দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২১ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

( পূর্ব প্রকাশিতের পর)
‘নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই-’ কবিগুরু কাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলেছিলেন কে জানে! তবে এমন করে বলেছেন যে একেবারে বুকের গভীরে গিয়ে বাজে! রবীন্দ্রনাথের বহু কথাই আমি বুঝিনা, জানি না। আমার মতো একজন চুনোপুটির এসব জানার বা বুঝার কথাও না। রবীন্দ্র ঠাকুরের ভক্ত আমি, গবেষক নই। একজন রবীন্দ্র অনুরক্ত হিসেবে উনার প্রতিটি কথা আমার ভালো লাগে, আনন্দ দেয়। উনার গান কবিতা আমাকে উচ্ছ্বাসিত, উজ্জীবিত করে। কখনো কখনো মন উদাস করে, ভালো করে আবার কখনোবা বিরাগী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কখনো কোন ধরণের গবেষণার দুঃসাহস আমি করিনি। এতে করে রবি ঠাকুর কখন কি করেছিলেন, কেন করেছিলেন, কোন কথাটি কেন বলেছিলেন তা নিয়ে গভীরভাবে কোনদিন ভাবিনি, ভাবতে যাইনি। আমি একজন নিখাদ অনুরক্ত হিসেবে রবি ঠাকুরকে শুধু ভালোবেসে গেছি, ভালোবাসি।
মাঝে মধ্যে আমার মনে হয় রবি ঠাকুরের প্রতিটি কথারই আলাদা আলাদা অর্থ থাকে। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, দেখা যায়। রবি ঠাকুরের কোন কথাই যদি কোন মানবীর প্রতি আকুতি দেখা যায়, ঠিক ওই কথাটিতেই পাওয়া যায় স্রষ্টার প্রতি বিগলিত হওয়ার ছবি। এতে করে একজন প্রেমিক রবি ঠাকুরের যেই কথাটি বলে প্রেমিকার মন রাঙায়, সেই একই কথায় কোন সাধক পুরুষ স্রষ্টার মনে ঠাঁই পাওয়ার আকুতি জানান। আমি একটি কথা প্রায়শঃ বলি যে, রবি ঠাকুর শত বছর আগে যেমন ছিলেন, শত বছর পরেও ঠিক তেমনি থাকবেন। আমার বাবার যৌবনের রবি ঠাকুর, আমার যৌবনের রবি ঠাকুর কিংবা আমার নাতির যৌবনের রবি ঠাকুর একইভাবে সমাদৃত ছিলেন, আছেন, হবেন। সত্যি, ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে, কী অসীম জ্ঞান নিয়ে জন্মালে একজন মানুষ প্রজনম থেকে প্রজন্মান্তরে এমন পুজনীয় থাকতে পারেন!
আরো নানা ভাবনা ভাবছিলাম রবি ঠাকুরকে নিয়ে। মনে পড়ছে উনার নানা কথা, গান, কবিতা। ল্যানচা খেয়ে কলকাতার পথ ধরে ছুটছি, দূরন্ত গতিতে ছুটছে আমাদের গাড়ি। গাড়িতে চড়ার পর থেকেই আমি রবি ঠাকুরকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি। গভীর কোন ভাবনা নয়, হালকাভাবে নানা কিছু চিন্তা করছিলাম। শান্তিনিকেতন থেকে যতই দূরে আসছিল আমাদের গাড়ি, ততই যেন আরো বেশি করে রবি ঠাকুর আচ্ছন্ন করছিলেন আমাকে। ‘নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই-’ কী অসাধারণ! এই কথাটিতেই তিনি কী অবলীলায় নিজের আকুতি জানিয়েছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কথাটি কী তিনি কোন মানবীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, নাকি স্রষ্টাকে! আমি জানি না। ‘—শ্যামলে শ্যামল তুমি নীলিমায় নীল’। আহা, কী অসাধারণ শব্দমালা, কী অসাধারণ অনুভূতি!
চলছিল গাড়ি। প্রচণ্ড গতিতে ছুটছি কলকাতার দিকে। মহাসড়ক ধরে ছুটে চলছি আমরা। রাত নেমেছে অনেক আগে। রাস্তার কোথাও কোথাও দোকানপাট আছে, আছে আলোও। আবার কোথাও কোথাও ধূ ধূ মাঠ, ঘুটঘুটে অন্ধকার। সকালে যাওয়ার সময় রাস্তাটিতে যে পরিমান গাড়ি দেখেছিলাম, এখন তার অর্ধেকও নেই। একেবারে একেবারে কমে গেছে। অনেকক্ষণ পর পর এক একটি গাড়ি ক্রস করছিল আমাদের। এতে করে স্পিডে গাড়ি চালাতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। আমাদের ড্রাইভার বেশ অভিজ্ঞ। ইতোমধ্যে তাঁর ড্রাইভিং আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। ফলে স্পিড নিয়ে আমি কোন কথা বলছিলাম না। চলছে তো চলুক। যত দ্রুত যাবে ততই লাভ, তাড়াতাড়ি কলকাতা পৌঁছাতে পারবো। পেছনের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছি আমরা, লো ভলিউমে বাজছে রবি ঠাকুরের গান। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরতে রবি ঠাকুরের গান না শুনলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো। প্রযুক্তি সেই সুযোগটি অবারিত করে দিয়েছে। মোবাইলে ইউটিউব থেকে ব্লুটুথে কানেকশন দেয়া হয় গাড়ির সিডিতে। অতি পুরানো প্রযুক্তি, তবুও মুগ্ধ হওয়ার বহু কিছু আছে।
আমার এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক ফোন করলেন। কোথায় আছি, ফিরতে কতক্ষণ লাগবে জানতে চাইলেন। ড্রাইভারের কাছ থেকে জেনে নিয়ে স্যারকে উত্তর দিলাম। তিনি বললেন, হোটেলে ফিরেই যেন ফোন করি, ডিনার একসাথে করার কথাও স্যার বলে দিলেন। আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘স্যার, দেরি হয়ে গেলে আপনারা খেয়ে নিয়েন, আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো।’ স্যার বললেন, ‘এসে ফোন করো। সাবধানে এসো।’ আহা, লেগে থাকার ফল বুঝি এভাবেই জুটে! লেগে থাকা নিয়ে গল্প আছে। অন্য কোনদিন বলবো। তবে এখন একটি কথা মনে হয় বলে দেয়া যায় যে, স্যারের সাথে তেত্রিশ বছর ধরে লেগে রয়েছি। এই লেগে থাকার সুফল শুধু অফিস কিংবা বাসাতে নয়, নয় কেবল দেশে। বিশ্বের নানা দেশে নানাভাবে শুধু পেয়ে যাচ্ছি বছরের পর বছর ধরে।
যাক, রাত দশটা নাগাদ আমরা হোটেলে পৌঁছলাম। মিশন শান্তিনিকেতন সফলভাবে শেষ করায় অন্যরকমের তৃপ্তি কাজ করছিল অন্তর জুড়ে। ফুরফুরে মেজাজ বলতে যা বুঝায় আরকি! এত দীর্ঘ পথ জার্ণি এবং দিনভর প্রচুর ঘোরাঘুরি করেও আশ্চর্য্যজনকভাবে নিজেকে টায়ার্ড মনে হচ্ছিল না। রুম থেকেই ইন্টারকমে ফোন করলাম স্যারকে। ফোন ধরলেন ম্যাডাম, লায়ন কামরুন মালেক। তিনি স্যারের হাতে ফোন দিলেন। ফেরার খবরটি দিতেই স্যার বললেন, ‘সবাইকে ডেকে নাও। ডিনারে যাবো। বাইরে যাবো না। এদের এখানেই করবো।’ হোটেল গ্র্যান্ড ওয়েবয়। কলকাতা শহরের অন্যতম বেনদী হোটেল। রাজকীয় সব আয়োজন হোটেলজুড়ে। রেস্টুরেন্টের আবহ অন্যরকম, হাব-ভাবই আলাদা।
ইন্টারকমে ফোন করলাম কনফিডেন্স সিমেন্টের অন্যতম কর্ণধার লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়াকে, সুপ্রভা বৌদিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যেতে বললাম। ফোন করলাম লায়ন নিশাত ইমরান এবং লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী রেহেনাকে। রেস্টুরেন্টে ফোন করে আমাদের জন্য টেবিল রাখার অনুরোধ করলাম। রেস্টুরেন্ট থেকে বলা হলো, প্রচুর ভিড়, একটু পরে নামুন। আমাদেরকে আলাদা একটি রুমে দিলে কোন সমস্যা আছে কিনা জানতে চাইলেন তরুণী। আমি মুখে না বলার সাথে সাথে মাথাও নাড়লাম। বললাম, ‘কোন সমস্যা নেই। খাবার পেলেই হলো।’ তরুণী হাসলেন। একটি রুম নম্বর বলে দিয়ে আমাদের জন্য বুকিং দেয়া হয়েছে বলে জানালেন।
আমি আবারো ইন্টারকমে স্যার ম্যাডামসহ সবাইকে গ্রাউন্ড ফ্লোরে রেস্টুরেন্টের পাশের রুম নম্বরটি বলে দিলাম। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে আমি আগেই রওয়ানা হলাম।
চমৎকার একটি রুম। রুমের মাঝখানে বিশাল গোলাকার একটি টেবিল। টেবিল ঘিরে বারোটি চেয়ার। পাশে অনাদরে পড়ে থাকা আরো কয়েকটি চেয়ার। ইচ্ছে করলে বারো জনের পাশাপাশি আরো দু’চারজনকে টেবিলটিতে বসানো যাবে। চাইল্ড চেয়ারও দেখা গেল দুইটি। রেস্টুরেন্টের পাশের এই রুমগুলোতে লাঞ্চ ডিনারই সার্ভ হয়, এগুলো রেস্টুরেন্টেরই অংশ। এই হোটেলে প্রথম দিনও আমাদেরকে এমন একটি রুমে ডিনার সার্ভ করা হয়েছিল। আমাদের দেশে এখনো এই ধরনের রেস্টুরেন্ট খুব একটি চোখে পড়ে না। নগরীর গোলপাহাড় মোড়ে চীনা সংস্কৃতিতে গড়ে তোলা একটি রেস্টুরেন্টে এই ধরণের রুম ছিল। বিষয়টি পুরোপুরি চাইনিজ স্টাইল। চীনের প্রায় প্রতিটি রেস্টুরেন্টেই এমন আলাদা কয়েকটি কক্ষ থাকে। যেখানে পরিবার পরিজন, প্রিয়জন, সহকর্মী কিংবা আত্মীয় স্বজন নিজেদের মতো করে লাঞ্চ ডিনার সারে। প্রাইভেসি নিশ্চিত করতেই এমন ব্যবস্থা রাখা হয়। আমরাও রুমটিতে বসার পর কেউ আর আমাদের দেখছিল না। দারুণ একটি আবহ। দুজন ওয়েটার আমাদের খাবারের অর্ডার নেয়া থেকে সার্ভ করা পর্যন্ত সবই করছিলেন। নানা ধরনের খাবারের অর্ডার করেছিলেন আমার স্যার। সাথে যোগ করেছিলেন লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া। আমার ম্যাডামও টুকটাক অর্ডার করেছিলেন। বড়দের মাঝে আমার থাকার কথা নয়, তবুও কি কি যেন দিতে বলেছিলাম। সবকিছু মিলে জমজমাট এক ডিনার। রাতের বেলায় কম খাওয়া স্বাস্থ্যকর হলেও আমরা যেন অস্বাস্থ্যকর আয়োজনই চাঙ্গা করছিলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাসান আজিজুল হক ও তাঁর ‘আগুনপাখি’
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ