দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ২১ মে, ২০২১ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

নিয়মে জয়- নিয়মহীনতায় পরাজয়
বাংলাদেশে মানুষএখন ভয়ে তটস্থ হলেও সাবধানে থাকছে না। ঘরে বসে সরকারকে দোষারোপ করলেও হতো, করছে উল্টো। এটা যেন শখের লকডাউন। বাজার করতে করতে ক্লান্ত মানুষ যখন শপিংমল খুলবে বললে রাগ করে তখন সত্যি বুঝি না কে কি বলছে। শপিংমল খোলা যে আত্মঘাতী হবে সেটা বলাইবাহুল্য। এখন দুনিয়ার বহুদেশের সরকার প্রধান মরিয়া হয়ে গেছে সবকিছু খুলে দিতে। ট্রাম্প থেকে ইমরান খান কেউ বাদ না। এটা জানতে হবে যে এখনো কেউ এই করোনার থাবা মুক্ত হতে পারে নি।
পৃথিবীর কোন দেশেই করোনা নির্মূল হয়ে যায় নি। কোথাও কোথাও দমেছে। আমাদের সিডনিতে এই যে আমরা এখন কাজ শুরু করেছি আর ইউরোপ আমেরিকায় মানুষ কাজে যেতে বাধ্য হচ্ছে এসব কি ইচ্ছা করে? একটুও না। আপনার সামনে যখন কেবল দুটি পছন্দ তার একটিতো নিতেই হবে। একটি যখন করোনা হলে মারা যেতে পারেন আরেকটি খিদে কষ্ট অনাহারে নিশ্চিত মৃত্যু তখন মানুষ কোনটা নেবে? একটা হলেও হতে পারে। আরেকটা নিশ্চিত। তাই বন্দী মানুষ জান হাতের মুঠোয় নিয়ে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু কোথাও তা একেবারে চলে যায় নি। নিউজিল্যান্ডের সুনাম আমরা শুনেছি। তারা সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করে তাদের দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার দমিয়ে রেখেছিল বটে কিন্তু খুলে দেবার পর দেখা গেল শত্রু ঘাপটি মেরে আছে। সুযোগ মিললেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
পুরো দুনিয়ার চিত্র আজ একদিকে বেদনা বিধুর আরেকদিকে সংগ্রাম ও জীবনের জন্য মরিয়া। আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ। আমরা অষ্ট্রেলিয়া আমেরিকা ইতালী কানাডা যেখানেই থাকি না কেন আমাদের মূল পরিচয় কি আসলে? আপনি খবরগুলো দেখুন তো। মিডিয়া কি বলছে? যুক্তরাষ্ট্রে অতজন বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে কিংবা লিখছে এতজন বাংলাদেশী আক্রান্ত হয়েছেন। এঁদের অনেকেই হয়তো কবে বাংলাদেশে শেষবার গেছিলেন নিজেরাই ভুলে গেছেন। কারো কারো নাড়ীর টান ছাড়া যোগসূত্রও নাই দেশের সাথে। তবু আমরা বলছি বাংলাদেশী। এটাই আমাদের পরিচয়। তাই আমরা দেশ নিয়ে নিশ্চুপ থাকতে পারি না।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার আছে বলে এখনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে নি। যে সমাজে রাজনীতি নাই যে সমাজে মান্যতা বলে কিছু নাই যেখানে দু একজন মানুষ বলেন আর বাকীরা শোনেন সেখানে এপর্যন্ত যে হাজার হাজার মানুষ মারা যান নি এটাই শোকর। আমার এক বন্ধু ঠাট্টা করে বলেন দেশে নাকি বক্তা বা বলার মানুষ দু জন। প্রশ্ন করেছিলাম তারা কারা? এক মিনিট না ভেবেও উত্তর দিলো: কেন? আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের আর বিএনপির রুহুল কবির রিজভি। কথাটা মজার মনে হলেও সত্য। দেখবেন কথা পাল্টা কথার জন্য এরা সবসময় হাজির। জনগণ শুনছেন না শুনছেন না সেটা বড় কথা না বড় বিষয় তাদের বলতে হবে। এই লেখা যখন লিখছি বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা আগের রেকর্ড ভেঙেছে। অথচ কাদের সাহেবের আজকের বক্তব্য ছিলো বিএনপির রাজনীতি এখন টেলিভিশন কেন্দ্রিক। এই মহামারীও তাদের ঝগড়া থামাতে পারে নি।
এদিকে আমরা কি দেখছি? প্রচণ্ড সমন্বয়হীনতা। একবার বলা হচ্ছে কাল থেকে শপিং খোলা। তারপর আবার বলা হচ্ছে না দশ তারিখের পর। স্কুল কলেজ সব সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকতে পারে এমন আভাস দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আবার এদিকে মাষ্টারদের যাবার জন্য বলা হচ্ছে। আসলে কে কি করছে বা কে কি বলছে তার কোন সমন্বয় নাই। সবচেয়ে বড় কথা হলো ঈদ আসছে বলে কি ব্যবসায়ীদের অন্যায় আবদার মানতে হবে? এবারের ঈদ পুজো বা যে কোন উৎসব আগের মতো হবে না। গোটা দুনিয়া তা মেনে নিয়েছে। আমাদের সিডনিতে সরকার থেকে বলা হয়েছে এখন কোন বিলাসদ্রব্য বা কাপড় পোশাক কেনার সময় না। প্রয়োজনের বাইরে টাকা খরচ না করার পরামর্শ দিয়েছে সরকার। তা ছাড়া বাংলাদেশে যে এক শ্রেণির মানুষ কি পরিমাণ কষ্টে আছে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সে কথা বলাও পাপ। কারণ করোনার সময়ও ধরপাকড় কমে নি। সবমিলিয়ে শপিং খোলার যৌক্তিক কোন কারণ নাই। এমন হতে পারতো ঈদের আগে আগে হয়তো অবস্থা বিবেচনায় কয়েকদিন সীমিত সময়ে খোলা যেতে পারতো দোকানপাট। সেটা কিন্তু পরিষ্কার করে বলে নি কেউ।
অবস্থাদৃষ্টে এটা পরিষ্কার যারাই চাপ দিচ্ছে তারাই পেয়ে যাচ্ছে ছাড়। সেটা ধর্মীয় ব্যাপার থেকে শপিং সর্বত্র সত্য। এই চাপাচাপির পরিণাম আমরা কিন্তু হাতে হাতে পেতে দেখছি। আজ যে সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তার জন্য দায়ী কারা? আমরা কি পোশাক শ্রমিকদের জোর করে ঢাকায় আনা এবং ফেরত যাবার কথা ভুলে গেছি? কই সে ঘটনার জন্য তো কারো বিচার হলো না। কাউকে ধরাও হলো না। ধরা হলোনা জানাজার নামে লাখো মানুষ জড় করার কাউকেও। আজ দেশে তার জেরেই বেড়ে চলেছে করোনা রোগীর সংখ্যা। এখন আমরা যদি তার প্রভাব ও ফল পাই শপিং খোলা, বাজার খোলার পর কি হবে ভাবা যায়? গত দু এক দিনে ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশে লাফিয়ে লাফিয়ে ডিগবাজী খেয়ে বাড়ছে করোনা রোগী। আমরা দেশের বাইরে থাকি বলে অনেকে ঝুঁকি নিয়ে হলেও আমাদের সত্য কথা জানান।
আমার জানা মতে ডাক্তারেরা ভালো নাই। এটা সরকার নিজেদের দোষ হিসেবে কেন নেবে? এটাতো ইংল্যান্ড আমেরিকা ইতালীর মতো দেশেও ঘটেছে। অজানা একটা মহামারী আচনক এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে কেউ জানতো না। তাই ফ্রন্টলাইনে থাকা ডাক্তার নার্স স্বাস্থ্য কর্মীরা আছেন ঝুঁকির মুখে। কিন্তু সত্য গোপনে কার লাভ? কিসের লাভ? কম্বল উজাড়ের মতো ডাক্তার নার্সরা উজাড় হতে শুরু করলে বাংলাদেশ সামনের দিনগুলিতে এই সমস্যা মোকাবেলা করতে পারবে না।
আর এক বিপদে আছে আমাদের পুলিশবাহিনী। এবার তাঁরা প্রমাণ করেছেন তাঁরা জনগণের বন্ধু। তাঁদের কাজ তাঁদের ত্যাগ তাঁদের ভূমিকা সোনার আখরে লেখা থাকবে ইতিহাসে। কিন্তু আজ তাঁরা অনিরাপদ। এখানেও সরকার কেন মনে করছে এটা বলা মানে অপরাধ? এই সংক্রমণের মূল জায়গাগুলো বন্ধ করলেই তো তারা আক্রান্ত হবেন না। তাঁরা এটা পাচ্ছেন কোথা থেকে? মানুষকে সাবধান করতে গিবে ডিউটি করতে গিয়ে আজ তাদের এই হাল। কাল যদি তারা মৃত্যু ভয়ে হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকে কি হবে সমাজের? ইতোমধ্যে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করার মতো কাজও করেছেন পুলিশের এক সদস্য। যারা মনে করছেন এটা ঠিক কাজ না বা এভাবে কেউ মরা উচিৎ না তাদের বলি তাঁর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখুন হয়তো মনে হবে রোজ তিলে তিলে মরার চাইতে পরিবারের সবাইকে মারার আগে নিজেই চলে যাই।
ভয়ংকর কষ্টা আছেন নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা না পারছেন লজ্জায় লাইনে যেতে মানুষের কাছে হাত পাততে না তারা পারছেন বেঁচে থাকতে। সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলিতে বাংলাদেশের সামনে মহাদুর্যোগ। এখন সত্য গোপন মানে আমাদের ডাক্তার নার্স স্বাস্থ্যকর্মীসহ পুলিশবাহিনীর মৃত্যু। আমাদের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সর্বনাশ। এটা কোন পরিসংখ্যানে যোগ বিয়োগের খেলা না।
তাই আশা করি এবং ভরসা রাখি সরকারের নিবিড় নজরদারিতে করোনাকে সাইজ করা সম্ভবপর হবে। মানুষের যেমন আবোলতাবোল বলা অনুচিত তেমনি সত্যিটা বেরিয়ে না আসলেও ঘোর বিপদ। করোনা চলে গেলেও তার রেশ যাবে না। সমাজ অর্থনীতি ও দেশের ওপর তার কুপ্রভাব থাকবে। শুধু যারা সঠিক মোকাবেলা করতে পারবে তারাই সবলে টিক থাকবে। এটাই চূড়ান্ত।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধকর্মহীন সুবিধাবঞ্চিতদের উপহার সামগ্রী বিতরণ