দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ২৫ মার্চ, ২০২২ at ৮:৩৩ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়?
কবির ভাষায়, স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়? বাঁচতে চায় নি বলেই এই ভীতু নামে পরিচিত বাঙালি জাতি একাত্তরে গর্জে উঠেছিল। এই গর্জে ওঠা বা এমন কথাগুলো এখন পানসে। কোন অর্থ তৈরী গুটিকয় সার্কত রতে পারে না। অথচ সে সময় আমরা যে দ্রোহী হয়ে উঠেছিলাম তার প্রমাণ ইতিহাস। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখা মানুষ আমি। কিশোর বেলা পার হয়ে টিন এজে পা রাখার ঠিক আগেই লেগে গেছিল যুদ্ধ। সে সময় একেকজন বাঙালি মানেই একেকটি বাংলাদেশ। এক এক জন জয়বাংলা। আজ তা বোঝার বা ফিরে দেখার সময়ও নাই কারো।
আমি পজিটিভ মানুষ। পেছন ফিরে তাকিয়ে হা হুতাশ কিংবা যা পাইনি তার জন্য মায়াকান্না আমাকে টানে না। কিন্তু ইতিহাস কি কাউকে ছেড়ে কথা বলে? যে সব দেশ ধনে মানে সম্পদে এবং সাফল্যে আকাশ ছুঁ ই ছুঁ ই তাদের ইতিহাস একেবারে পরিষ্কার। তারা অনেক আগেই তাদের সবকিছু ঠিক করে নিয়েছে বলেই দ্বন্দ্বহীন নি:শঙ্ক চিত্তে এগুতে পেরেছে। আজকের বাংলাদেশ নানাভাবে উদ্ভাসিত গৌরবের এক দেশ। অর্থনীতি খেলাধুলা সাহিত্য শিল্প সব বিষয়েই তার পালে লেগেছে নতুন হাওয়া। আমাদের যৌবন ছিল অভাব অনটন আর পুরণো কাপড়ের দেশী যৌবন। আমরা গুটিকয় সার্ট আর দু তিনটা পাতলুন পরেই খুশী ছিলাম। চাকরী নাই বাজার মন্দা এমন অর্থনীতিতেও আমরা কোনদিন সাহস হারাই নি। আমাদের আগের প্রজন্ম আরো বেশী ত্যাগ করেছে এদেশের জন্য। এঁরাই সেসব মুক্তিযোদ্ধা যাঁরা জান দিয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন শরীরের অঙ্গ। কোন কোন মা বোন হারিয়েছিলেন তাঁদের নারীত্ব।এ সব কিছুর বিনিময়ে পাওয়া ছোট দেশটিকে আমরা ভালোবেসে সব কষ্ট ভুলে ছিলাম। আমরা ভাবতেও পারি নি একদিন আমাদের তৈরী পোশাক সারা দুনিয়ায় হৈ চৈ ফেলতে পারে। স্বপ্নেও ভাবা যায় নি দুনিয়ার সেরা ব্র্যান্ডের জামা কাপড় সেলাই করা হবে বাংলাদেশে। আমাদের কল্পনায় কোনদিন কোন সাকিব মাশরাফি লিটন ছিলো না। আমরা পুরনো প্যান্ট কেটে জার্সি সেলাই করে পুরাতন বলে ক্রিকেট খেলতাম। আমাদের কোন দল ছিলো না সমর্থনের জন্য। ভাগাভাগি হয়ে কেউ ভারত কেউ পাকিস্তানকে সমর্থন করে নিজেদের জোশ উদযাপনের জাতি আজ দেশের দল দেশের খেলোয়াড়দের নিয়ে আনন্দে ভাসে।
বাংলাদেশের সবচাইতে বড় পরিবর্তনের জায়গাটি তৈরী করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি স্বপ্ন দেখতে জানেন এবং তা বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারেন। এ লেখা যখন লিখছি তখন আলো আঁধারির দেশ বাংলাদেশে শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত হয়ে গেছে। মৌলবাদ বা ঝামেলাবাদীরা যাই করুক না কেন আমাদের নারীরা আগলে রেখেছেন শিল্প । আমাদের মেধাবী নারীরা যোগ দিচ্ছেন চ্যালেঞ্জিং সব পেশায় লক্ষ তাদের হাতে বিমান তাদের সেবায় পুলিশ তাদের কৌশলে ক্রিকেট হয়ে উঠছে ঝলমলে। এই কাজগুলো করতে না পারা এবং নারীদের সম্মানজনকভাবে সামনে আসতে দেয় না বলেই পাকিস্তান আজ চরমভাবে পেছনের সারিতে। বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক আর নারীরাই বদলে দিয়েছে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ।
এতোসব অর্জনের ভেতর মন খারাপ করে আছে ইতিহাস। এই যে স্বাধীনতার মাস এই যে আমাদের গৌরবের মাস কোথাও কিন্তু চার জাতীয় নেতার উদ্ভাস দেখি না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাজ উদ্দিন আহমদ ব্যতিরেকে কি একাত্তরের যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভবপর ছিলো? সম্ভব হতো স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জন? সাথে ভারতের তখনকার লৌহমানবী নামে পরিচিত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কথাও মনে রাখব আমরা। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী যে অপমান আর ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা যদি আমরা মনে না রাখি তা হবে বেঈমানী। আর অকৃতজ্ঞ জাতি কখনো ই মাথা তুলে চলতে পারে না।
আজ বাংলাদেশ ৫০ বছর পর কেন তার তরুণ প্রজন্মকে এসব তথ্য জানতে দেবে না? বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর জীবনের সংগ্রামের নামই বাংলাদেশ। তিনি ও বাংলাদেশ অভিন্ন একাত্ম। কিন্তু এটাও সত্য একাত্তরে তিনি ছিলেন উহ্য এক আলোর প্রতীক। যিনি পাকিস্তানের কারাগারে থেকেও আলোকিত করেছিলেন ইতিহাস। যুগিয়েছিলেন সংগ্রামের সাহস। আর সে সাহসকে পুঁজি করে নিজেদের বিচার বিবেচনা ও দেশপ্রেমে যাঁরা এই মুক্তিযুদ্ধের মতো অসম যুদ্ধে জয়ী হলেন তাঁদের কথা কেন জানবে না মানুষ? যদি জানতো আজকের বাংলাদেশে এতো আর্জনের পরও যে ভয় তা থাকতো না। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির কোনো একটি দিনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অবসর মুহূর্তে বসে ছিলেন তাঁর ঘরের সামনের গোল বারান্দায়। সেখানে কিছু চেয়ার পাতা, যেমন সব সময় থাকে। কী মনে করে সেদিন সহধর্মিণী জোহরা তাজউদ্দীন এবং বড় দুই মেয়ে শারমিন আহমদ রিপি ও সিমিন হোসেন রিমিকেও তিনি ডেকে নিলেন। সামনে বসিয়ে শোনালেন একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনা। তাজউদ্দীন আহমদের ধানমন্ডির বাড়ির দোতলায় সপরিবার ভাড়া থাকতেন আবদুল আজিজ বাগমার। তিনিও সেখানে উপস্থিত। তিনি লিখে নিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের মৌখিক বর্ণনা। আবদুল আজিজ বাগমার তাঁকে বলেছিলেন, তিনি যেন লিখে ফেলেন মুক্তিযুদ্ধের পুরো ঘটনা। জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, একাত্তরের প্রতিদিনের নোট তাঁর কাছে আছে। অবসর পেলেই লিখবেন। কিন্তু সে সুযোগ আর তাঁর ঘটেনি। জাতি কি ৫০ বছর পরও এই গল্প জানার অধিকার রাখে না?
ইতিহাসের পর যদি সমাজের দিকে তাকাই সেখানেই স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশী প্রশ্নবিদ্ধ। আজ আমাদের সমাজ দেশের মানুষের মনে ভয় দানা বেঁধে আছে। যে গতি যে বেগ যে আবেগে দেশের মঙ্গল ও উন্নয়ন তার সাধে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভয়ের সংস্কৃতি। প্রশ্ন উঠতে পারে কিসের ভয়? ভয় তো সবকিছুতেই। জানের ভয়। মানের ভয়। হঠাৎ হারিয়ে যাবার ভয়। ব্যাংকে টাকা রাখলে টাকা খোয়ানোর ভয়। শেয়ার বাজারে লগ্নি করলে টাকা মার খাবার ভয়। ভর্তি করাতে গিয়ে বাচ্চার সর্বনাশ হবার ভয়। মেয়েদের বাইরে নিরাপদে চলাচলের ভয়। রাতের অন্ধকারে বড়লোক হয়ে ওঠা মানুষের কুনজরে পড়ার ভয়। মস্তানীর ভয়। চাঁদা টেন্ডারের ভয়। এমন কি খোলামেলা পোশাক পরিধান করলেও ভয় । একটি স্বাধীন দেশে কি মানুষের এতো ভয় থাকে? না থাকা উচিৎ? এসব ভয়গুলো অমূলক হলে কথা ছিলো সবগুলো ই সশরীরে বিরাজমান। এখন আমরা একথা বলতেই পারি দীর্ঘ সময়ের শাসনামলে কেন এগুলো দমন করা যাচ্ছে না? কেন মানুষ ভোটাধিকার নিয়ে ভয় পায়? কেন জানে তার ভোট কাজে আসবে না। এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর মীমাংসা না হলে আমাদের স্বাধীনতা কি আসলেই উন্নয়নের ভেলায় সমুদ্র পাড়ি দিতে পারবে?
১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট আজ পরিণত হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে। সেদিনের ১২৯ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশটিতে বর্তমান মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার। সময় পেরিয়েছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়েছে। আমাদের বৃদ্ধি এবং প্রবৃদ্ধি সময় ও প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতি রেখেই ঊর্ধ্বগতি পেয়েছে। মাথাপিছু আয়, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ব্যবহার এবং সম্পদ উৎপাদন ও আহরণ দৃশ্যমান হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সে কথা নির্মোহভাবেই বলা যায়।
এখন তার গণতন্ত্র মানবাধিকার অসামপ্রদায়িকতা আর বৈষম্য হীনতার পরিচয় দিতে হবে। তা না হলে আগামী ৫০ বছর তো দূরের কথা দশ বছর পর রাষ্ট্র ও তার আদল নিয়ে কথা থেকে যাবে। আওয়ামী লীগ এককভাবে দেশ শাসন করলেও তার ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে সে সরে এসেছে। একথা বলি না সবসময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এগিয়ে চলাই জীবন। এগিয়ে যাওয়াই উন্নতি। কিন্তু কিছু মৌলিক আর মীমাংসিত বিষয় মেনেই তা করতে হবে। আজকের বাংলাদেশ আর্থিকভাবে যতোটা সচ্ছল মানসিক ও সংস্কৃতিগতভাবে ততৌটাই দুর্বল। এই দুর্বলতা কাটানোর জন্য সব ধরনের ভয় থেকে মুক্ত থাকা এবং ভয়হীন জাতিসত্তা ই সমাধান। বাংলাদেশ যদি তা করতে পারে তবে কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধপোর্ট সিটি ইউনিভার্সিটিতে টিকাদান কার্যক্রম