দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ

এবার ভুল করলে বাঁচাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে

করোনা এবার উপমহাদেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। শুধু ভৌগোলিক কারনে না নানা কারণে আমরা ঘনিষ্ঠ। সাহিত্য সংস্কৃতি আমদানী রপ্তানী স্বাস্থ্য চিকিৎসা সব বিষয়েই আছে নির্ভরতা ও দেয়া নেয়ার সম্পর্ক। পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার সাথে আমাদের ভাষা সংস্কৃতির এতো মিল টের পাওয়াই কঠিন আমরা কে কোথায়। আজ বাস্তবতা এই দুই দেশকে এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়েছে যেখানে আমাদের কঠোর হবার কোন বিকল্প নাই। বাংলাদেশ কতোটা কঠোর হতে পারবে জানি না কিন্তু বাঁচতে হলে মানুষ বাঁচাতে হলে একটা বড় সময়ের জন্য সব যোগাযোগ বন্ধের কোন বিকল্প নাই।

ভারতের করোনা পরিস্থিতি এমন এক আকার ধারণ করেছে যাকে বিশ্ব স্বাস্‌হ্য সংস্থা বলছে করুণ ও হৃদয় বিদারক। জাতিসংঘ আমেরিকা ইউরোপ সহ পুরো দুনিয়া ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত। মাঝখানে তারা মোটামুটি ভাবে করোনা থেকে বেরিয়ে আসার মতো একটা জায়গায় পৌঁছে যাওয়ায় মনে করেছিল দুর্যোগ শেষ। কিন্তু আড়ালে ওঁৎ পেতে থাকা কোভিড মুচকি হেসে ভাবছিলো আর ক’টা দিন সবুর করো…শুরুতেই আমি দোষারোপ করবো সে দেশের উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা নরেন্দ্র মোদীকে। বাগ্মী মোদী যখন কথা বলেন তখন না শুনে উপায় থাকে না। শান্তি নিকেতনে তাঁর সুললিত ভাষণ এবারও করোনার সময় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাঁর কথামালা ছিলো গোছানো ও সলিড। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। বাদবাকী নানা বিষয়ে তাঁর ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এই যে নির্বাচন এবং নির্বাচন নিয়ে ঝামেলা চাইলে কি তা এড়ানো যেতো না? সংবিধানের দোহাই দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন করা নিয়ে মমতা -মোদীর বিতর্ক আগামী ইতিহাসের সেরা কলংক হয়ে থাকবে। জীবন বড় না সংবিধান বড় এই কলহে জেদ ধরে রাখা মোদী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে খুনী বলে ও রায় দিয়েছে মাদ্রাজ হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এই ঐতিহাসিক রায় সে দেশের স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রমাণ । যা আমাদের দেশে নাই। এটুকু বাদ দিলে বাকী সব কিছুই এখন ভারতের অনুকূলে না।
আমরা আমাদের দেশের কথা বলবো। আমাদের জনগণের নিরাপত্তাই হবে প্রধান বিষয়। সরকার কালবিলম্ব না করে সীমান্ত বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা প্রশংসনীয়। এর পাশাপাশি আমরা চাই আপাতত সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করা হোক। সব ধরনের যোগাযোগের ভেতর অবৈধ সীমান্ত পারাপারও একটা বিষয়। সেটা বন্ধ করা নানা কারণে দুঃসাধ্য। কারণ এরসাথে ভাত কাপড়ের যোগ আছে। সীমান্ত এলাকার মানুষ নিজেদের আর্থিক কারণেই সীমান্ত পাড়ি দেয়। যার নাম চোরাচালান। এ প্রক্রিয়া বন্ধ না করলে কড়াকড়ি হবে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মতো।
আমাদের দেশেও আমরা বেপরোয়া ভাব ও করোনা বিষয়ে মানুষজনের অনীহা দেখতে পাচ্ছি। যে কারণগুলি কাজ করছে তার ভেতর কুযুক্তি আর অপপ্রচার আছে সামনের সারিতে। কি কারণে কোন আকরণে জানিনা মানুষ মনে করে এই রোগ নাকি আমেরিকা ইউরোপ আর সাদাদের রোগ। বড়লোক নামে পরিচিত ধনীদের রোগ। এমন উদ্ভট তথ্য কে দিলো কেন দিলো বোঝা মুশকিল। তবে অনুমান করা যায় এর পেছনে আছে অন্ধ মৌলবাদীরা। তারা এখন ভারতের হাল দেখে বলবে বলেছি না… এসব কাফেরদের রোগ। অথচ ভারতে সমান তালে মারা যাচ্ছেন সেখানকার মুসলমানেরা। এই মহামারী আর সব মহামারীর মতো কাউকে ছাড় দেয় না।
সাবধানতা ছাড়া এখন কোন আশার বাণী নাই। আপনি আর না মানেন সারা বিশ্বে এখন ১৫ কোটির মতো মানুষ করোনা আক্রান্ত। এসব ই সরকারি বেসরকারি হিসেব, কিন্তু আপনার মতো আমার মতো ছুপা করোনা রোগী কতো আর কেয়ার না করা রোগীর সংখ্যা যে কতো কেউ জানে না। এই হিসেবের পরও আপনি সতর্ক হবেন কি হবেন না সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু আপনার কি কোন অধিকার আছে প্রতিবেশী বা নিজের আত্মীয় পরিজনের জীবননাশের? অথচ জ্ঞানত অথবা অজানা কারণে আপনি তাই করে চলেছেন।
আপনাকে কেউ একজন মূর্খ বা অতিপন্ডিত বলেছে এটি আমেরিকা ইউরোপ অষ্ট্রেলিয়া বা কানাডার রোগ।এ রোগে মারা যায় সাদা বা শ্বেতাঙ্গ মানুষ। এটা কালোদের রোগ না। এ কথা জানার পর আপনি মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলেছেন। মহা আনন্দে বাজারে হাটে ঘোরাঘুরি করছেন। আপনি কি জানেন কালো মানুষের সেরা দেশ সাউথ আফ্রিকায় এখন এক লাখ পাঁচ হাজারের মতো মানুষ করোনা আক্রান্ত? আপনার জানা নাই ব্রাজিলে এখন কবর দেয়ার মতো মানুষ বা জায়গার খোঁজে আছে সরকার। কিন্তু আপনাকে ধর্ম ব্যবসায়ীরা বুঝিয়েছেন এ রোগ গোরা আদমীর। আপনি সে ট্যাবলেট খেয়ে বুঁদ আছেন জনাব আর আপনার সেই গুরু কিন্তু ঠিকই সাবধানে আছেন।
যে শহরে থাকি সে সিডনিতে করোনা রোগী নাই। নতুন কোন সংক্রমণের খবর নাই। এটা কি কেবল জনসংখ্যা কম আর মানুষ লেখাপড়া জানে বলে হয়েছে? এটা যারা বলে তারা জ্ঞানপাপী। এর চাইতে ভালো শহরগুলোতে এখন করোনায় মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। কানাডা আমেরিকা ইউরোপের শহরগুলো কোভিডে পর্যুদস্ত। এটা সম্ভব হয়েছে মূলত শুরু থেকেই সরকারের সঠিক উদ্যোগ আর বলিষ্ঠতায়। যে মুহূর্তে টের পেয়েছে বর্ডার বন্ধ করা দরকার তখন থেকেই সীমান্ত আকাশ পথ সব বন্ধ। এমনকি পাশের রাজ্যে ও যাতায়াত ছিলো বিদেশ যাত্রার মতো। মাস্ক যখন বাধ্যতামূলক ছিলো তখন না পরলেই জরিমানা। আমাদের দেশে শুধু কি আইন প্রয়োগকারীদের দোষ? এই সেদিন এক ডাক্তার ও পুলিশের ঝগড়ায় দেখলাম কেউ কারো চেয়ে কম যায় না। মৃত্যুর চাইতেও ইগো যেখানে শক্তিশালী সেখানে কে কাকে বাঁচাবে?
কাজেই জীবন এখন আপনার নিজের হাতে। আয়ু আপনি সাথে করে নিয়ে এসেছেন এটা যেমন সত্য তেমনি নিজেকে মারার বিষয়টিও আপনার হাতে। জীবন দিতে না পারেন মারতে তো পারেন। তাই আপনাকে মাস্ক পরতেই হবে। আপনাকে বাজারে যেতে হলে যাবেন কিন্তু মরার জন্য কাউকে মারার জন্য যাবেন না। আজ মানুষ সত্যি বড় অসহায়। এই মহামারীর সাথে বড়লোক ছোটলোক ধনী গরীবের কোন সম্পর্ক নাই। কোন সম্পর্ক নাই ধর্মের। রাগ বা অজ্ঞানতাবশত আমাদের নেতারা মুখে বললেও তাঁরা জানেন এটা আমেরিকা ইউরোপ কেউ জানতো না। আর কেউ ঠেকাতে পারবে না।
তাই অনুরোধের পাশাপাশি আপনাদের মতো কিছু অবাধ্যদের জন্য কঠোর হবার বিকল্প নাই। সরকার এতো কিছু করতে পারে মাস্কবিহীন মানুষদের কেন জরিমানা করতে পারেনা বুঝি না। সবার শুভবোধে করোনা পরাজিত হোক। মানুষ ভালো থাকুক। ভালো থাকুক বাংলাদেশ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও ছড়াশিল্পী

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধআরিয়ানের ঈদ চমক