দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ১৯ মার্চ, ২০২১ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু, সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি
‘১০ জানুয়ারি ১৯৭২ এর সেই অবিশ্বাস্য সকাল। পালাম বিমান বন্দর। আটটা বেজে দশ মিনিট। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর রূপালী কমেট বিমান। ধীরে ধীরে সশব্দে সুস্থির। তারপর শব্দহীন কর্ণভেদী নীরবতা। সিঁড়ি লাগল। খুলে গেলো দ্বার। দাঁড়িয়ে সহাস্য সুদর্শন, দীর্ঘকায়, ঋজু নবীন দেশের রাষ্ট্রপতি। অকস্মাৎ এক নির্বাক জনতার ভাষাহীন জোয়ারের মুখোমুখি। সুউচ্চ কন্ঠে উচ্চারণ করলেন তিনি আবেগের বাঁধভাঙা দুটি শব্দ জয় বাংলা। করতালি, উল্লাস আলিঙ্গন। তারপর আবেগের অশ্রুতে ঝাপসা স্মৃতি।’ এই হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের বঙ্গবন্ধু। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর ভূমিকা ও ব্যক্তিত্ব ছিলো এমন। আসলে তাঁর জন্য কী করেছি আমরা? কী করছি? এখন গাছের পাতা মাটির কণাও নাকি আওয়ামী লীগ। সে আমলে আমরা কি তাঁর আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির উদ্ভাস দেখছি?
কী অসাধারণ দূরদৃষ্টি ছিলো তাঁর। শুরুতে দিল্লী থেকে কলকাতায় ফেরা তারপর ঢাকা এই ছিলো পরিকল্পনা। কূটনীতিক প্রয়াত ফারুক চৌধুরী জানিয়েছিলেন উড়োজাহাজেই বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন কেন তিনি হঠাৎ মত পাল্টে দিল্লী থেকে সরাসরি ঢাকা যাবার সিদ্বান্ত নিয়েছিলেন। প্রথমত যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফেরা। দ্বিতীয়ত কোন কারণে কলকাতায় দেরী হয়ে গেলে রাত হয়ে যেতো। শীতের সন্ধ্যায় ঢাকায় জনসভা করা যেতো না। তখন দেশে পর্যাপ্ত আলোর সরবরাহ ছিলো না বলে। এবং শেষ কারণটি বলেছিলেন কলকাতায় যাত্রা বিরতি নয় তিনি সরাসরি একবার সেখানে গিয়ে তাঁদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন যারা এককোটি শরণার্থী আশ্রয় দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছিলেন। এই আমাদের দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু। আমরা তাঁর রাশিয়া সফরের সময়ও দেখেছি কী চমৎকার আদর আপ্যায়ন আর তাঁর কী অসাধারণ ভূমিকা। না আমরা তাঁর এসব কীর্তির কথা জানি না।
এই সেদিন ও আপনি সাউথ আফ্রিকার কোন বড় এয়ারপোর্টে গিয়ে নামলে পর্যটক হিসেবে আপনাকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি দুটো জিনিস দেয়া হতো। এর একটি নেলসন মান্ডেলার ছোট একটি ফ্রিজ ম্যাগনেট বা ছবি। আরেকটি সে দেশের কোন ঐতিহ্যবাহী স্যুভিনর। এতে যারা যান তাদের মনে এই মানুষটিকে জানার আগ্রহ বাড়ে। এমন না যে আপনি সাউথ আফ্রিকা যাবেন আর মান্দেলাকে চেনেন না। চেনার বিষয়টা এখানে মুখ্য না। বিষয় এভাবেই তারা তাঁদের নেতাকে প্রমোট করে। বিশ্বব্যাপী মান্দেলার সাথে পরিচিত হবার মতো আমাদের ও একজন নেতা আছেন। আমরা কি তাঁর বেলায় এমন কোন ব্যবস্থা নিয়েছি? বা চেষ্টা করি?
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশীরা এখন দেশের ভেতরেরও অধিক বিভক্ত। এই বিভক্তির কারণ আমাদের অজানা নয়। লন্ডন ভিত্তিক যে অপরাজনীতি ও সদলবলে পালিয়ে থাকা মানুষজন তারা আছে এর পেছনে। আছে দেশের বিভক্ত রাজনীতি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন উপমহাদেশের দুই দেশ ভারত পাকিস্তানও বিভক্ত রাজনীতির শিকার। তাদের পরিবেশ আমাদের চাইতে খুব ভালো কিছু না। কিন্তু একটা বিষয়ে তারা কখনো কলহ করে না। জন্মলগ্ন থেকে তারা ঠিক করে নিয়েছে গান্ধী তাদের জাতির জনক। অন্য দেশে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। আমরাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কলহে মত্ত থাকি।
এই মানুষটির জীবন আমাদের কারণে দীর্ঘায়ু হতে পারে নি। অথচ গরীব দেশের এই নেতাকে সে বয়সেই সমীহ করতো বিশ্ব নেতারা। তিনি যখন দেশ স্বাধীনের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরছিলেন তখনই তাঁকে রাজকীয়ভাবে সম্মান জানায় নাক উঁচু বিলেতের নেতারা। না তিনি তখন সরকার প্রধান না দেশের কর্তা কেউ। অথচ বৃটিশ আতিথেয়তা আর অভ্যর্থনার জোয়ারে ভেসে এসেছিলেন দেশে। এটা মূলত তাঁর ব্যক্তিত্বের বাহাদুরি। এই ক্যারিশমা ভারতেও কাজ করেছিল যাদুমন্ত্রের মতো। ভারতের লৌহমানবী নামে পরিচিত নেতা ইন্দিরা গান্ধী বাদে পাশে দাঁড়ানোর মতো ছিলেন না কেউ। এতবড় মাপের একজন নেতাকে আমরা এখনো দুনিয়ায় সেভাবে তুলে ধরতে পারি নি। এটা কষ্টের।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এত আধুনিক একজন নেতা আর এসেছে? সে সময়কালে তিনি চুরুট মুখে কি চমৎকার আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলছেন। বেকব্রাশ করা চুল। ঋজু সুউচ্চ নাসিকা প্রশস্ত ললাট। এমন বাঙালি নেতাই তো হবেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের পরিচয়। যিনি সদ্য স্বাধীন দরিদ্র দেশের নেতা হয়ে ও কারো মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন না। ইসলামী সম্মেলনে গিয়ে তাঁকে পড়তে হয়েছিল প্রশ্নের মুখে। তানজানিয়ার নেতা আমাদের এই নবীন রাষ্ট্রের প্রধানকে ধরে বললেন, মুজিব কেন তুমি পাকিস্তানের মতো একটি মুসলিম দেশকে ভেঙে দু টকরো করলে? এতে কি আমরা দুর্বল হয়ে গেলাম না? এক থাকলে কি হতো? পাশে দাঁড়ানো তখনকার ঝানু আমলা কুটনীতিক ও দূতেরা ঘামছিলেন তখন। এর কি উত্তর দেন আমাদের নেতা, তাঁর ক্যারিশমা থাকলেও এমন অভিজ্ঞতা তো ছিলো না। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, বন্ধু তোমার কথা ঠিকএক থাকলে ভালো হতো হয়তো। কিন্তু তুমি কি আমাকে বলতে পারো কেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি মুসলিম দেশ হবার পরও একসাথে নাই? বরং আমরা আমরাই মারামারি করে মরছি কেন? তাই আমার ধারণা জনগণ আর সময় ই ঠিক করে দেয় কে কার সাথে থাকবে বা থাকবে না।
এমন নেতা আর কোনকালে পাবো না আমরা। এখন সময় এখন তাঁকে নিয়ে অজস্র রচনা আর স্তুতির ভেতর ডুবে আছে সময়। ডুবে আছে তাঁর আসল ইমেজ। আমরা যে ভাষণ নিয়ে গর্ব করি বা যেটি আমাদের পরম সম্পদ তাকে ইউনেস্কো কি বললো সেটা কি আসলেই বড় ব্যাপার? আমরা কেন ভুলে যাচ্ছি আমাদের এই মহান ভাষণটি দুনিয়ার লড়াকু মানুষের আলোর দিশারী।
গর্ব করার মতো এখন বেশ কিছু সেক্টর তৈরি হয়েছে দেশে। পোশাক শিল্প, ক্রিকেট জনকল্যাণ নানা বিষয়ে আমরা পেয়েছি তারকা খচিত মানুষজন। কিন্তু সারা বিশ্বে রোল মডেল হবার মতো একজন নেতাও আছে আমাদের? যাঁকে দেখিয়ে বলা যায়, এই আমাদের দেশ, এই আমাদের নেতা। তিনি এক ও একক বঙ্গবন্ধু। তাঁর স্বল্প মেয়াদের শাসনকালের সমালোচনাকারীরা জ্ঞানপাপী। এদের কথা শুনে দেশ স্বাধীন হয় নি। এদের কথা শুনলে উন্নতিও হতো না। এদের কথা মানলে আমরা এতিম অসহায় ও দিশাহীন হবার পথে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই পাবো না। আজ আমাদের রাজনীতি একমুখী বা অচলায়তন বলে যে কথা চালু তার বৃত্ত ভাঙতেও তাঁকে চাই। এটা মানতে হবে গ্রহণযোগ্যতা আর ভাবমূর্তি মিলিয়ে পুরা দুনিয়াই একজন নেতাই আমাদের পাথেয়। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) চতুর্থ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও কিউবা ছিল। সেই সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাক্ষাৎ হয়। সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়েজ। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইজ দ্য হিমালয়েজ। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দ্য এঙপিরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়েজ।’ একজন মানুষের মধ্যে হিমালয় দেখার এই অভিজ্ঞতা বিশ্বস্বীকৃত হলে ও আমরা তাঁকে সর্বজনীন করি নি।
একাত্তরের পুরো সময় ধরে আমাদের বিরোধিতাকারী আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেন, সহিংস ও কাপুরুষোচিতভাবে বাংলাদেশের জনগণের মাঝ থেকে এমন প্রতিভাবান ও সাহসী নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়া কী যে মর্মান্তিক ঘটনা!
দীর্ঘকাল বিদেশে বসবাস করার কারণে নানা দেশে যেতে হয়েছে। উপমহাদেশে রাজনৈতিক নেতা গান্ধী ব্যতীত কাউকেই তেমন চেনেন সাধারণ মানুষ। শুধু বাংলাদেশ বললেই প্রবীণ মানুষেরা বলেন, ওহো তোমরা না শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছিলে? কেউ কেউ এই সেদিনও বলতেন এই কাজের জন্য তোমরা অভিশপ্ত। অষ্ট্রেলিয়ায় শায়িত বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাচ অষ্ট্রেলিয়ান বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশের কথা বললেই রেগে যেতেন। তাঁর কথা ছিলো: এ কারণেই কি আমি যুদ্ধ করেছিলাম জানবাজী রেখে?
নেতা বেঁচেছিলেন মাত্র ৫৫ বছর। কিন্তু শতবর্ষেও তিনি গৌরবদীপ্ত এক মহানায়ক। এখন আমাদের সবার কাজ সবার দায়িত্ব তাঁকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একক নেতা ও জাতির জনক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। আমরা যেন সরকারের তরফ থেকে সে কাজের সূচনা দেখতে পাই। জয়তু বঙ্গবন্ধু।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামলেখক, ছড়া সাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধস্বর্ণ চোরাচালান মামলায় যুবকের ৫ বছরের কারাদণ্ড