দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৯ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বেশ রাত অব্দি চললো আমাদের আড্ডা। প্রতিদিনই প্রায় একই গল্প, তবুও এই গল্প যেন শেষ হয়না। কত ধরণের গল্প যে আমরা করি! কখনো ইউছুপ আলী ভাই বলেন, কখনো আমি। কখনো ভাবীও যোগ দেন। নিজের গল্প, পরের গল্প, সন্তানের গল্প, অফিসের গল্প, ব্যবসার গল্প, চাকরির গল্প, সংসারের গল্প!! আহা, গল্পের সাথে গল্পগুলো একাকার হয়ে যায়। একেকটি গল্প যেনো একেকটি ছোটগল্প, শেষ হয়েও শেষ হয়না! রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ইউছুপ আলী ভাই ঘুমানোর কথা বলে উঠে পড়লেন। বললেন, ঘুমান, সকালে দেখা হবে। ঘুমানোর কথা বললেও তিনি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলেন ধুমায়িত কফি। বেশ সময় নিয়ে আমি রয়ে সয়ে কফি খাচ্ছিলাম। চোখ বুলাচ্ছিলাম মোবাইলে। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার এবং হোয়াটসআপে ঘুরছিলাম। হঠাৎ দরোজায় নক! এতরাতে কে আবার? ইউছুপ আলী ভিতরে ঢুকবেন কিনা জানতে চাইলেন। আমি হাসতে হাসতে বিছানায় উঠে বসলাম। বললাম, দরোজা তো খোলা। যে কেউ ঢুকতে পারে। ইউছুপ ভাই ঘরে ঢুকে আমার পাশে বিছানায় বসলেন। বললেন, ঘুম ধরছে না। একটি বিষয় চিন্তা করছিলাম। আপনি এক কাজ করুন, বেইজিং ঘুরে আসুন। চীন এসে বেইজিং না দেখলে বহুকিছু মিস করবেন। আপনি ঘুরতে ভালোবাসেন, তাই আমার মনে হয় বেইজিং না দেখে এখান থেকে ফিরে যাওয়া আপনার উচিত হবে না। ইউছুপ ভাই বলে চললেন, আরো দু’চার দিন এখানে থাকুন, পরে বেইজিং ঘুরে প্রয়োজনে ওখান থেকে দেশের ফ্লাইট ধরবেন, নয়তো এখানে এসে দুয়েকদিন থেকে দেশে ফিরবেন। অফিসে বলে দিলে ওরা অনলাইনে ওভাবেই আপনার টিকেট এবং হোটেল বুকিং করে দেবে। মজা করে বললেন, একা যেতে সমস্যা হলে অফিসের চীনা মেয়েটিকে আপনার সাথে দিয়ে দিতে পারি। তারপর হো হো করে হাসলেন। হাসলাম আমিও।

জ্বী, ইউছুপ আলী ভাইর গুয়াংজু অফিসে মাঝবয়সী একজন চীনা মহিলা কাজ করেন। বেশ চটপটে। যে কোন কাজের কাজী। এই মহিলার দক্ষতা নাকি অসাধারণ! যে কোন কাজই করতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা প্রচন্ড পরিশ্রমি। কোন কিছুতেই ‘না’ করেন না। মুখ থেকে বের করার বাকি, সব কাজই তিনি অনায়াসে গুছিয়ে ফেলেন।

ইউছুপ আলী ভাইকে বললাম, ‘বেইজিং যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই। দেখি, ব্যাটে বলে মিললে যাবো। নাহয় পরে কখনো হবে।’ আমার আলসেমির উত্তরে ইউছুপ আলী ভাই সন্তুষ্ট হলেন না। বললেন, পরে আবার কখন হবে! আপনি কি প্রতিবছর চীনে আসবেন!!

সেটা অবশ্য ঠিক, কবে যে আবার আসা হবে!

সকালে নাস্তা সেরে আমরা বেরিয়ে গেলাম। ইউছুপ ভাই অফিসে মিনিট দশেক বসলেন। পরে বললেন, চলেন, ঘুরতে যাই। সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। কোথায় ঘুরবো তা জানার দরকার নেই। ঘুরতে পারলেই হলো। ইউছুপ ভাই অফিস থেকে বেরিয়ে একটি টেক্সি নিলেন। চীনা ভাষায় ড্রাইভারকে কি যেন নির্দেশনা দিলেন। মিনিট বিশেক পর বিশাল একটি ভবনের সামনে আমাদের টেক্সি থামলো। টেক্সি থেকে নামতে নামতে ইউছুপ আলী বললেন, এটা গুয়াংজুর বেশ বিখ্যাত এবং বড় শপিং মল। চলেন, ঘুরি। শপিং করার কিছু থাকলে করে ফেলতে পারেন। আমি কিছু না দেখেই বলে দিলাম যে, শপিং এর কিছু নেই।

বিশাল শপিং মল। আবারো বলছি যে, বিশাল বলতে বিশাল। চীনের সবকিছুই বড় বড়। এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। শত শত দোকান, শোরুম ভবনটিতে। গ্রাউন্ড ফ্লোরেই মনে হয় কয়েকশ’ দোকান। আবার ভবনটির ডিজাইন এমন যে, নিচের গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকেই উপরের দিকের ফ্লোরগুলো দেখা যাচ্ছিল, দেখা যাচ্ছিল দোকানে সাজিয়ে রাখা পণ্যও। ইউছুপ ভাই বললেন, এই মার্কেটের একেকটি ফ্লোর একেক ধরণের পণ্যের শোরুম। এই মলে আপনি দুনিয়ার প্রায় সব জিনিসই পাবেন। গৃহস্থালী পণ্যের জন্য এই মল বেশ বিখ্যাত বলে মন্তব্য করে ইউছুপ আলী ভাই বললেন, দা ছুরি থেকে শুরু করে ঝাটা পিছা পর্যন্ত সবই আছে। বিছানার ছাদর থেকে খাট পালং কোন কিছুই বাদ নেই। সূচ সুতা থেকে শুরু করে মদ বিয়ার!

আমার শপিং করার কিছু নেই। তাই কোনকিছু না কিনে শুধু শুধু হাঁটছিলাম। এস্টেলেটরে চড়ে উপরে নিচে ঘুরছিলাম। শত শত দোকান, রকমারি পণ্য। অসংখ্য সেলসম্যান পণ্য বিক্রি করছে। প্রচুর মানুষ কেনাকাটা করছেন।

ইউছুপ আলী ভাই আমাকে ঘরের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র কিনে নেয়ার পরামর্শ দিয়ে বললেন, এগুলোর মান খুবই ভালো। ভাবী খুশী হবেন। আমার কেনার ইচ্ছে হলেও নিজেকে সামলে নিলাম। বললাম, এত বোঝা বয়ে বেড়ানোর ইচ্ছে আমার নেই। দেশে সব জিনিসই আছে। আমার ভয় হচ্ছিল যে, আমি কিছু কিনলেই ইউছুপ ভাই পেমেন্ট দিয়ে দেবেন। আমাকে এক টাকাও দিতে দেবেন না। হংকং এ নিজে আসতে না পারলেও ভাবীকে আমার সাথে দিয়ে শপিং এর পুরো টাকা পেমেন্ট করিয়েছিলেন। তাই এবার আর আমি শপিং এর ধারে কাছে গেলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম যে, ইউছুপ ভাই চলে যাওয়ার পর প্রয়োজনে কায়সার ভাই বা জোবায়েরকে সাথে নিয়ে এসে কিছু কেনাকাটা করে যাবো।

অনেকক্ষন অনর্থক ঘোরাঘুরি করে আমরা ফিরে এলাম। ইউছুপ আলী ভাই ভাবীকে নিয়ে বিকেলের ট্রেনে চলে যাবেন। তাই কিছুটা তড়িঘড়ি করেই ঘরে ফিরলেন।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আমরা গল্প করছিলাম। গুয়াংজু থেকে সরাসরি ট্রেনে চলে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও ইউছুপ আলী ভাই বললেন, আমি শেনজেন থেকে ট্রেনে চড়বো। শেনজেন পর্যন্ত আপনাকে সাথে নিয়ে যাবো। আমি সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে চলে যাবো, আপনি শেনজেন ঘুরেটুরে চলে আসবেন। শেনজেনও দেখতে খুব সুন্দর বলে জানালেন তিনি।

গুয়াংজু থেকে শেনজেন কত দূরে জানতে চাইলাম। ইউছুপ ভাই বললেন, দেড়শ’ কিলোমিটারের মতো হবে। গাড়িতে ঘন্টা দুয়েক লাগবে। বিজি রোড, তাই সময় একটু বেশি লাগে। নাহয় চীনে যে স্পিডে গাড়ি চলে তাতে দেড়শ’ কিলোমিটার পাড়ি দিতে দুই ঘন্টা লাগার কথা নয়। তিনি বললেন, আমরা একটু আগে ভাগে বেরিয়ে যাবো। তাহলে আপনাকে শেনজেন শহরে বেলা থাকতে থাকতে কিছুটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারবো।

আমরা বেরিয়ে পড়লাম। চমৎকার একটি গাড়ি নেয়া হয়েছে। সেভেন সিটার। ইউছুপ আলী ভাই রেন্ট এ কারের এই ড্রাইভারকে সবসময় ডাকেন। এতে করে ড্রাইভারের সাথে চমৎকার একটি সম্পর্ক দেখলাম। ইউছুপ ভাই এবং ভাবী ছাড়াও কায়সার ভাই এবং জোবায়েরকে সাথে নেয়া হয়েছে। ফেরার সময় আমার যাতে কোন অসুবিধা না হয় এবং শেনজেনে এদিক ওদিক যাতে আমি অনায়াসে ঘুরতে পারি সেজন্য তাদেরকে নেয়া হলো।

গুয়াংজু শহর থেকে বের হওয়ার পর ছয় লেনের বিশাল রাস্তা। গুয়াংজু-শেনজেন মহাসড়ক। থালার পিটের মতো রাস্তা, একেবারে মসৃন। পিচঢালা রাস্তাটি কী পরিমান সুন্দর তা লিখে বুঝানো অসম্ভব। আমার খুব ইচ্ছে করছিল গাড়ি চালাতে। এমন সড়কে অনায়াসে দেড়শ’-দুইশ’ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালালেও গা’গতরে ব্যাথা হবে না। সাঁই সাঁই করে ছুটছে গাড়ি। চওড়া রাস্তাটিতে কী পরিমান গাড়ি যে চলছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। একটি গাড়ির সাথে অপর গাড়ির তীব্র প্রতিযোগিতা। এই আপনি একটি ওভারটেক করলেন, মুহূর্তে অপর একটি পেছন থেকে সাঁই করে বেরিয়ে গেল। ওয়ান ওয়ে সড়ক হওয়ার কারনে একটির সাথে অপরটির মুখোমুখি ধাক্কা লাগছে না। যদি সড়ক ওয়ানওয়ে না হতো তাহলে দুমড়ে মুছড়ে যাওয়া গাড়ির মিছিল শুরু হতো! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নজয়ী কন্যারা নিজের মতন করে বাঁচো
পরবর্তী নিবন্ধচৌধূরী হারুনুর রশিদ : বিপ্লবী রাজনীতির প্রবাদপুরুষ