দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

কে তুলিবে পাল কে ধরিবে হাল
আজকের ডিসেম্বর আর একাত্তরের ডিসেম্বরে আসমান জমিন ফারাক। কেমন দেশ আমরা চেয়েছিলাম আর কেমন দেশ আমরা দেখছি? এ জন্য কি শুধু রাজনীতি দায়ী? না আরো কিছু আছে? মানতেই হবে আমাদের বুদ্ধিজীবী রা তাঁদের বল কৌশল এমন কি চেতনাও হারানোর পথে। একসময় কিছু হলেই মানুষ রাস্তায় নেমে আসতো। মানুষ মুক্তবুদ্ধি আর মুক্ত চেতনার জন্য প্রাণ দিতেও কসুর করে নি। আজ সে সব অতীত। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকায় আমরা কি ধরে নিয়েছি যে দেশ ও সমাজ নিরাপদ? আর একটা প্রশ্ন থাকবেই এই সরকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বাদ দিলে কারো কোন দায় বা জবাবাদিহিতা কি আসলেই আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর সবার জানা। তার চাইতে আসুন আমরা এই ডিসেম্বরে আমাদের সোনালী অতীত আর অতীতের ফসলের দিকে তাকাই।
এমন তো কথা ছিলো না। আমাদের সমাজে সহাবস্থান আর সমপ্রীতি বহু পুরনো বিষয়। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টানের পাশাপাশি বসবাসে কোন কালে কোন অসুবিধা হয় নি। বরং যারা সমস্যা করতে চেয়েছিল সে পাকিস্তান আর তার দালালদের সমূলে পরাজিত করেছিলাম আমরা। আর আজ? এই ডিসেম্বরে আমরা ধুঁকছি। আমাদের যৌবন আজ রাত জাগা। আমাদের তারুণ্য আজ ছোট পর্দায় মশগুল। নারী পুরুষ নির্বিশেষে বিনিদ্র রজনীর এই জাতিকে কে পথ দেখাবে? আমি বলতে চাই এই যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার ঔদ্ধত্য এর পেছনে জমে আছে দীর্ঘ সময়ের অবহেলা। আজ একটা কথা বলতে দ্বিধা নাই কেন কি কারণে শাহবাগকে হীনবল করে ফেলা হয়েছিল সে প্রশ্নের জবাব আজ দিতেই হবে। তখন কিন্তু সমানে সমানে এমন কি মুক্তিযুদ্ধের লোকজন ই গর্জে উঠেছিল । অন্যদিকে যাদের আমরা মৌলবাদ বলছি তারা তখন গণজাগরণকে ভয় পেয়ে গুটিয়ে গিয়েছিল।
আমাদের সরকার ও আজকের বুদ্ধিবৃত্তি হয়তো ধরে নিয়েছিলেন কাজ খতম। এবার আর কোন জাগরণের দরকার নাই। কিন্তু আড়ালে তখন আমাদের ঘরের দুশমনেরা হাসছিল। তারা জানে তাদের অপকৌশল কতোটা মারাত্মক। এরা এই ডিসেম্বরেই দেশকে মেধা শূন্য করতে মাঠে নেমেছিল। শুধু কি তাই? তারা আমাদের দেশ জাতিকে সর্বনাশ করে ভবিষ্যত ধ্বংস করার চেষ্টা ছাড়ে নি একদিনের জন্যও। আমি চোখ বন্ধ করে বলবো আজকের যে সব সমস্যা যে কারণে জাতির পিতার কন্যার সরকার থাকার পরও তারা বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙতে দুঃসাহস দেখায় তার কারণ জামাতের পুশ করা ইনজেকশান। তারা এখন অদৃশ্য বটে সেই ইনজেকশানের রিএকশ্যান দেখছে জাতি। মৌলবাদের একটা ভালো দিক হচ্ছে তারা সবসময় সংঘবদ্ধ। তারা চালে ভুল করে না। আর তাদের আছে উত্তেজনা বা জোশ। ঠিক দুধ ও তরল পানীয়ের যেমন তফাৎ। দুধ ভালো স্বাস্থ্যকর জেনেও মানুষ খেতে চায় না। আর যে কোন সুরাই লোভনীয়। উত্তেজনার দলে মানুষ সবসময় মতিভ্রষ্ট আর তেতে থাকে। তারা করতে পারে না হেন কোন কাজ নাই। যে কথা বলছিলাম, শুরু থেকে তাদের প্রতিহত করার পাশাপাশি বিকল্প শক্তি মাঠে রাখলে আজকের এই দৃশ্য দেখতে হতো না।
সবার আগে ভাবতে হবে সমাজে শিক্ষা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোর কি হাল? যে সমাজ স্বাধীনতার পঞাশ বছর পর ও ব্যবধান মানে এক দিকে উচ্চবিত্তের টাকায় কেনা মেধা আরেক দিকে মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন সাথে আছে ধর্মীয় পাঠের ভেতরে নানা ফারাক। আমাদের সমাজ কি মাদ্রাসার ছাত্র ছাত্রীদের আসলেই সমাজের অংশ মনে করে? তাদের কি আমরা আমাদের কথা বোঝাতে চাই বা পারি? সবসময় নাক উচুঁ মনোভাব ও আত্মম্ভরী মনোবৃত্তির কার সমাজে এক বিরাট বিভাজন টিকে আছে। আপনি কাউকে বছরের পর বছর দূরে রাখবেন আর ভাববেন আপনার আদেশ মানাই তার দায়িত্ব এটা কি সম্ভব? এটাও একটা কারণ বৈকি।
যে বিষয়টা আমাদের ভাবনায় থাকা উচিত আগের দিনে কিশোর কিশোরীরা খেলাঘর কচিকাঁচার আসর মুকুলের মাহফিল চাঁদের হাত এজাতীয় সংগঠনগুলোর মাধ্যমে জীবন শুরু করতো। তখন তারা জেনে যেতো কোনটা করা উচিৎ আর কোনটা না। কোন পথটা মুক্তবুদ্ধির আর কোনটা ভুল। আজ এগুলো ফসিল হয়ে বেঁচে আছে। ডিজিটাল জগতের নামে বায়বীয় আনন্দ সুখ দু:খ দখল করে নিয়েছে আসল জগত। তার দায় কি আমাদের নিতে হবে না? লেখাপড়ার বইগুলো উল্টে দেখেছেন? কি পরিবর্তন করা হয়েছে? কি কি পড়ানো হয় এখন? কোনদিন খবর নিয়ে দেখেন আপনার বাচ্চা আসলে কোথায় যায়? কাদের সাথে মেশে? কে কার খবর নেবে? সবাই তো যার যার কাজে ব্যস্ত। সবার হাতে মোবাইল আর মন পড়ে থাকে তাতে। সমাজ সংসার পরিবার বিচ্ছিন্ন হতে হতে একা। এই একাকীত্ব যে কতো ভয়ংকর আর আগ্রাসী তার প্রমাণ সমাজের দিকে তাকালেই মিলবে।
আজকের এই ভাস্কর্য বিতর্কের পেছনে এসব সমস্যা কাজ করে নি এমন না। করেছে আলবত করেছে। কারণ সমাজের গতিশীলতা নাই। সমাজ মূলত রাজনীতিহীন স্থবির। গণতন্ত্র মুখে বাস করে না। তার প্রয়োগ চাই। সহমর্মিতা সমঝোতা আর সহাবস্থান না থাকলে সমাজ ও দেশে এসব অনাচার বাড়বেই। আজকের ডিসেম্বরে দু একটা বা সবগুলো টিভি চ্যানেল আর মিডিয়া বাদে কোথায় আছে চেতনা? কোথায় মানুষের বিশ্বাস? কখন যে সমাজ ও দেশকে অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে আমরা টের পেলেও মানি নি। যেদিকে তাকাবেন সব থোকা থোকা অন্ধকার। এই আঁধার কাটতে সময় লাগবে। কোন ম্যাজিকে তা হবে না। চাই ধারাবাহিক চর্চা আর নিরন্তর মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার দিকে ধাবমান থাকা। কিন্তু কাজ কি সহজ? বা কে বাঁধবে ঘন্টা?
মানববন্ধন আর প্রতিবাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলি এর চাইতে দরকার পাড়ায় মহল্লায় এমন কি বাড়ি বাড়ি নিজেদের কে শান দেয়া। বাচ্চা বড় সবাই মিলে আবার ইতিহাসে মনোযোগী হয়ে ওঠা। এই দেশ এই জাতির ত্যাগ আর বীরত্বকে সম্মান জানানো। সে কাজ এখন প্রায় বন্ধ। এটা মনে রাখতেই হবে সমাজ দেশ যেমন বদলে যাচ্ছে তেমনি আওয়ামী লীগ ও বদলে যাচ্ছে । যতদিন শেখ হাসিনা ততদিন ভরসা। এই ভরসার জায়গাটির অতিব্যবহার বন্ধ করে নিজেদের দায়িত্ব নেয়া শিখতে হবে। নেতাদের কাছে অনুরোধ আপনারা হয়তো বাঁচবেন বা সমঝোতা করে টিকে থাকবেন দয়া করে দেশ মানুষ ও সমাজের কথা ভাবুন। ভাস্কর্য বড় বিষয় না বিষয় দেশ সমাজ জাতির ভবিষ্যৎ । এভাবে চললে তা যেখানে গিয়ে শেষ হবে তা দেখার জন্য তিরিশ লাখ মানুষ জান দেয়নি। সম্ভ্রম হারান নি মা বোনেরা। আপনারা পারলে পারবেন না পারলে সমাজকে সুযোগ দিন নিভু নিভু প্রগতির দীপশিখাটি যেন জ্বালিয়ে রাখতে পারে। সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধযুবলীগকর্মী মহিউদ্দিন হত্যা মামলা দ্রুত বিচার টাইব্যুনালে