিট কথা হয়েছিল। সেই স্মৃতি অমূল্য সম্পদ আমার।
শুভ জন্মদিন একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধআলেশামার্ট এবার কার্যালয় বন্ধ করল